রেখায় রেখায় রূপমাধুরী

ধানমন্ডির বেঙ্গল শিল্পালয়ে এই প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন। সব কটি শিল্পকর্মই বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়েরের সংগ্রহের।

শিল্পী আমিনুল ইসলামের শিল্পকর্মের প্রদর্শনী ‘অর্গানিসিটি’র উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন কথাশিল্পী হাসনাত আবদুল হাই। বাঁয়ে ওয়াকিলুর রহমান ও ডানে লুভা নাহিদ চৌধুরী। গতকাল বেঙ্গল শিল্পালয়ে
ছবি: খালেদ সরকার

ছবি আঁকা হয় কি দিয়ে? সহজ উত্তর হলো, রেখা আর রঙে। এই ছবিগুলোতে প্রথাগত অর্থে রং নেই। তাহলে থাকল শুধু রেখা। সাদা কাগজে কালো রেখার গুচ্ছ। বহু বছর ধরে, বহু রকমে, অনেক ভাবনাচিন্তা, অনেক উপকরণ দিয়ে এই রেখাগুলো এঁকে গেছেন দেশের আধুনিক চিত্রকলার অন্যতম পথিকৃৎ শিল্পী আমিনুল ইসলাম। সেখান থেকে বাছাই করা ৯৭টি কাজ নিয়ে গতকাল মঙ্গলবার থেকে শুরু হয়েছে ‘অর্গানিসিটি’ নামের বিশেষ প্রদর্শনী।

ধানমন্ডির বেঙ্গল শিল্পালয়ে এই প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন। সব শিল্পকর্মই বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়েরের সংগ্রহের। প্রদর্শনীর কিউরেটরের দায়িত্বে ছিলেন শিল্পী ওয়াকিলুর রহমান। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন খ্যাতনামা কথাশিল্পী হাসনাত আবদুল হাই। স্বাগত বক্তব্য দেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক লুভা নাহিদ চৌধুরী। প্রদর্শনী চলবে আগামী ৮ জুলাই পর্যন্ত। কোনো বন্ধ থাকবে না, খোলা থাকবে রোজ বিকেল চারটা থেকে রাত আটটা অবধি।

রেখার নিজের একটি শক্তি আছে। তাকে নানাভাবে টানা, কাটা, ঘোরানো, প্যাঁচানো, বাঁকানো যায়। দেওয়া যায় সরু, স্ফীত, চ্যাপ্টা, ক্ষীণ, তীক্ষ্ণ অনেক রকমের আকার। আছে তার বৈচিত্র্যময় চলন, দেখেই মনে হয় এই রেখা চলছে খুব দ্রুত, কোনোটি আবার মন্থর। কিছু রেখা মনে হয় চলতে গিয়ে আচমকা থেমে গেছে, বেঁকে গেছে, চলে গেছে দূর–বহুদূর দিগন্ত পেরিয়ে অনন্তের দিকে। আবার ওপরে নিচে, ডানে বাঁয়ে, কৌণিক—এমন সব  দিক আছে রেখার চলনের। তো এসব হরেক রকমের রেখার হরেক আকার, সমন্বয়, বিচ্ছিন্নতা, গতিপ্রকৃতি কখনো কখনো কোনো গাছ, ফুল, পাখি, মানব শরীর বা বিশেষ কিছুর আবছা বা স্পষ্ট আকৃতি মূর্ত করে তোলে। আবার অধিকাংশ সময় কোনো চেনা আকারের আভাস তাতে থাকে না। একবারেই বিমূর্ত এসব রেখার গুচ্ছ নিজেই নিজের অস্তিত্বের নান্দনিক ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করে। দর্শককে সুযোগ করে দেয় নিজের মতো করে কিছু ভেবে নিতে।

উদ্বোধনী বক্তব্যে হাসনাত আবদুল হাই বলেন, আমিনুল ইসলাম আধুনিক দেশ, আধুনিক চিত্রকলা চর্চার পুরোধা এবং নিজেও আধুনিক ধারার কাজ করেছেন। বহু মাধ্যমে কাজ করলেও সারা জীবন নিয়মিতভাবে ড্রয়িং করে গেছেন।  প্রথম জীবনে তাঁর কাজ অবয়বধর্মী, মধ্য পর্যায়ে অবয়ব ও বিমূর্তের মাঝামাঝি এবং শেষ জীবনে পুরো বিমূর্ত ধারার কাজ করেছেন। তার গতিমান রেখার এই ড্রয়িংগুলো নতুন প্রজন্ম এখানে দেখতে পাবে।

হাসনাত আবদুল হাই গতকাল তাঁর জীবনের ৮৬ বছর পূর্ণ করলেন। উদ্বোধনী বক্তব্যের পর বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে তাঁকে ফুল দিয়ে জন্মদিনের আগাম শুভেচ্ছা জানানো হয়।  

কিউরেটর ওয়াকিলুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, আমিনুল ইসলাম আমাদের দেশের প্রথম প্রজন্মের আধুনিক চিত্রকলা চর্চার অন্যতম পথিকৃৎ শিল্পী। তিনি তেলরং, জলরং, ড্রয়িং নিয়ে প্রচুর কাজ করেছেন। এর বাইরেও মুর‌্যাল, কোলাজ, মোজাইকসহ অনেক রকম মাধ্যমে বিপুলসংখ্যক কাজ আছে তাঁর। ফলে একটি প্রদর্শনীতে তাঁর কাজের ধারা তুলে ধরা দুরূহ। সে কারণে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন আমাকে যখন কিউরেটর করার প্রস্তাব দিয়েছিল, তখন তাঁর একটি মাধ্যমের কাজ মোটামুটি বিস্তারিতভাবে তুলে ধরার চিন্তা করেছি। আবুল খায়ের আমিনুল ইসলামের অনেক মাধ্যমের বহু কাজ সংগ্রহ করেছেন। গ্যালারির পরিসরের বিবেচনা করে তাঁর সংগ্রহের ৩ শতাধিক ড্রয়িং থেকে ৯৭টি কাজ প্রদর্শনীর জন্য নেওয়া হয়েছে। আঁকার সময় ১৯৭০ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত। এই সময়ের মধ্যে জাতির স্বাধীনতাসহ অনেক অর্জন রয়েছে। এ সময়ের ড্রয়িংগুলোর আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। রেখাগুলো উল্লম্ব অর্থাৎ খাড়াভাবে উঠে গেছে। যেন কোনো কিছু তৈরি হচ্ছে। যেমন করে মাটি ভেদ করে গাছাপালা গজায়। তবে আরেক ধরনের রেখা আছে অনুভূমিক। গাছ যেমন ডালপালা ছড়িয়ে ছায়া দেয়, এমন। এই দুই ধরনের কাজ পৃথকভাবে সাজানো হয়েছে প্রদর্শনীতে।  

এসব রেখা চিত্রতল জুড়ে প্রবহমানতা ও ছন্দ সৃষ্টি করে। এর বিশেষ গতি আর সৌন্দর্য আছে। সেগুলো কখনো জ্যামিতিক নকশা সৃষ্টি করে, কখনো লতার মতো জড়িয়ে থেকে ঐক্যের বিন্যাস সৃষ্টি করে। খুব সাদামাটা উপাদান দিয়ে যে কাগজের ওপর অত্যন্ত গভীর নান্দনিক ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করা যায়, এই কাজগুলোতে আমিনুল ইসলাম তা দেখিয়েছেন। এসব কাজে তিনি কোনো বিশেষ কিছুর বর্ণনা দেননি। কোনো অতিরিক্ত অলংকারও নেই। তিনি কলম, তুলি এসবের প্রচলিত মাধ্যমসহ বাঁশের কঞ্চি, আগের দিনের কাঠের দেশলাই বাক্সের চওড়া অংশ, এমন নানা রকম উপকরণ ব্যবহার করেছেন। ফলে রেখার আকৃতিতে অনেক রকমের দ্যোতনা তৈরি হয়েছে।

নতুন প্রজন্মের শিল্পশিক্ষার্থীদের এসব কাজ থেকে অনেক কিছু শিক্ষণীয় রয়েছে। প্রদর্শনীর একটি প্রধান উদ্দেশ্য— নতুন শিক্ষার্থীদের কাছে পথিকৃৎ শিল্পীদের কাজের পরিচয় করিয়ে দেওয়া। আর ব্যক্তিগতভাবে আমার শিক্ষকের এই অসাধারণ কাজগুলোর সঙ্গে বেশ কিছুদিন নিবিড়ভাবে যুক্ত থেকে নিজেও সমৃদ্ধ হয়েছি, পেয়েছি গভীর আনন্দ।

আমিনুল ইসলামের জন্ম ১৯৩১ সালে। তিনি ১৯৪৮ সালে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন প্রতিষ্ঠিত ঢাকা আর্ট কলেজ (এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ) প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শেষে তিনি ইতালির ফ্লোরেন্স থেকে উচ্চতর শিক্ষা লাভ করেন। ফিরে এসে চারুকলা ইনস্টিটিউটে শিক্ষকতায় যোগ দেন। শিক্ষকতা করেছেন তিন দশক। রাজনৈতিকভাবে বাম চেতনায় উজ্জীবিত আমিনুল ইসলাম নান্দনিক বোধ, মানবিক চেতনা, সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা, আধুনিকমনস্কতা ও নিরন্তর নিরীক্ষার মাধ্যমে দেশের শিল্পকলায় এক স্বকীয় চিত্রভাষা যুক্ত করেছেন। চিত্রকলা চর্চার পাশাপাশি তিনি শিল্প-সমালোচনাতেও ছিলেন অগ্রগণ্য। জীবিতকালে তার নয়টি একক ও দেশ-বিদেশে ৪৩টি দলীয় প্রদর্শনী হয়েছে। স্বাধীনতা পদক, একুশে পদক, পঞ্চম তেহরান বিয়েনালে গ্র্যান্ড ইম্পেরিয়াল পুরস্কারসহ অনেক পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। ২০১১ সালের ৮ জুলাই থেমেছে তার তুলি-কলমের গতি। তবে যে রেখা তিনি এঁকে গেছেন তা গভীরভাবে রয়ে গেছে দেশের চিত্রকলার ভুবনে, কলারসিকদের অন্তরেও।