চট্টগ্রাম কারাগার
আসামি অন্যজন, চুক্তিতে কারাবাসে চা বিক্রেতা
চট্টগ্রামে ২০১৮ সালের জুলাইয়ে একই ধরনের ঘটনা ঘটেছিল।
যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত কুলসুমা আক্তারের পরিবর্তে কারাগারে যান মিনু আক্তার।
ফুটপাতের চা বিক্রেতা মজিবুর রহমান ১৫ দিন ধরে বন্দী হিসেবে আছেন চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে। অথচ তিনি কোনো মামলার আসামি নন। চেক প্রত্যাখ্যানের মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামি নাছির আহমেদের হয়ে সাজা খাটছেন তিনি। কারাগারে আঙুলের ছাপ না মেলায় বিষয়টি আদালতের নজরে আনে কারা কর্তৃপক্ষ। এরপর বেরিয়ে আসে চুক্তিতে আরেকজনের হয়ে কারাবাসে আসার বিষয়টি।
আদালত সূত্র জানায়, ২০১৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর মীর আহমেদ নামের এক ব্যক্তি নাছির আহমেদের বিরুদ্ধে ২০ হাজার টাকার চেক প্রত্যাখ্যানের মামলা করেন। ২০১৮ সালের ৩০ জুলাই আদালত নাছিরকে ২ মাসের কারাদণ্ড এবং ২০ হাজার টাকা জরিমানা করেন। পরে নাছির এই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করলে ২০২১ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি আদালত দুই মাসের পরিবর্তে এক মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড ও ২০ হাজার টাকা জরিমানা করেন। কিন্তু জামিনে গিয়ে পলাতক হয়ে যাওয়ায় আদালত আসামি নাছিরের বিরুদ্ধে সাজা পরোয়ানা জারি করেন। এই সাজা থেকে নিজেকে বাঁচাতে নাছির তাঁর পরিবর্তে চা বিক্রেতা মজিবুর রহমানের সঙ্গে চুক্তি করেন।
আদালত প্রাঙ্গণে পুলিশের উপস্থিতিতে মজিবুর রহমান গতকাল সোমবার দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, নাছির ও তাঁর মধ্যে তিন হাজার টাকার চুক্তি হয়। তাঁর দোকানে চা খেতে এলে নাছিরের সঙ্গে পরিচয় হয়। তিনি তাঁকে বলেছিলেন, কারাগারে যাওয়ার দু-এক দিন পর তাঁকে বের করে আনবেন। এ জন্য তিনি নাছির সেজে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। বের হলে তাঁকে আরও টাকা দেবেন বলে জানিয়েছিলেন নাছির। এখন তিনি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছেন।
চলতি মাসের ১৩ মার্চ মজিবুর নাছির সেজে তৃতীয় যুগ্ম মহানগর দায়রা জজ আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। আদালত জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে আসামিকে কারাগারে পাঠিয়ে দেন। নাছির সেজে আসা মজিবুরের পক্ষে আইনজীবী ছিলেন তৌহিদুল ইসলাম। জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আসামি নিজের পরিচয় নিশ্চিত করতে জাতীয় পরিচয়পত্রও নিয়ে আসেন। পরে জানতে পারি, প্রকৃত আসামির পরিবর্তে আরেকজন আত্মসমর্পণ করেছেন। আদালতকে লিখিতভাবে দিয়ে ওকালতনামা প্রত্যাহার করে নিয়েছি।’
আইনজীবী কোনো অবস্থাতেই দায় এড়াতে পারেন না বলে মন্তব্য করেছেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আইনজীবী নিজেই ওই ব্যক্তিকে শনাক্ত করেছেন। সঠিক পরিচয় জেনে খুবই সতর্কতার সঙ্গে কাজটি করা উচিত, যাতে পেশার মান সমুন্নত থাকে।
চেক প্রত্যাখ্যানের মামলায় সাজাপ্রাপ্ত নাছির আহমেদের বদলে সাজা খাটছেন ফুটপাতের চা বিক্রেতা মজিবুর রহমান।
আদালত সূত্র জানায়, আসামি নাছির চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার বাসিন্দা হলেও থাকতেন নগরের বহদ্দারহাট এলাকায়। এর পাশের এলাকা চান্দগাঁয়ে ফুটপাতে বসে চা বিক্রি করেন মজিবুর। সেখানেই তাঁদের পরিচয়।
চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের জ্যেষ্ঠ তত্ত্বাবধায়ক মুহাম্মদ মঞ্জুর হোসেন বলেন, ‘কারাগারে আসা আসামিদের আঙুলের ছাপ নেওয়া হয়। নাছিরের ছাপ নেওয়া হলে ১৬ মার্চ জানতে পারি তিনি নাছির নন। জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী তিনি সাভারের বাসিন্দা মজিবুর রহমান। কিন্তু সাজা পরোয়ানায় রয়েছে নাছির আহমেদ। কারাগারে আসার পর আসামি মজিবুর নিজেকে নাছির হিসেবে পরিচয় দেন। বিষয়টি লিখিতভাবে আদালতকে জানানো হয়।’
তৃতীয় যুগ্ম মহানগর দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি নাছরিন আক্তার চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, কারাগারের দেওয়া প্রতিবেদন অনুযায়ী এবং আসামি নিজেও স্বীকার করেছেন চেক প্রত্যাখ্যানের মামলার সাজাপ্রাপ্ত প্রকৃত আসামি তিনি নন। টাকার বিনিময়ে কারাভোগ করছেন। প্রকৃত আসামি নাছিরের বিরুদ্ধে সাজা পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত। আজ মঙ্গলবার আদালত এ বিষয়ে বিস্তারিত আদেশ দেবেন।
একজনের হয়ে আরেকজনের কারাবাস চট্টগ্রামে নতুন ঘটনা নয়। নগরের কোতোয়ালি থানার একটি হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি কুলসুমা আক্তারের পরিবর্তে ২০১৮ সালের ৯ জুলাই কারাগারে যান মিনু আক্তার। মর্জিনা আক্তার নামের পূর্বপরিচিত এক নারী তাঁকে টাকা দেওয়ার কথা বলে কারাগারে যেতে বলেন। তিনি কুলসুমাকে চেনেন না। ২০২১ সালের ১৬ জুন তিন বছর পর মুক্তি পান মিনু।