মুক্তিযুদ্ধে সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা

মুক্তিযোদ্ধাদের শেখানো হচ্ছে অস্ত্রচালনাছবি: অমিয় তরফদার, ১৯৭১

মার্ক টালি বিবিসির খ্যাতিমান সাংবাদিক। তিনি বিবিসিতে ৩০ বছর কাজ করেছেন। এর মধ্যে ২০ বছর নয়াদিল্লিতে প্রতিষ্ঠানটির ব্যুরো চিফ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বিবিসিতে তিনি ব্যাপকভাবে মুক্তিযুদ্ধের খবর প্রচার করেন। ভারত সরকারের পক্ষ থেকে মুক্তিযুদ্ধের কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীর অভিজ্ঞতা ভিডিওতে ধারণ করা হয়েছিল। মার্ক টালিও ছিলেন তাঁদের একজন।

ভিডিওগুলো আমরা পেয়েছি বাংলাদেশে ভারতীয় হাইকমিশনের সৌজন্যে। যখন ঢাকার বাইরে গেলাম—যেমন রাজশাহীর কথা বলতে পারি—দেখলাম যে রাস্তার পাশের প্রায় প্রতিটি গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। স্পষ্টভাবেই এই ভূমিতে স্রেফ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার বাসনায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনী গ্রামগুলোয় আগুন লাগিয়েছে।

আমি তখন বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের জন্য কাজ করছিলাম। ছিলাম দক্ষিণ এশিয়ার বিশ্ব পরিষেবার প্রধান ভাষ্যকার। কাজটি ছিল লন্ডনভিত্তিক। তবে আমাকে নিয়মিত দক্ষিণ এশিয়ায় ভ্রমণ করতে হতো। ১৯৭১ সালে সামরিক হামলার পরে সেই সময়ের পূর্ব পাকিস্তানে যে সাংবাদিকদের প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল, তাঁদের প্রথম দলে আমি ছিলাম। সারা দেশে আমাদের মোটামুটিভাবে অবাধে ভ্রমণ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। এর আগে সাংবাদিকদের আরেকটি দল এসেছিল। কিন্তু তারা একদমই স্বাধীনভাবে ঘুরতে পারেনি। সেটা ছিল, যাকে বলে, একরকমের নিয়ন্ত্রিত ভ্রমণ।

এই হিসেবে আমি ছিলাম সেসব সাংবাদিকের মধ্যে, যারা সেনাবাহিনীর আক্রমণের প্রভাব নিরূপণ করতে পেরেছিল, যাচাই করতে পেরেছিল চারপাশের মানুষের অনুভূতি। সেই সঙ্গে সাধারণভাবে ভবিষ্যতে কী হতে পারে, তা–ও আমি হিসাব করার চেষ্টা করেছিলাম।

সে সময় আমরা যা দেখেছি, যা শুনেছি, তা ছিল হামলার প্রমাণ। সেনারা সেনানিবাস থেকে যে গুলি করতে করতে বের হয়ে এসেছিল, আমরা স্পষ্ট তা বুঝতে পেরেছি। যে ক্ষতি তারা করেছিল, তা আমরা দেখেছি। দেখেছি বিশ্ববিদ্যালয়ে কেমন ক্ষতি হয়েছে। বিশেষ করে যখন ঢাকার বাইরে গেলাম—যেমন রাজশাহীর কথা বলতে পারি—দেখলাম যে রাস্তার পাশের প্রায় প্রতিটি গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। স্পষ্টভাবেই এই ভূমিতে স্রেফ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার বাসনায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনী গ্রামগুলোয় আগুন লাগিয়েছে। বল প্রয়োগ করে বাসিন্দাদের গ্রামছাড়া করেছে যেন তারা সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারে।

আমি ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। তাঁর সঙ্গে দেখা করছিলাম লন্ডনে। তিনি তখন বিদেশভ্রমণে ছিলেন। খুব আবেগপূর্ণ আর জোরালো একটা সাক্ষাৎকার তিনি দিয়েছিলেন। প্রায় স্পষ্টভাবেই পশ্চিমা বিশ্বকে তিনি বলছিলেন, ‘তোমরা যদি আমাদের সাহায্য করতে দ্রুতই কোনো পদক্ষেপ না নাও, তাহলে আমাদের নিজেদেরই কিছু করতে হবে।’ এটাই ছিল তাঁর মূল বার্তা। সে বার্তা তিনি তাঁর স্বভাবসুলভ দৃঢ়তা আর হৃদয়স্পর্শী ভঙ্গিতেই দিয়েছিলেন।

মার্ক টালি

আমার মনে হয় না এ যুদ্ধ বন্ধ করার মতো কোনো অবস্থানে ভারত ছিল। কারণ, বোঝাই যাচ্ছিল যে পাকিস্তান যেকোনোভাবে পূর্ব পাকিস্তানে তাদের দখল কায়েম রাখতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আর অন্যদিকে পশ্চিমা এবং অন্যান্য দেশ, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র খুব একটা বা কোনো রকম চাপই দিচ্ছিল না। আসলে পাকিস্তানকে তারা সক্রিয়ভাবে সমর্থনই করছিল। তাহলে ভারত এখন কী করবে? ইন্দিরা গান্ধী এখন কী করবেন? কী বিকল্প ছিল তাঁর হাতে? এ তো আর আশা করা যায় না যে তিনি বলবেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করুক, আমরা কোনোভাবেই এতে জড়াব না, মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে কোনোভাবেই সংম্পৃক্ত হব না। এ রকম হলে পূর্ব পাকিস্তানে স্বাভাবিকভাবেই এক সামরিক উপনিবেশে পরিণত হবে। সেটি সন্তোষজনক কোনো পরিস্থিতি তৈরি করবে না। অনেকেই এমনটা মনে করতেন।

আমি মনে করি, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম তখন ব্যাপক প্রচারণা দিয়েছিল। মার্কিন গণমাধ্যম তাদের সরকার সহানুভূতিশীল না হওয়া সত্ত্বেও ইতিবাচক প্রচারণা দিয়েছিল। প্রতিদিন আমি প্রতিবেদনগুলো পড়তাম আর বিবিসির জন্য আমার নিজের ভাষ্য তৈরি করতাম। এসব প্রতিবেদন ছাড়াও আমি আমার প্রতিবেদনে বাংলাদেশি প্রতিনিধির পাঠানো তথ্য যোগ করতাম। এ রকম প্রতিনিধিদের আমরা বলতাম ‘স্ট্রিংগার’। তাঁরা খুবই সাহসী ছিলেন। বিবিসির স্ট্রিংগারের নাম ছিল নিজামউদ্দিন। তিনি একজন বুদ্ধিজীবী ছিলেন। খুব ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতেন। পকিস্তানি সেনারা তাঁকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে।

সংকট: মুক্তিযুদ্ধের আগে ও পরে

বাঙালিরা ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রতি সহানুভূতিশীল, অত্যন্ত সহানুভূতিশীল। প্রকৃতপক্ষে তিনিই ছিলেন তাদের অনুপ্রেরণা। তিনি দেশে ফেরার পর তাঁকে দেওয়া বিপুল সংবর্ধনায় সেটাই দেখা গেছে। এর কিছুদিন পরই আমি বঙ্গবন্ধুর একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। মানুষের প্রবল সমর্থন পেয়ে তিনি ছিলেন উচ্ছ্বসিত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি মানুষের ভালোবাসা বিপুল হওয়া সত্ত্বেও যে পরিস্থিতিতে তিনি ছিলেন, সেটা ছিল খুবই জটিল। দেশের অবকাঠামোর অবস্থা ছিল খুবই নাজুক। বাংলাদেশ জলপ্রধান দেশ। অথচ সেতু ও ফেরি—সব ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। রেল যোগাযোগ–ব্যবস্থা ছিল অকার্যকর। এসব ছিল সমস্যার একটা অংশ। দেশের পুরো অবকাঠামোই আসলে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।

আরেক সংকট ছিল মুক্তিবাহিনী নিয়ে। মুক্তিবাহিনী নিয়ে কী করা হবে? তাদের কতজনকে সেনাবাহিনীতে নেওয়া হবে? সেনাবাহিনীই–বা কত বড় হবে? এসব নিয়ে মুক্তিবাহিনীর মধ্যে ব্যাপক হতাশা কাজ করছিল।

আর ছিল খাদ্যের তীব্র ঘাটতি। সত্যিই একটা দুর্ভিক্ষ চলছিল। পশ্চিমবঙ্গ থেকে আমি সেই দুর্ভিক্ষ দেখেছি। আক্ষরিক অর্থেই কোচবিহারের রাস্তায় আমি মানুষ মরতে দেখেছি। সুতরাং খাদ্যসংকট তো ছিলই।

সমস্যা আরও একটা ছিল। পাকিস্তানি বাহিনী পরাজিত হওয়ার পর সবাই ছিল আনন্দে উচ্ছ্বসিত। কিন্তু যে তীব্র কঠিন সংগ্রাম তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল, তা তারা আসলে উপলব্ধি করতে পারছিল না। তারা ভেবেছিল, আমরা এখন তো স্বাধীন। সবকিছু এবার ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু তা হওয়ার ছিল না। হয়ওনি। তবে এসবের খুব বেশি কিছু আমার দেখা হয়নি। কারণ আমি আগেই বলেছি। তখন আমি ছিলাম লন্ডনে। পূর্ব পাকিস্তানে আমি ছিলাম যুদ্ধে ভারতীয় বাহিনী সরাসরি জড়িত হওয়ার আগে।

বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার পরপরই তাঁর সাক্ষাৎকার নিতে আমি বাংলাদেশে এসেছিলাম। ভারতীয় বাহিনী যা করেছিল, তার জন্য বঙ্গবন্ধু খুব কৃতজ্ঞ ছিলেন। যে কজন বাঙালির সঙ্গে আমি কথা বলেছি, তারাও এ কারণে কৃতজ্ঞ ছিল।

তবে একটা কথা বোধ হয় আমার যুক্ত করা উচিত—বাঙালিরা অবশ্যই যথেষ্ট যৌক্তিক কারণেই বিবেচনা করেছিল যে তারা মুক্তিবাহিনীর মাধ্যমে যুদ্ধে জয়ী হয়েছে। আর এটা তো সত্যি যে মুক্তিবাহিনী প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল।

আমার মনে হয়, (সংকটটির) রাজনৈতিক সমাধান পাওয়া খুব কঠিন ছিল। কারণ, সামরিক হামলার পর বাংলাদেশের মানুষ ছিল খুব উত্তেজিত। মনে হয় না পাকিস্তানের খুব বড় কোনো ভূমিকার চেয়ে কম কিছু তারা মেনে নিত। তারা নির্বাচনে জিতেছে। নিদেনপক্ষে তারা সরকার গঠনের দাবি করবে, এটা তো স্বাভাবিকই। আর (জুলফিকার আলী) ভুট্টো তো পরিষ্কারই করে দিয়েছিলেন যে তিনি সেটা মেনে নেবেন না। ফলে সামরিক শাসন জারি হলো। কিন্তু সামরিক শাসন কোনো সমাধান ছিল না।

বাংলাদেশের সংকট আসলে শুরু হয়েছিল দেশভাগের পরপরই, যখন জিন্নাহ বাংলাদেশে, মানে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে গিয়ে ঘোষণা করলেন, উর্দুই হবে রাষ্ট্রভাষা। সে সময় থেকেই সেখানে অস্থিরতা শুরু হয়ে গিয়েছিল।

সামরিক হামলার প্রমাণ

আমি আগেই বলেছি, সামরিক হামলার পর আমিও আন্তর্জাতিক সাংবাদিকদের দলের একজন ছিলাম। যদি স্মৃতি প্রতারণা না করে, আমাদের সেই ভ্রমণ ছিল সীমিত সময়ের জন্য। অনির্দিষ্টকালের জন্য তো আর আমাদের থাকতে দেওয়া হবে না। আমরা বিস্তৃত এলাকায় ঘুরে বেড়িয়েছি।

মজার ব্যাপার হলো, মানুষ বিবিসির ওপর খুব নির্ভর করত। আমি বিবিসিতে কাজ করেছি বলে বলছি না। পাকিস্তান রেডিও তো ছিলই। তারা পাকিস্তানি দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরত। ছিল অল ইন্ডিয়া রেডিও। তারা ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরত। বিবিসি ছিল প্রধান বিদেশি চ্যানেল। ধরে নেওয়া হতো যে আমরা নির্ভরযোগ্য সংবাদ প্রচার করছি। আশা করি, আমরা তা করতামও। ফলে বাংলাদেশে আমাদের খুব সম্মান করা হতো। তবে পশ্চিম পাকিস্তানে যে আমরা খুব সমীহ পেতাম, তা বলা যাবে না। পরিস্থিতি যেমন ছিল, তাতে এ রকম হওয়াটাই স্বাভাবিক।

মনে পড়ছে, পাকিস্তান রেডিওতে আমাকে একটা তালিকা দেখানো হয়েছিল। তালিকাটা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষ বিবিসিকে কী বলে ডাকে। কেউ কেউ বলত বিবিসি মানে ‘ভারত ব্রডকাস্টিং করপোরেশন’। আরেকটা ডাক ছিল আরও মজার, ‘ব্রিটিশ বকোয়াস করপোরেশন’। এ–ই ছিল বিবিসি সম্পর্কে পশ্চিম পাকিস্তানের দৃষ্টিভঙ্গির নমুনা। পাকিস্তান রেডিও ছিল নিছক প্রচারণা। তারা তাদের বেশির ভাগ সময় ব্যয় করত বিবিসি, অল ইন্ডিয়া রেডিও আর অন্যদের করা প্রতিবেদন অস্বীকার করার কাজে। এসব করে অবশ্য পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির ওপর তারা কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি।

যখন ঢাকার বাইরে গেলাম—যেমন রাজশাহীর কথা বলতে পারি—দেখলাম যে রাস্তার পাশের প্রায় প্রতিটি গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। স্পষ্টভাবেই এই ভূমিতে স্রেফ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার বাসনায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনী গ্রামগুলোয় আগুন লাগিয়েছে।

মার্কিন বৈরিতা

যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পক্ষ থেকে (বাংলাদেশের প্রতি) ব্যাপক বৈরিতা ছিল। যুক্তরাষ্ট্র সরকার প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তান সরকারকে সমর্থন করছিল। ভারত সরকার বিখ্যাত মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে। এভাবে দেখলে কিছু অর্থে পরাশক্তিগুলোর মধ্যে একটা ভারসাম্য ছিল। যুক্তরাষ্ট্র সপ্তম নৌবহর পাঠালেও তাদের সে উদ্যোগ বেশি কার্যকর হয়নি। অর্থাৎ একটা ভারসাম্য ছিল। তবে আমার দৃষ্টিতে পশ্চিমা বিশ্বে জনমত ছিল প্রবলভাবে পাকিস্তানের বিপক্ষে আর পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের পক্ষে। উদার সমর্থনের মধ্য দিয়ে অনেক ত্রাণসহায়তা এসেছিল।

কিসিঞ্জার বলেছিলেন, বাংলাদেশ একটা তলাহীন ঝুড়ি। তাঁর এই বক্তব্য একেবারে ভুল প্রমানিত হয়েছে। বাংলাদেশ এখন একটা বিকাশমান গণতন্ত্র। তবে তখন বাংলাদেশের জরুরি ভিত্তিতে সব রকমের ত্রাণের প্রয়োজন ছিল। সে ক্ষেত্রে সাড়া ভালো পাওয়া গিয়েছিল।

ভারতের অবস্থান

আমার মনে হয়, একেবারে প্রাথমিক অবস্থাতেই খুব স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে পাকিস্তানি বাহিনী মহাসংকটে পড়েছে, বিশেষ করে ভারতের ওপর দিয়ে পাকিস্তানি বিমান চলাচল বন্ধ করে দেওয়ার পরে। এটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল যে পাকিস্তানি বাহিনী কোনোরকমে আবার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারলেও সেটা খুব কাজের কিছু হবে না। সে রকম নিয়ন্ত্রণ দিয়ে পূর্ব আর পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে শান্তি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক দাঁড় করানো যাবে না। সব মিলিয়ে বেশ পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল যে পাকিস্তান ভাঙবেই।

এমন পরিস্থিতিতে চ্যালেঞ্জ হলো তথ্য সংগ্রহ, সে তথ্য স্থানান্তর করা এবং এটা নিশ্চিত করা যে সে তথ্য ভারসাম্য রেখে উপস্থাপন করা হচ্ছে। এ রকম সংঘাতমূলক পরিস্থিতিতে কোনো এক অংশের পক্ষ নিয়ে নেওয়া অস্বাভাবিক নয়। তাই এ রকম সময় খুব সতর্ক থেকে ভারসাম্য বজায় রাখতে হয়।

ভারত সে সময়ে বিপুলসংখ্যক শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছিল। শরণার্থী সমস্যাটা তাদের মোকাবিলা করতে হয়েছিল। এতে ভারত বিদ্যমান পরিস্থিতির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার একটা যুক্তি পেয়েছিল। শেষে তারা মুক্তিবাহিনীকে সক্রিয় সহযোগিতা দেয়।

মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ
ছবি: অমিয় তরফদার, ১৯৭১

ভারতীয় অবস্থান থেকে বিবেচনা করলে এই বিরাটসংখ্যক শরণার্থী নিয়ে তাদের কিছু করতেই হতো। তাই তারা একটা নীতি নিয়েছিল। কেউ কেউ তার সমালোচনা করেছিল। কিছু মানুষ বলেছিল যে যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে এ রকম সক্রিয় হস্তক্ষেপ করা তাদের উচিত হয়নি। অন্যরা বলেছিল, যে বিশালসংখ্যক শরণার্থী ভারতে প্রবেশ করছিল, তাতে ভারতের হাতে আর কোনো বিকল্প ছিল না।

যুদ্ধের পর ভারতীয় সেনাবাহিনীর দুজন প্রধান ব্যক্তির সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। একজন জেনারেল (জগজিৎ সিং) অরোরা। তিনি ছিলেন পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের দায়িত্বে। আরেকজন ছিলেন তাঁর সহকারী জেনারেল (জে এফ আর) জেকব। যা ঘটেছিল, সেসব নিয়ে তাঁরা আমাকে অনেক কাহিনি বলেছিলেন। ঘটনাগুলোর নানা কিছু নিয়ে যে সব সময় তাঁরা একমত হতেন, তা অবশ্য নয়। তবে একটা কথা তাঁরা সব সময় বলতেন, ইন্দিরা গান্ধীকে ভারতীয় বাহিনীর বিলম্বে যুদ্ধে নামতে বলার পরামর্শ দিয়ে জেনারেল (স্যাম) মানেক শ খুব ঠিক কাজটি করেছিলেন। যুদ্ধে নামার জন্য তাদের তৈরি হওয়ার দরকার ছিল। আর সে সময়টা ছিল বর্ষাকালের পর। তাঁরা দুজনই অনুভব করতেন যে এটা ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত।

ইন্দিরা গান্ধী পাকিস্তানি বন্দী সৈনিকদের আটকে রাখতে আগ্রহী ছিলেন না। ভুট্টোকে আরও অপমানিত করার জন্য, তাঁকে নমনীয় হতে বাধ্য করার জন্য তিনি তাদের আটকে রাখতে পারতেন। কিন্তু ইন্দিরা ভুট্টোর কথা মেনে নিলেন। যুদ্ধবন্দীরা মুক্তি পেয়েছিল। আমার মতে, এ ক্ষেত্রে আরেকটা বিষয় ভূমিকা রেখেছিল। তা হলো, এই বিশালসংখ্যক যুদ্ধবন্দীকে তিনি আটকে রাখতে চাইছিলেন না।

(ঈষৎ সংক্ষেপিত)

  • অনুবাদ: জাভেদ হুসেন