সম্মানী পাচ্ছেন উপাচার্যের পাশাপাশি গাড়িচালকও

চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ৪০টির ওপর বেসরকারি মেডিকেল ও নার্সিং কলেজ রয়েছে। বছরে চারটি করে পরিচালনা পর্ষদের সভা হয়।

প্রতীকী ছবি

চট্টগ্রামের বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও বেসরকারি নার্সিং কলেজগুলো পরিচালনা পর্ষদের সম্মানীর চাপে পড়েছে। সম্মানী গ্রহণকারীর তালিকায় চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য যেমন আছেন, তেমনি আছেন তাঁর গাড়ির চালক। যদিও সম্মানী দেওয়ার নিয়ম নেই।

গত সপ্তাহে বেসরকারি একটি মেডিকেল কলেজের একজন উদ্যোক্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে জানান, পরিচালনা পর্ষদের একটি সভায় অংশগ্রহণ করার সম্মানী বাবদ সদস্যদের ৭০ হাজার টাকার বেশি সম্মানী দিতে হচ্ছে। খাওয়া বাবদ আরও ৫-৭ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। বছরে এ রকম সভা হচ্ছে চারটি।

উপাচার্য বা তাঁর প্রতিনিধি দায়িত্বের অংশ হিসেবে সভায় অংশ নেন। এতে সম্মানীর প্রশ্ন ওঠে না। কিন্তু সম্মানী দেওয়াটা চর্চায় পরিণত হয়েছে। এই চর্চার নানা বিচ্যুতি আছে। অনেকে সভায় উপস্থিত না থেকেও সম্মানী নেন। এসবই অনাচার।
অধ্যাপক রশিদ-ই-মাহবুব, সাবেক সভাপতি, বিএমএ

চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ৪০টির ওপর বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও বেসরকারি নার্সিং কলেজ রয়েছে। এসব কলেজে বছরে চারটি করে পরিচালনা পর্ষদের সভা হয়। গতকাল রোববার তিনটি মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়।

মেরিন সিটি মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক সুযত পাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘নিয়ম অনুযায়ী পরিচালনা পর্ষদের সভা হয়। এই মাসে একটি সভা হয়েছে। সভায় উপাচার্য স্যার উপস্থিত ছিলেন।’

মা ও শিশু মেডিকেল কলেজের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান রেজাউল করিম আজাদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমন্ত্রণ জানালে ভিসি স্যার এখানে আসেন। সম্মানীর বিষয়টি এই মুহূর্তে বলতে পারছি না।’

সাউদার্ন মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক জয়ব্রত দাশ প্রথম আলোকে বলেন, ‘পরিচালনা পর্ষদের সভায় বাইরে থেকে যাঁরা আসেন, আমরা তাঁদের ১০ হাজার টাকা করে সম্মানী দিই।’

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত একটি কলেজের পরিচালনা পর্ষদের সভার খরচের হিসাবে দেখা যায়, সভার জন্য খরচ হয়েছে ৮৪ হাজার টাকা। এর মধ্যে সম্মানী বাবদ খরচ হয়েছে ৭৭ হাজার টাকা। আর খাবার বাবদ খরচ হয়েছে ৭ হাজার টাকা।

কলেজটি সম্মানী দিয়েছে মোট ১০ জনকে। এর মধ্যে চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচজন। সবচেয়ে বেশি সম্মানী পেয়েছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. ইসমাইল খান। সম্মানীর বিষয়ে জানতে চাইলে উপাচার্য প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিটি মেডিকেল কলেজের গভর্নিং বডিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি আছে। কোনোটাতে আমন্ত্রণ জানালে আমি যাই। উপাচার্য হিসেবে যেকোনো সভায় আমি যেতে পারি। কয়েকটি কলেজের দরিদ্র মেধাবী কোটা-সম্পর্কিত বৈঠকেও আমি গিয়েছি। এখন ৫ হাজার বা ১০ হাজার টাকা সম্মানী দিল তারা। তা নিয়ে কথা উঠছে। এটা তো ঠিক না। আমি ভিসি হিসেবে এই সম্মানী কি পেতে পারি না? সম্মানীর জন্য তো সভায় যাচ্ছি না।’

পরিচালনা পর্ষদের সভায় উপাচার্যকে নিয়ে যাচ্ছেন তাঁর গাড়িচালক। তাঁকেও সম্মানী দিতে হচ্ছে। এ ব্যাপারে উপাচার্য মো. ইসমাইল খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার একটা আত্মীয়ের বাড়িতে গেলে চালককে বকশিশ হিসেবে টাকা দিই। এখানেও বকশিশ হিসেবে কোনো কলেজ তাঁকে এক হাজার টাকা দিয়েছে। এটা ছোটখাটো বিষয়। এগুলো ইগনোর (এড়ানো) করা যায়।’

আইনে বেসরকারি মেডিকেল কলেজের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য কত হবে, তা বলা নেই। তবে বলা আছে যে পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান হবেন উদ্যোক্তাদের পক্ষের সদস্য। চেয়ারম্যান ছাড়াও ৫০ শতাংশ সদস্য হবেন উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে। কিন্তু আইনে কোথাও পর্ষদের সভায় অংশগ্রহণের জন্য সদস্যদের সম্মানী দেওয়ার কথা বলা নেই।

আইনে না থাকলেও বিভিন্ন মেডিকেল কলেজের পক্ষ থেকে পরিচালনা পর্ষদের সভায় উপস্থিত সদস্যদের কিছু সম্মানী দেওয়ার রেওয়াজ আছে।

সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এ এইচ এম এনায়েত হোসেন তাঁর অধীন কোনো কলেজের পরিচালনা পর্ষদের সভায় যান না। তিনি প্রতিনিধি পাঠান। অধ্যাপক এ এইচ এম এনায়েত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি জানি না আমার প্রতিনিধি কোনো সম্মানী পান কি না, বা নেন কি না। কারণ, আমি কোনো দিন জিজ্ঞাসা করিনি।’

রাজধানীর ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, পরিচালনা পর্ষদের সভায় অংশগ্রহণকারীরা পাঁচ হাজার টাকা করে পান।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে প্রবীণ চিকিৎসক ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক রশিদ-ই-মাহবুব প্রথম আলোকে বলেন, উপাচার্য বা তাঁর প্রতিনিধি দায়িত্বের অংশ হিসেবে সভায় অংশ নেন। এতে সম্মানীর প্রশ্ন ওঠে না। কিন্তু সম্মানী দেওয়াটা চর্চায় পরিণত হয়েছে। এই চর্চার নানা বিচ্যুতি আছে। অনেকে সভায় উপস্থিত না থেকেও সম্মানী নেন। এসবই অনাচার।