সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা না হলে ঐক্য সম্ভব নয়

রাজধানীর বাংলা একাডেমির কবি শামসুর রাহমান সেমিনার কক্ষে আজ বুধবার আয়োজিত ‘জুলাই অভ্যুত্থান: প্রমাণ ও নৃশংসতা’ শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন আলোচকেরাছবি: আশরাফুল আলম

জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো নিয়ে সত্য প্রতিষ্ঠা এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত না করা গেলে রিকনসিলিয়েশন (বিভেদ ঘুচিয়ে একসঙ্গে চলা) সম্ভব নয়। সত্য ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত না করা পর্যন্ত রিকনসিলিয়েশন একটি ‘বায়বীয় ধারণা’ হিসেবেই থেকে যাবে। এমন পরিস্থিতিতে জুলাই-আগস্টের প্রতিটি হত্যাকাণ্ড কোথায় ঘটেছিল, কখন ঘটেছিল, কীভাবে ঘটেছিল, কারা ঘটিয়েছিল এবং কাদের নির্দেশে ঘটেছিল—এগুলোর দালিলিক প্রমাণ সংগ্রহের মাধ্যমে সত্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এভাবে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার মাধ্যমেই বিভেদ ঘুচিয়ে জাতিকে ঐক্যের জায়গায় পৌঁছতে হবে।

আজ বুধবার রাজধানীর বাংলা একাডেমির কবি শামসুর রাহমান সেমিনার কক্ষে আয়োজিত ‘জুলাই অভ্যুত্থান: প্রমাণ ও নৃশংসতা’ শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে আলোচকেরা এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ইন্টারন্যাশনাল ট্রুথ জাস্টিস প্রজেক্ট এবং টেক গ্লোবাল ইনস্টিটিউট। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের দিনে ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ডের ওপর দুটি প্রামাণ্যচিত্র উপস্থাপন করা হয় অনুষ্ঠানে। পাশাপাশি ‘ব্লাড শেড ইন বাংলাদেশ’ নামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধু ১৯ জুলাই ১৪৮ জনের মৃত্যু হয়েছে, যাদের ৪০ জনের বয়স ১৮ বছরের কম।

অনুষ্ঠানে জুলাই-আগস্টে ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ড নিয়ে দক্ষিণ সুদানে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক কমিশনের প্রধান এবং ইন্টারন্যাশনাল ট্রুথ অ্যান্ড জাস্টিস প্রজেক্টের নির্বাহী পরিচালক ইয়াসমিন সুকা বলেন, জুলাই-আগস্টের নৃশংসতায় পুলিশের বেআইনি এবং উদ্দেশ্যমূলক বল প্রয়োগ ছিল। এটি মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। এই অপরাধ আদালতে প্রমাণিত হলে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে। শেখ হাসিনা এসব হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে জানতেন। এসব ঘটনা বন্ধে তিনি কোনো পদক্ষেপ নেননি এবং কিছু বলেননি।

জুলাই-আগস্টে হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার বিষয়ে ইয়াসমিন সুকা বলেন, জুলাই-আগস্টে কতজন মারা গেছেন, কতজন আহত হয়েছেন তার সঠিক সংখ্যা এখন পর্যন্ত জানা যায়নি। হতাহত ব্যক্তিদের অবস্থা কী হয়েছে, তাঁরা কোথায় হতাহত হয়েছেন, এসব সাধারণ প্রশ্নেরও সঠিক উত্তর পাওয়া যায়নি। এসব হত্যাকাণ্ড কেন ঘটল, কীভাবে সম্ভব হলো, তা খুঁজে বের করতে হবে। সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি অপরাধের দায় স্বীকারের বিষয় রয়েছে। যাঁরা এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত তাঁদের দায় স্বীকার করতে হবে। এটা করা না গেলে রিকনসিলিয়েশন ধারণাটি একটি বায়বীয় ধারণার মতো হবে।

জুলাই-আগস্টের হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হলে হত্যাকাণ্ডগুলো কাদের নির্দেশে ঘটেছে, সেই ‘শীর্ষ ব্যক্তি’দের চিহ্নিত করার ওপরও গুরুত্ব দেন ইয়াসমিন সুকা। তিনি বলেন, হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলোর অপরাধভিত্তিক বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে। ঘটনাস্থলের অপরাধগুলো বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে কে বা কারা আদেশ দিয়েছেন সেই সংযোগ খুঁজতে হবে।

অনুষ্ঠানে জুলাই-আগস্টের হত্যাকাণ্ডে ভুক্তভোগীদের ন্যায়বিচার পাইয়ে দেওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান দায়িত্ব বলে মন্তব্য করেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। তিনি বলেন, সরকারের যে সংস্কার ভাবনা, নির্বাচন ভাবনা, এগুলো একটির সঙ্গে আরেকটির আন্তসংযোগ আছে। সংস্কার ভাবনার অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। পাশাপাশি আর কোনো শাসক যেন ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার মতো এত নির্মম, পাশবিক এবং অমানবিক হওয়ার সুযোগ না পায়, তা নিশ্চিত করা।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, প্রামাণ্যচিত্রে যেটা দেখা গেছে, যে নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, তাঁদের শনাক্ত করা জরুরি। এর পাশাপাশি এটা খুঁজে বের করা দরকার কেন তাঁরা এমন নিষ্ঠুর আচরণ করলেন। কেন রাষ্ট্র এমন পর্যায়ে গিয়েছিল, কার নির্দেশে এসব হত্যাকাণ্ড হয়েছিল, এগুলো এখন খুঁজে বের করা দরকার। একই পদ্ধতিতে একই মাত্রায় এভাবে মানুষ হত্যার ‘গায়েবি নির্দেশ’ কোথা থেকে এসেছে, সেটি যদি বের করা যায়, তাহলে বোঝা যাবে সর্বোচ্চ নির্দেশদাতা কে বা কারা ছিল। এখন এই হত্যাকাণ্ডগুলোর বিচার যেন স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য করাটাও চ্যালেঞ্জ।

‘জুলাই অভ্যুত্থান: প্রমাণ ও নৃশংসতা’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল
ছবি: আশরাফুল আলম

জুলাই-আগস্টে দেশে কত মানুষ হত্যার শিকার হয়েছেন, কত মানুষ আহত হয়েছেন, সেই তালিকা করতে না পারাটা লজ্জাজনক উল্লেখ করেন আলোকচিত্রী শহিদুল আলম। তিনি বলেন, যাঁরা এই তালিকা প্রণয়নের কাজ করছেন, তাঁদের আন্তরিকতায় প্রশ্ন নেই, তবে দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। যাঁরা এই কাজটা করতে পারবেন তাঁদের দায়িত্ব দেওয়া উচিত এবং সেই দায়িত্ব পালনে বাধ্য করা উচিত।

জুলাই-আগস্টের হত্যাকাণ্ড আওয়ামী লীগের ইতিহাসে কলঙ্কজনক অধ্যায় এবং এটা তাদের গ্রহণ করতে হবে উল্লেখ করে শহিদুল আলম বলেন, জামায়াতে ইসলামী কোনোকালেই ’৭১–এর ভূমিকা অস্বীকার করতে পারবে না। তেমনি জুলাই-আগস্টের ঘটনা আওয়ামী লীগের আজীবনের একটা কলঙ্ক হয়ে থেকে যাবে।

অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন টেক গ্লোবাল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক সাবহানাজ রশিদ। অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে বক্তব্য দেন ট্রুথ অ্যান্ড জাস্টিস প্রজেক্টের পরিচালক ফ্রান্সিস হ্যারিসন এবং সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান।

ছোট ভাইয়ের লাশ ফিরে পেতে চান জেসমিন

অনুষ্ঠানে পুলিশের নৃশংসতার যে দুটি প্রামাণ্য চিত্র তুলে ধরা হয়, তার একটি ৫ আগস্ট গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে পুলিশের গুলিতে নিহত মোহাম্মদ হৃদয়কে নিয়ে। প্রামাণ্য চিত্রে দেখা যায়, পুলিশ সদস্যরা হৃদয়কে ধরে এনে খুব কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করেন। তাঁর নিথর দেহ ফেলে প্রথমে তাঁরা চলে যান। কিছুক্ষণ পর এসে তাঁরা হৃদয়ের দেহ টেনে নিয়ে যান। তবে হৃদয়ের লাশের সন্ধান এখন পর্যন্ত তাঁর পরিবার পায়নি। তিনি পেশায় অটোরিকশাচালক ছিলেন।

অনুষ্ঠানে হৃদয়ের বোন জেসমিন আক্তার বলেন, ‘সবাই দেখেছেন হৃদয়কে কী নির্মমভাবে মারা হয়েছে। ভাইয়ের লাশটাও আমরা পেলাম না। এখন ভাইয়ের লাশটা অন্তত খুঁজে পেতে চাই। যারা আমার ভাইকে হত্যা করল, লাশ গুম করল, তাদের বিচার চাই।’