ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষক হেনস্তার নিন্দা ও তিন দাবি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সমাজসেবা সম্পাদক যুবাইর বিন নেছারীর (এ বি জুবায়ের) নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক আ ক ম জামাল উদ্দীন ও আজমল হোসেনের ওপর হামলা–হেনস্তার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক। পাশাপাশি শিক্ষক নেটওয়ার্কের পক্ষ থেকে তিনটি দাবি জানানো হয়েছে।
আজ শনিবার এক বিবৃতিতে শিক্ষক নেটওয়ার্ক বলেছে, যেকোনো অভিযোগে, তা যত গুরুতরই হোক না কেন, আরেকজন সহনাগরিকের গায়ে হাত তোলার অধিকার কোনো সহনাগরিকের নেই। কোনো শিক্ষার্থীর বা শিক্ষকের অধিকার নেই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে একে অন্যকে হামলা করার, লাঞ্ছিত করার। কোনো যুক্তিতেই এটা গ্রহণযোগ্য নয়। এই গুন্ডামি বন্ধ করতে হবে।
এর আগে বৃহস্পতিবার এ হেনস্তার ঘটনার পর এ বি জুবায়ের এক ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ পাঁচজন শিক্ষক ক্যাম্পাসে গোপন বৈঠকে যুক্ত হয়েছিলেন। খবর পেয়ে তাঁদের পাকড়াও করে পুলিশে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন তাঁরা। তবে আগে থেকে প্রস্তুত করে রাখা গাড়িতে তাঁরা পালিয়ে গেছেন।
এ ঘটনার নিন্দা জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক তিনটি দাবি জানায়। প্রথমটি হচ্ছে, অধ্যাপক জামাল উদ্দীনসহ যেসব শিক্ষকের বিরুদ্ধে জুলাই অভ্যুত্থানে শিক্ষার্থীদের নিপীড়নের হুমকি, আদেশ-নির্দেশ দেওয়ার বা প্রকাশ্যে সমর্থন দেওয়ার অভিযোগ আছে, তাদের সবার বিরুদ্ধে যথাযথ তদন্ত করে দ্রুত প্রশাসনিক ও আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, কালক্ষেপণ না করে চব্বিশের ৫ আগস্টের পর থেকে ক্যাম্পাসে সংঘঠিত সব নিপীড়নের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার করতে হবে। আর তৃতীয়টি হচ্ছে, এ বি জুবায়েরসহ শিক্ষক হেনস্তায় জড়িত সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
দুই শিক্ষকই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আওয়ামীপন্থী শিক্ষক উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়, ‘এর মধ্যে জামাল উদ্দীন বিতর্কিত একজন মানুষ। অধ্যাপক জামালের ব্যাপারে দেশবাসী কিছুটা জানেন, আমরা বহু কিছু জানি। তিনি “মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ” গঠন করে ছাত্রদের দিয়ে গুন্ডামি করাতেন।...জুলাই আন্দোলনেও তাঁর ভূমিকা ছিল ভয়াবহ দমন ও নিপীড়নমূলক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এবং সরাসরি তিনি হত্যাকাণ্ডের মতো ফৌজদারি অপরাধে উসকানি দিয়েছেন। এত সব প্রমাণসহ সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা তাঁর বিরুদ্ধে সত্যানুসন্ধান কমিটির কাছে অভিযোগ জমা দিয়েছেন।’
এত সব প্রমাণ থাকার পরও ২০২৪ সালের অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত জামাল উদ্দীনের বিষয়ে অভিযোগ তদন্তের কোনো অগ্রগতি নেই উল্লেখ করে বিবৃতিতে আরও বলা হয়, অভিযোগ যেহেতু তদন্তাধীন, কাজেই বিচার হতে হবে আইনি প্রক্রিয়ায়। তাঁর বিরুদ্ধে যদি কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা নিতে হয়, তবে সেই দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের। আর যদি আইনগত ব্যবস্থা নিতে হয়, তবে সেই দায়িত্ব বাংলাদেশ পুলিশের। শিক্ষার্থীদের বা তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নয়।
‘ছাত্রলীগের কথা মনে করিয়ে দেয়’
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক বলেছে, ‘অভ্যুত্থানের দেড় বছর পর ছাত্ররা দল বেঁধে শিক্ষককে আক্রমণ করছে, ধাওয়া করছে, গায়ের জামা ছিনিয়ে নিচ্ছে—এগুলো সম্পূর্ণ বেআইনি আচরণ। যখন দেখি এতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ডাকসুর এক নির্বাচিত প্রতিনিধি, এটা আরও দুর্ভাগ্যজনক। সাধারণ মানুষের মবের মতো আচরণ আর নির্বাচিত প্রতিনিধির মব বনে যাওয়া ও আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া—এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য আছে। দুটোই বেআইনি, কিন্তু মাত্রাগত পার্থক্য আছে।’
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘ডাকসুর পদবিকে ব্যবহার করে দাপট দেখানো চলবে না। একই ডাকসু নেতাকে এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারারের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক আচরণ করতে দেখেছি, যা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছিল। প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখিনি, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনো শিক্ষকের জন্য অসম্মানজনক ও মানহানিকর। প্রশাসনের নীরব সমর্থন ডাকসু প্রতিনিধি এ বি জুবায়েরকে আরও বেপরোয়া করে তুলেছে।’
এ বি জুবায়েরের ভাষা ও শারীরিক অঙ্গভঙ্গি ছাত্রলীগের কথা মনে করিয়ে দেয় উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়, ‘দেখেছি যে হলগুলোতে প্রশাসন নয়, বরং ছাত্রলীগ একই কায়দায় কাউকে কাউকে “অমুকে শিবির” বলে মেরে-ধরে ফোন চেক (তল্লাশি) করে থানায় দিত; “অমুক জায়গায় শিবির গোপনে মিটিং করছে” দাবি করে পিটিয়ে পুলিশে দিত।’
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক বলেছে, ‘এত বড় ফ্যাসিস্ট হটিয়ে পাওয়া ক্যাম্পাসে একজন নির্বাচিত শিক্ষার্থী একই রকমভাবে ভিন্নমতের শিক্ষককে হামলা ও হেনস্তা করছেন, যা আমাদের ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা ও গণতান্ত্রিক চর্চার পরিবেশের বিরুদ্ধে বিশাল আঘাত।’
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যদি এ বি জুবায়েরের এই গুন্ডামির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়, তবে তারা তাদের মেরুদণ্ডহীনতা ও জুবায়েরের অপরাধের রক্ষক বলে নিজেদের প্রমাণ করবে।