অ্যাপে নয়, রাইড শেয়ারিংয়ে মোটরসাইকেল চলছে চুক্তিতে

ঢাকার মোড়ে মোড়ে এখন মোটরসাইকেল নিয়ে যাত্রীর অপেক্ষায় বসে থাকেন চালকেরা। শ্যামলী, ঢাকা ২৫ মে
ছবি: সৈয়দ জাকির হোসেন

ব্যস্ত রাস্তার কোনো মোড়ে দাঁড়ালেই শোনা যায়, ‘কই যাবেন? ‘বাইক লাগবে?’ যাঁর প্রয়োজন, তিনি দরদাম করে বাইকচালকের পেছনে সওয়ার হন। যাঁর দরদামে পোষায় না, তিনি আরেক বাইকের দিকে এগিয়ে যান। কিন্তু বিষয়টি এমন হওয়ার কথা ছিল না। অ্যাপে রাইড শেয়ারিংয়ের জন্য ডাকলে মোটরসাইকেল হাজির হবে নির্দিষ্ট জায়গায়, সেটাই নিয়ম। কিন্তু সেই নিয়ম আর এখন খাটছে না। অ্যাপের মোটরসাইকেল এখন চুক্তির বাহনে পরিণত হয়েছে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে বসে থাকে তারা। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, যাতায়াতের ক্ষেত্রে যে সেবা শহরের মানুষকে কিছুটা স্বস্তি দিয়েছিল, তা এখন নেই।

দেশে ২০১৬ সালে রাইড শেয়ারিং সেবা চালু হয়। এতে প্রাইভেট কার, মোটরসাইকেল ও সিএনজিচালিত অটোরিকশা সেবা পাওয়া যায়। ২০১৭ সালে সরকার এ-সংক্রান্ত একটি নীতিমালা করে। পরের বছর তা পাস হয়। রাইড শেয়ারিং সেবা চালু অনেকের জন্যই আশীর্বাদ হয়ে আসে। এর ফলে নতুন কর্মসংস্থানেরও সুযোগ সৃষ্টি হয়। অ্যাপে ডাকলে নির্দিষ্ট জায়গায় এসে যায় বাহন, পৌঁছে দেয় নির্দিষ্ট গন্তব্যে।

শুরুতে কয়েক বছর নিয়মমাফিক চললেও পরে মোটরসাইকেলচালকদের মধ্যে চুক্তিতে চলাচলে বেশি আগ্রহ দেখা যায়। এ বিষয়ে চালকদের ভাষ্য, অ্যাপ সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানকে ২৫ শতাংশ কমিশন দিতে হয়, এটা অনেক বেশি। এ ছাড়া যাত্রীকে তোলার জন্য কোনো গন্তব্যে যেতে হয় না, যাত্রীরাই তাঁদের কাছে আসেন।

অন্যদিকে যাত্রীরা বলছেন, অ্যাপে সব সময় মোটরসাইকেল পাওয়া যায় না। তাই চালকদের শর্তানুযায়ী যেতে বাধ্য হতে হয়। শুরুতে দামাদামি করে কিছুটা কম ভাড়ায় যাওয়া যেত। এখন চালকেরা অনেকটা সিন্ডিকেটের মতো ভাড়া ঠিক করেছেন, সেই ভাড়াতেই যেতে হয়।

দেশে ২০১৬ সালে রাইড শেয়ারিং সেবা চালু হয়। এতে গাড়ি, মোটরসাইকেল ও সিএনজিচালিত অটোরিকশা সেবা পাওয়া যায়। ২০১৭ সালে সরকার এ-সংক্রান্ত একটি নীতিমালা করে। পরের বছর তা পাস হয়।

সম্প্রতি রাজধানীর কারওয়ান বাজারের সার্ক ফোয়ারা মোড়ে কথা হয় মো. মামুন নামের এক মোটরসাইকেলচালকের সঙ্গে। দুই বছর ধরে তিনি রাইড শেয়ারিংয়ে আছেন। প্রথম ছয় মাস অ্যাপে চালালেও এর পর থেকে চুক্তিতে চালাচ্ছেন। কারণ হিসেবে বলেন, ‘অ্যাপে পোষায় না। আমার বাইক খাটে, আমি খাটি, সেখানে আরেকজনকে পয়সা কেন দেব? আর যাত্রীর তো আপত্তি নাই।’ মামুনের দাবি, অ্যাপে কমিশন বেশি। দিন শেষে আয় বেশি থাকে না।

কলাবাগান বাসস্ট্যান্ডে সোলায়মান মিয়া নামের আরেক মোটরসাইকেলচালকের সঙ্গে কথা হয়। তিনিও অ্যাপে চলেন না। কারণ হিসেবে জানান, যাত্রী কল দিয়ে অনেক সময় দেরি করিয়ে রাখেন। যে গন্তব্য থেকে যাত্রীকে তুলতে হয়, সেখানে যেতেও ঝামেলা মনে হয়।

অ্যাপে পোষায় না। আমার বাইক খাটে, আমি খাটি, সেখানে আরেকজনকে পয়সা কেন দেব। আর যাত্রীর তো আপত্তি নাই।’ মামুনের দাবি, অ্যাপে কমিশন বেশি। দিন শেষে আয় বেশি থাকে না।
মো. মামুন, মোটরসাইকেলচালক

বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে রাইড শেয়ারিং সার্ভিস পাঠাওয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ফাহিম আহমেদ লিখিতভাবে বলেন, পাঠাও রাইডার ও যাত্রী উভয় পক্ষকেই সেফটি কাভারেজসহ বিভিন্ন সুবিধা দেয়। ভাড়া ও কমিশন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা জ্বালানির দামের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে গত আগস্টে আমাদের ভাড়া সমন্বয় করেছি এবং বাজারে সর্বনিম্ন কমিশন হার (১৫%) চার্জ করেছি। আমাদের রাইডার পার্টনারদের উপার্জন নিশ্চিত করতেই আমরা এ উদ্যোগ নিয়েছি, যেন তারা আমাদের অ্যাপে রাইড শেয়ারিংয়ের মাধ্যমে আরও সুবিধা পায় এবং রাইড গ্রহণকারী গ্রাহকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।’

একই বিষয়ে জানতে উবারকে ই-মেইলে প্রশ্ন পাঠানো হয়। জবাবে উবার বলেছে, নিরাপদ, নির্ভরযোগ্য এবং সাশ্রয়ী মূল্যের সেবা দিতে তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কমিশন প্রসঙ্গে উবার বলেছে, তাদের কমিশন চালক ও যাত্রীকে সর্বোচ্চ সেবা দিতে যে পুনর্বিনিয়োগ করা হয়, তার প্রয়োজনেই নির্ধারিত। তবে কত পরিমাণে কমিশন তারা নিয়ে থাকে, তা জানায়নি উবার।

অ্যাপে না চলে চুক্তিতে চলাচল করলে চালক ও যাত্রী উভয়কেই জরিমানা করার বিধান আছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এ বিষয়ে পুলিশ এবং বিআরটিএ ম্যাজিস্ট্রেটদের নির্দেশনা দেওয়া আছে। তবে চালকেরা কেন চুক্তিতে যাচ্ছেন, সে বিষয়গুলো সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর পর্যবেক্ষণ করা উচিত। পাশাপাশি কমিশন কত হবে, সেটাও নিজেরা মিলে ঠিক করতে হবে।

কমিশন প্রসঙ্গে উবার বলেছে, তাদের কমিশন চালক ও যাত্রীকে সর্বোচ্চ সেবা দিতে যে পুনর্বিনিয়োগ করা হয়, তার প্রয়োজনেই নির্ধারিত।

অ্যাপে না চলে চুক্তিতে চলাচল করলে যাত্রী ও চালক উভয়ের জন্যই নিরাপত্তাঝুঁকি রয়েছে। চুক্তিতে চলাচলকারী মোটরসাইকেলে ছিনতাই, হয়রানি থেকে শুরু করে খুনের ঘটনাও ঘটেছে। তবে এটাকে খুব বেশি আমলে নিচ্ছেন না মোটরসাইকেলচালকেরা। বাবু নামের এক চালক বলেন, দু-একটি ঘটনা দিয়ে সব বিচার করা ঠিক নয়। অ্যাপে না চালানো প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘অনেক দূর থেকে কল আসে। আমি কারওয়ান বাজার, কিন্তু কল আসে শাহবাগ থেকে। ওই যাত্রীকে তুলতে আমাকে ফার্মগেট ঘুরে শাহবাগ যেতে হবে। এই পথ পাড়ি দেওয়ার জন্য অ্যাপ আমাকে টাকা দেবে না।’

রাইড শেয়ারিংয়ে মোটরসাইকেলে চড়ার ক্ষেত্রে যাত্রীরাও এখন বাধ্য হয়ে চুক্তিতে অনেকটা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। মো. শিহাবুল হাসান ধানমন্ডি থেকে মিরপুরে অফিসে যাতায়াত করেন। প্রায় সময়েই তিনি মোটরসাইকেলে চড়েন। শিহাবুল বলেন, ‘শুরুর দিকে অ্যাপে মোটরসাইকেল পাওয়া গেলেও এখন তেমন পাওয়া যায় না। এখন মোড়ে মোড়ে রিকশার মতো মোটরসাইকেল দাঁড়িয়ে থাকে। একই দূরত্বে প্রায় সবাই একই ধরনের ভাড়া চায়। এ কারণে আমরা তাদের কাছে অনেকটাই জিম্মি।’

তবে নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন দেখা গেল নারী যাত্রীদের। বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মী আফরিন সুলতানা কলাবাগান থেকে বনানী গিয়ে অফিস করেন। যাওয়ার সময় বাস পেলেও ফেরার সময় বাস পেতে তাঁর ঝামেলা হয়। তাই মাঝেমধ্যে মোটরসাইকেলে চড়েন। আফরিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘সন্ধ্যার সময় অ্যাপে মোটরসাইকেল পাওয়াই যায় না। কিন্তু রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ালে প্রচুর মোটরসাইকেল দেখা যায়। বাধ্য হয়ে তাতে উঠতে হয়। মনে ভয় নিয়েই চলি। বাসায় তো ফিরতে হবে।’

যাত্রীর সঙ্গে চলে দরদাম। শ্যামলী, ঢাকা ২৫ মে
ছবি: সৈয়দ জাকির হোসেন

নিরাপত্তাঝুঁকির কথা উল্লেখ করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মো. মুনিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, অ্যাপে না চললে যাত্রী ও চালক কেউই এতে নিরাপদ নন। অ্যাপে চলা যাত্রীদের কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে যতটা সহজে অপরাধী খুঁজে পাওয়া যায়, এর অন্যথা হলে অপরাধীকে ধরা কঠিন পড়ে পড়ে। চুক্তিতে চলাচলের জন্য ট্রাফিক পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয় কি না, তা জানতে চাইলে মুনিবুর রহমান বলেন, এই রাইড শেয়ারিং সেবায় অ্যাপে না চললে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে, সে-সংক্রান্ত কোনো নীতি নেই। যার কারণে পুলিশও কোনো ধারায় শাস্তি দিতে পারে না।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও যোগাযোগবিশেষজ্ঞ এম সামছুল হক প্রথম আলোকে বলেন, রাইড শেয়ারিং পুরো বিশ্বে সফল হলেও দেশে এসে তা জঞ্জালে পরিণত হয়েছে। এই সেবাগুলোর ফাঁকফোকর ধরার জন্য দক্ষ ও স্মার্ট জনবল প্রয়োজন। রাইড শেয়ারিংকে দেখার জন্য সেটা নেই। সড়কে অব্যবস্থাপনা, দক্ষ লোক ও যথাযথ পর্যবেক্ষণের অভাবে তা সফল হচ্ছে না। সড়ক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত সব পক্ষকে সমন্বয় করে বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে এর সমাধান করার কথা বলেন এই অধ্যাপক।