‘কোনো কথা নাই, খালি কোপাইছে’

রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল) চিকিৎসাধীন আবু সুফিয়ান। ছেলের পাশে মা সুফিয়া বেগম। গতকাল দুপুরেছবি: প্রথম আলো

‘কোনো কথা নাই, খালি কোপাইছে। কারেন্টের খাম্বার সাথে দুইজন বাইন্ধ্যা কুপাইছে। আমি বলছি, “আমাকে মারিও না, কাটিও না”, তা–ও আমার কথা শুনল না।’

হাসপাতালে কাতরাতে কাতরাতে কথাগুলো বলছিলেন আবু সুফিয়ান। তিনি রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল) চিকিৎসাধীন। গত বুধবার চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে আবু সুফিয়ানকে বিদ্যুতের খুঁটির সঙ্গে বেঁধে কুপিয়ে গুরুতর জখম করা হয়।

পরিবারের দাবি, তাঁদের স্বজন এক কিশোরীকে উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করতে গেলে উত্ত্যক্তকারী যুবকের পক্ষ নিয়ে সুফিয়ানকে মারধর ও কোপানো হয়। সুফিয়ানের দাবি, তিনি বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। যাঁরা তাঁকে মেরেছেন, তাঁরা জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।

ঘটনার পর বৃহস্পতিবার রাতে সুফিয়ানের বাবা রবিউল ইসলাম শিবগঞ্জ থানায় মামলা করেন। পরে অভিযান চালিয়ে দুজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। আদালত তাঁদের কারাগারে পাঠিয়েছেন। গ্রেপ্তার দুজন হলেন শাহ আলম (২২) ও তাঁর ভাই আবদুর রাজ্জাক (২৩)। তাঁরা দুজন জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তবে স্থানীয় জামায়াত নেতারা বলছেন, কে বা কারা রাতের আঁধারে এ ঘটনা ঘটিয়ে জামায়াতের ওপর দোষ চাপাচ্ছে।

পঙ্গু হাসপাতালে গতকাল গিয়ে দেখা যায়, আবু সুফিয়ানের শরীরের বিভিন্ন জায়গায় জখম ব্যান্ডেজ করা এবং মারধরের চিহ্ন। বাঁ হাতে কোপানোর পর ঝুলে ছিল। চিকিৎসকেরা বলছেন, হাতটির কনুইয়ের নিচ থেকে কেটে ফেলতে হতে পারে। সুফিয়ানের বাঁ পা ও হাত এবং ডান হাত ব্যান্ডেজে মোড়ানো। ডান হাতে অস্ত্রোপচারের পর ইস্পাতের ‘এক্সটার্নাল ফিক্সেটর’ লাগানো।

যাঁরা মেরেছেন, তাঁদের মধ্যে একজনকে ‘স্যার’ ডাকেন জানিয়ে আবু সুফিয়ান প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোনো কথা ছাড়াই ৭ থেকে ৮ জন মিলে মারতে লেগেছে। একজনকে স্যার মানি। বলি, “স্যার, আমাকে কিসের লাগি মারছেন? আমার অপরাধটা কী?”’

আবু সুফিয়ান বলেন, যাঁরা তাঁকে মারছিলেন, তাঁদের বারবার বলছিলেন, তিনি যে কোনো অপরাধ করেননি, তার প্রমাণ দিতে চান। কিন্তু কেউ কোনো কথা শুনতেই চাননি। প্রথম ৭ থেকে ৮ জন মিলে মারলেও পরে দুজন আবু সুফিয়ানকে কোপাতে থাকেন। অন্যরা তখন দাঁড়িয়ে ছিলেন। আশপাশের দোকানদারেরা তাঁকে মারধর করার সময় দোকান বন্ধ করে চলে যান।

আবু সুফিয়ান আরও বলেন, তাঁকে কোপানোর পর এক পর্যায়ে হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দেওয়া হয়। তখন তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। পরে তাঁর বাবা-মা গিয়ে তাঁকে উদ্ধার করেন। তিনি বলেন, ‘এখন ডাক্তাররা বলছেন, আমার হাত নষ্ট হয়ে গেছে। রক্তনালি কেটে গেছে। বাঁ হাত চলবে না। কেটে ফেলতে হবে।’

আবু সুফিয়ান এসএসসি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। তাঁর দাবি, তিনি কৃষি ও অন্যান্য কাজে তাঁর বাবাকে সহায়তা করেন। তাঁর বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার বাজিতপুর গ্রামে। গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁকে স্থানীয় হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে ২৫ ডিসেম্বর সকালে ঢাকায় আনা হয়।

শিবগঞ্জ থানার এসআই এ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা গোপাল চন্দ্র মণ্ডল গতকাল টেলিফোনে প্রথম আলোকে বলেন, আবু সুফিয়ানের বাবা রবিউল ইসলাম বাদী হয়ে তিনজনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতনামা ১২ থেকে ১৫ জনকে আসামি করে মামলা করেছেন। আবদুর রাজ্জাক ও শাহ আলমকে গ্রেপ্তারের পর কারাগারে পাঠানো হয়েছে। মামলার আরেক আসামি বদিউর পলাতক আছেন। আবদুর রাজ্জাক একটি মাদ্রাসার শিক্ষক।

আবু সুফিয়ানের মা সুফিয়া বেগম চোখের সামনে ছেলের এ অবস্থা দেখে দিশাহারা হয়ে পড়েছেন। তিনি বলেন, ‘বিনা দোষে, বিনা কারণে কেন ছেলেকে কাটল? তার কি কোনো বিচার নেই? দেশে কি কোনো আইন–আদালত নেই?’