ফেসবুকে বাংলাদেশের দুই দলের লড়াই

  • আওয়ামী লীগ ২০১৩ সাল ও বিএনপি ২০১৯ সালে অফিশিয়াল, ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ চালু করে।

  • বাংলাদেশে বেশি ব্যবহৃত হয় ফেসবুক, এরপর টিকটক ও ইউটিউব।

  • নির্বাচনের আগে আগে ফেসবুক পেজ সবচেয়ে বেশি তৈরি হয়।

  • ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’ পেজের অনুসারী ৩৪ লাখ, বিএনপির মিডিয়া সেলের ২৫ লাখ।

  • এক বছর আওয়ামী লীগের চেয়ে বিএনপির পেজের পোস্টের সংখ্যা বেশি।

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, বিশেষ করে ফেসবুকে ব্যাপকভাবে সক্রিয়। জনমত প্রভাবিত করে নিজেদের পক্ষে টানতে দুই দলই নিজেদের কনটেন্ট ফেসবুকে ছড়িয়ে দিচ্ছে। প্রোফাইল, গ্রুপ ও নানা পেজ সমন্বয়ের মাধ্যমে তারা ফেসবুক ব্যবহারকারীদের কাছে পৌঁছার চেষ্টা করছে।

তবে ফেসবুকে অনুসারী আর কৌশলের দিক থেকে বিএনপির চেয়ে আওয়ামী লীগ বেশ এগিয়ে। তারা কনটেন্ট কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করে পরে তা বিভিন্ন গ্রুপ, প্রোফাইল ও পেজে ছড়িয়ে দেয়।

গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে মাসে ৪ কোটি ৪০ লাখের বেশি মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করেন। গবেষকেরা প্রায় পাঁচ লাখ ফেসবুক পোস্ট সংগ্রহ করেন। এসব পোস্টের অনুসারী ছিলেন ১ কোটি ৪৪ লাখ ব্যবহারকারী। পোস্টে এনগেজমেন্টের পরিমাণ ছিল ৯ কোটি ৭৫ লাখ। গবেষকেরা আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ৬০০টির বেশি ফেসবুক পেজ ও গ্রুপ যাচাই করেন। তাঁরা গভীরভাবে বিশ্লেষণের জন্য এমন সব পেজ ও গ্রুপ বাছাই করা হয়েছিল, যেগুলোর ন্যূনতম ৫০০ অনুসারী আছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি তাদের বার্তা ছড়িয়ে দিতে আন্তসংযুক্ত নেটওয়ার্কগুলোকে কাজে লাগায়।

বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে প্রধান দুই রাজনৈতিক দল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুকে ব্যাপকভাবে সক্রিয়। জনমতকে নিজেদের পক্ষে টানতে ফেসবুকে আধেয়র লড়াইয়ে নেমেছে দুই দল। স্বাধীন গবেষণা প্রতিষ্ঠান টেক গ্লোবাল ইনস্টিটিউটের এক বিশ্লেষণে এমনটা উঠে এসেছে। ১০ গবেষক দুই দলের নানা তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করেছেন। সম্প্রতি এটি ইনফোল্যাব ডট টেকগ্লোবালইনস্টিটিউট ডটকম-এ প্রকাশিত হয়েছে।

বিএনপির আগে ফেসবুকে আওয়ামী লীগ

বাংলাদেশে গণ-আন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালে সামরিক শাসনের অবসানের পর থেকে রাজনীতিতে আধিপত্য ধরে রেখেছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। ২০০৭ সাল পর্যন্ত এক দল ক্ষমতায় থাকলে আরেক দল বিরোধী দলে ছিল। রাজনৈতিক সহিংসতার জেরে ২০০৭ সালে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসে। তাদের অধীনে নির্বাচনে ২০০৯ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। তখন থেকে দলটি টানা ক্ষমতায় রয়েছে।

বিরোধী দল বিএনপি নানা প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করছে। তাদের অনেক শীর্ষ নেতা অসুস্থ, নির্বাসিত বা কারারুদ্ধ। দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিএনপির প্রায় ৫০ লাখ নেতা-কর্মীর প্রায় অর্ধেকই অসংখ্য মামলায় জর্জরিত।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ ২০১৪ ও ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচন ঘিরে বিতর্ক রয়েছে।

সাম্প্রতিক হিসাব বলছে, বাংলাদেশের ১০ কোটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর একটা বড় অংশ সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে। সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে ফেসবুক। এরপরে রয়েছে টিকটক ও ইউটিউব। দুই প্রধান দল কয়েক বছর ধরে এই বিশাল ব্যবহারকারীর কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে।

বিএনপি ২০১৯ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে অফিশিয়াল, ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ চালু করে। আওয়ামী লীগ চালু করে ২০১৩ সালে। সামাজিক মাধ্যমে ইতিমধ্যে বিএনপির বড় উপস্থিতি চোখে পড়ছে।

বিএনপির চেয়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা অত্যাধুনিক উপায়-উপকরণ পাচ্ছেন। ২০২১ সালে দলটি ১ লাখ ‘সাইবার যোদ্ধাকে’ প্রশিক্ষণের লক্ষ্য স্থির করেছিল। এবার নির্বাচনে দলটির প্রচার দল ২ কোটি সক্রিয় ফেসবুক ব্যবহারকারীর কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে।

গবেষকেরা আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বিভিন্ন নামে থাকা মোট ৬৬০টি পেজ ও গ্রুপ বিশ্লেষণ করে কনটেন্টের আচরণ, সম্পৃক্ততা ও ধরন বোঝার চেষ্টা করেছেন।

দুই দলের পেজ, গ্রুপ

গবেষকেরা দেখেছেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি-সম্পর্কিত নতুন পেজ তৈরি বেড়েছে নির্বাচনের আগে ২০১৩ ও ২০১৪ সালে। ওই সময়টা রাজনৈতিকভাবে বেশ উত্তাল ছিল।

মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত ব্যক্তিদের মৃত্যুদণ্ডের দাবিতে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে শাহবাগ আন্দোলন ঘিরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই মেরুতে অবস্থান নেয়। পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবিতে আলাদা আন্দোলন হয়।

২০১৩-২০১৪ সময়ে রাজনৈতিক দলভিত্তিক তীব্র অনলাইন–যুদ্ধ হয়। এটাই সম্ভবত দুই পক্ষের ফেসবুক পেজ বাড়াতে ভূমিকা রেখেছিল। ২০১৭ ও ২০২২ সালে বিএনপিপন্থী পেজ তৈরি উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ে। দেখা যাচ্ছে, নির্বাচনের আগে পেজ তৈরি বাড়ে। আওয়ামী লীগপন্থী পেজ তৈরিতে বড় উল্লম্ফন দেখা যায় ২০২০ সালে।

আরও পড়ুন

প্রতিবেদনে বলা হয়, গবেষকেরা দৈবচয়নের ভিত্তিতে প্রতিটি দলের নাম থাকা শীর্ষ ২৬০টি করে পেজ ও ৭০টি করে গ্রুপ থেকে তথ্য-উপাত্ত নেন। এ ক্ষেত্রে ২০২২ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে ২০২৩ সালের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত সক্রিয় পেজ ও গ্রুপগুলো তাঁরা বিবেচনায় নেন। গবেষণার সময়কালে প্রতি মাসে অন্তত একটি কনটেন্ট শেয়ার করা হয়েছে, এমন পেজকে ‘সক্রিয়’ ধরা হয়েছে।

গবেষকেরা অনুসারীর সংখ্যা ও সর্বোচ্চ সক্রিয়তা বিবেচনায় নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শীর্ষ ২০টি করে পেজের কার্যক্রম ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। তাঁরা দেখেন, এক বছরে দলের নাম দিয়ে ১৩৫টি সক্রিয় পেজ থাকলেও আওয়ামী লীগের মাত্র দুটি পেজ বেশি তৎপর ছিল। এই দুটি পেজ থেকেই দলটির বেশির ভাগ কনটেন্ট প্রচার করা হয়। পেজ দুটি হচ্ছে ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’ ও ‘বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ’।

‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’ পেজের অনুসারী ৩৪ লাখ। বিশ্লেষণের সময়কালে পেজটি প্রায় ৯ হাজার ৫০০ কনটেন্ট (তৃতীয় পক্ষের লিংক ছাড়া) শেয়ার করে। আওয়ামী লীগ প্রতিদিন প্রতি ঘণ্টায় কনটেন্ট শেয়ার করেছে। গত বছর প্রতিদিন প্রতি ২৪ ঘণ্টায় পেজটি কমপক্ষে ২৫টি কনটেন্ট শেয়ার করেছে।

একইভাবে ১৫৮টি সক্রিয় পেজ থাকা সত্ত্বেও বিএনপি বেশির ভাগ কনটেন্ট ‘বিএনপি মিডিয়া সেল’ ও ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি’—এই দুটি পেজ বেশি ব্যবহার করা হয়েছে।

‘বিএনপি মিডিয়া সেল’ পেজের অনুসারী ২৫ লাখ। এটি গত বছর আওয়ামী লীগের অফিশিয়াল পেজের দ্বিগুণের বেশি, প্রায় ২০ হাজার পোস্ট শেয়ার করেছে।

প্রচারের কৌশল

রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের বার্তা প্রচারে পেজ, গ্রুপ ও ভেরিফায়েড প্রোফাইলের জটিল এক ওয়েব ব্যবহার করে। প্রাথমিকভাবে দলের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ঘিরে কমিউনিটি তৈরি ও সংগঠিত করতে গ্রুপগুলো ব্যবহৃত হয়। একই সময় তারা অন্যান্য গ্রুপ, পেজ, প্রোফাইলে কনটেন্ট ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ করে।

দুই দলের ক্ষেত্রে ছবি সবচেয়ে সাধারণ পোস্ট। এরপর আছে ফেসবুকে সরাসরি আপলোড করা ভিডিও। অ্যাকাউন্ট অ্যাডমিন ও ফেসবুক ব্যবহারকারীদের মধ্যে কম সাক্ষরতার হারের সম্ভাব্য প্রবণতার কারণে লেখার বিপরীতে ছবি ও ভিডিও শেয়ারের ওপর নির্ভরতা বেশি থাকতে পারে।

ছবি ও ছোট ভিডিওর কনটেন্টের মন্তব্যে প্রায়ই স্টিকার ও জিআইএফ ব্যবহার করতে দেখা যায়। হতে পারে, এগুলো দ্রুত ব্যবহারকারীদের আকৃষ্ট করে। ধারণা করা হয়, এগুলো কনটেন্টকে ফেসবুকের নিউজফিডে বেশি ছড়িয়ে দেয়।

গত কয়েক বছরে ফেসবুকের মূল সংস্থা মেটা রিল ও স্টোরিজের মতো বিষয়কে অগ্রাধিকার দিচ্ছে।

গবেষকেরা দেখেছেন, আওয়ামী লীগের পেজগুলোতে ছবির ব্যবহার বেশি। আওয়ামী লীগের পেজগুলোতে মোট শেয়ার করা কনটেন্টের ৬৩ দশমিক ৭৫ শতাংশই ছবি। বিএনপির পেজগুলোতে তা ৪৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ।

বিএনপির পেজ ও গ্রুপগুলোতে নেটিভ ভিডিওর ব্যবহার বেশি। হতে পারে বিএনপির সমর্থকেরা মনে করেন, দেশের মূলধারার টেলিভিশন চ্যানেলগুলো তাঁদের অনুষ্ঠান পর্যাপ্ত বা ন্যায্যভাবে প্রচার করে না। ফলে তাদের কার্যক্রম প্রচারের একটি বিকল্প প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ফেসবুক জনপ্রিয় হয়েছে।

সংবাদ বা নিবন্ধের মতো বিষয়ের লিংক আওয়ামী লীগের পেজ ও গ্রুপগুলোতে বেশি শেয়ার করা হয়। বিএনপির পেজ ও গ্রুপগুলো আওয়ামী লীগের চেয়ে বেশি ঘন ঘন লাইভ ভিডিও ব্যবহার করে।

পেজ, গ্রুপের আচরণ

নির্বাচনী উত্তেজনার মধ্যে ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’ ও ‘বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ’ পেজ ছাড়াও ‘বাংলাদেশ আওয়ামী ওলামা লীগ’ ও ‘আওয়ামী লীগ মিডিয়া সেল’ পেজও সক্রিয় দেখা যাচ্ছে। এই দুটি পেজেও উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি পোস্ট দেওয়া হয়েছে।

সম্পৃক্ততার (এনগেজমেন্ট) দিক থেকে ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’ দলের অন্যান্য পেজের চেয়ে এগিয়ে। এই পেজে এক বছরে পোস্টগুলোতে ৬৬ লাখ ‘লাইক’ পড়েছে। মন্তব্য ও শেয়ারের ক্ষেত্রেও প্রাধান্য বজায় রেখেছে পেজটি। এক বছরে ‘বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ’ পেজের পোস্টগুলোতে ‘লাইক’ পড়েছে ১১ লাখ। আওয়ামী লীগের পক্ষের অন্যান্য পেজের প্রতিটি এক বছরে এক লাখের কম ‘লাইক’ পেয়েছে।

বিএনপির মিডিয়া ও অফিশিয়াল পেজগুলো ধারাবাহিকভাবে বেশি পোস্ট দেওয়ার ক্ষেত্রে এগিয়ে ছিল। এমনও দেখা গেছে, ‘নাটোর জেলা বিএনপি’ দলটির অফিশিয়াল পেজকে পোস্টের সংখ্যার দিক থেকে পিছিয়ে দিয়েছে।

২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে বিএনপির ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক কর্মসূচির সঙ্গে তাল মিলিয়ে অন্যান্য ছোট পেজ, যেমন ‘মাই বিএনপি’ ও ‘লিডার আসছে বিএনপি’ ঘন ঘন পোস্ট করা শুরু করে।

২০২৩ সালের জুন থেকে বিএনপির পেজগুলোতে পোস্টের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল; যা গত সেপ্টেম্বর থেকে আকাশচুম্বী হতে শুরু করে।

গত জুলাইয়ে বিএনপির পেজগুলোতে ৪ হাজার ৫০০টির বেশি পোস্ট দেওয়া হয়। আগের মাসে দেওয়া হয় ৩ হাজারের কিছু কম পোস্ট। সেপ্টেম্বরে বিএনপির পেজগুলোতে ৪ হাজারের কিছু কম পোস্ট দেওয়া হয়। কিন্তু নভেম্বরে এই সংখ্যা প্রায় তিন গুণ বেড়ে ১১ হাজার ছাড়িয়ে যায়।

একই প্রবণতা দেখা যায় বিএনপির ফেসবুক গ্রুপগুলোতে। বিএনপির গ্রুপগুলোতে পোস্টের সংখ্যা ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ছিল ১৬ হাজার। ২০২৩ সালের নভেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩০ হাজার।

আওয়ামী লীগের পেজগুলোর তুলনামূলক গ্রুপগুলো ভালো তৎপরতা দেখিয়েছে। আওয়ামী লীগের গ্রুপগুলোতে গত বছরের ডিসেম্বরে পোস্ট ছিল ১২ হাজার। কিন্তু গত মাসে (নভেম্বর) পোস্টের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ২২ হাজার।

গত জুন ও অক্টোবরে বিএনপির অনলাইন তৎপরতা বৃদ্ধির সঙ্গে দুটি বড় রাজনৈতিক ঘটনার যোগসূত্র আছে বলে মনে হয়। গত মে মাসের শেষ দিকে যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচনকেন্দ্রিক ভিসা নিষেধাজ্ঞার নীতি ঘোষণা করে। এটিকে বিএনপির জন্য স্বস্তি হিসেবে দেখা হয়েছিল।

পরে বিএনপি ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশের কর্মসূচি দেয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিএনপির নেতা-কর্মীদের ছত্রভঙ্গের চেষ্টা করলে কর্মসূচি সহিংস রূপ নেয়। ওই ঘটনার পর বিএনপিপন্থী পেজ ও গ্রুপগুলোতে তৎপরতা বাড়তে দেখা যায়।

বিএনপি ও আওয়ামী লীগের ফেসবুক গ্রুপগুলোতে নানা আচরণ দেখা গেছে। পোস্টের সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে উভয় দলের শীর্ষ ২০টি করে গ্রুপ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগের গ্রুপগুলোর ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্যসংখ্যক পোস্ট (১৯ থেকে ৫০ শতাংশ) মাত্র দুটি গ্রুপে কেন্দ্রীভূত ছিল। এর একটি ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’, অন্যটি ‘বাংলাদেশ আওয়ামী অনলাইন লীগ’।

অন্যদিকে বিএনপির গ্রুপগুলোতে বিকেন্দ্রীকরণ প্রবণতা দেখা যায়। পোস্টের সংখ্যার দিক থেকে ছোট গ্রুপগুলোর আধিপত্য দেখা যায়নি। এর পরিবর্তে পোস্টগুলো আরও বিস্তৃত পরিসরে গ্রুপগুলোর মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল। একইভাবে লাইক, শেয়ার ও কমেন্টের দিক দিয়ে বিএনপির পাঁচ থেকে ছয়টি গ্রুপে এনগেজমেন্ট বেশি ছিল। বিষয়টি সম্ভবত ইঙ্গিত দেয়, বিএনপির সমর্থকেরা আরও সংগঠিত।

নেটওয়ার্কের ওয়েব

নেটওয়ার্ক বিশ্লেষণে দেখা যায়, একটি গ্রুপে পোস্ট করা কনটেন্ট প্রায়ই অন্যান্য গ্রুপ, পেজ ও প্রোফাইলে ব্যাপকভাবে শেয়ার করা হয়। এগুলো হয় রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পর্কিত অথবা কথিত সমর্থক।

গবেষকেরা এক বছর ধরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সর্বাধিক প্রচারিত লিংকগুলোর বিতরণ প্রক্রিয়া বিশ্লেষণ করেন। বিশ্লেষণে কীভাবে এই লিংকগুলো বিভিন্ন পেজ, গ্রুপ ও ভেরিফায়েড প্রোফাইলে শেয়ার করা হয়েছিল, তা দেখা হয়।

বিশ্লেষণে দেখা যায়, মাত্র ১৯ শতাংশ পেজ, ভেরিফায়েড প্রোফাইল বা গ্রুপে বাংলা বা ইংরেজিতে ‘আওয়ামী লীগ’ লেখা ছিল। অন্যদিকে বিএনপির সর্বাধিক শেয়ার করা লিংকের ক্ষেত্রে এই হার ছিল ৬৪ শতাংশ।

বিষয়টি ইঙ্গিত দেয়, আওয়ামী লীগের বিতরণ নেটওয়ার্ক বিএনপির চেয়ে বৈচিত্র্যময়। দেখা গেছে, আওয়ামী লীগের কনটেন্ট এমন নামের গ্রুপ বা পেজে বেশি শেয়ার করা হয়, যা তাদের নামের বাইরে, কিন্তু এগুলো তাদের মতাদর্শের।

অনলাইন পরিসরে প্রভাব

বাংলাদেশের প্রধান দুই দল সম্পর্কে গবেষকদের বিশ্লেষণ ইঙ্গিত দেয়, তারা তাদের মেসেজিংয়ে পেজ, গ্রুপ ও প্রোফাইলের (ভেরিফায়েড, পাবলিক ও ব্যক্তিগত) একটি আন্তসংযুক্ত ওয়েব পদ্ধতি ব্যবহার করে।

ফেসবুক ব্যবহারকারীর নিউজফিডে নিজেদের বার্তার বন্যা বইয়ে দিতে তারা এক অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে।

পেজ, গ্রুপ ও প্রোফাইলগুলো কীভাবে সংগঠিত হয়, তার ওপর ভিত্তি করে গবেষকেরা দেখতে পান, বিএনপির তুলনায় আওয়ামী লীগের শক্তিশালী কেন্দ্রীয় প্রচার কৌশল আছে।

বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিএনপি ক্রমবর্ধমানভাবে বেশি কনটেন্ট শেয়ার করে। পরবর্তী সময়ে তারা আরও বেশি রিচ ও এনগেজমেন্টের প্রয়াস চালায়।

গবেষকেরা দেখতে পান, আওয়ামী লীগ এমন পেজ, গ্রুপ ও প্রোফাইল ব্যবহার করে, যাতে দলের নাম থাকে না। ফলে ফেসবুকের গোপনীয়তা সংরক্ষণ নীতির কারণে আওয়ামী লীগের অনলাইন উপস্থিতির বিস্তৃত প্রকৃতি যথাযথভাবে যাচাই করা কঠিন।

  • অনুবাদ: সাইফুল সামিন