৩৬ বছর পরিচ্ছন্নের কাজ করে অবসরে যাওয়া ডলির হাতে উঠল ফুলের তোড়া

ডলি জমাদারের অবসরোত্তর সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে এসেছিলেন ফরিদপুরের অনেক কৃতিজনছবি: সংগৃহীত

ডলি জমাদারের পৈতৃক বাড়ি মাগুরায়। বিয়ের পর চলে আসেন ফরিদপুরে। স্বামীর সঙ্গে থাকতে শুরু করেন ‘বান্ধবপল্লি’ নামে পরিচিত হরিজনপল্লিতে।

ডলির ডান হাতের কবজির ওপরের দিকে ট্যাটু করে লেখা ‘গণেশ’। এটা তাঁর স্বামীর নাম। ৪৫ বছর আগে বিয়ের পরপর স্বামীর সঙ্গে ভারতে বেড়াতে গিয়েছিলেন ডলি। তখন ডলি ছিলেন ছিপছিপে এক তরুণী। সে সময় তিনি শখ করে ট্যাটুটি করিয়েছিলেন।

গণেশ ও ডলির সেই বয়সকালের একটা বাঁধানো ছবি রাখা আছে বান্ধবপল্লির বাড়ির বসার ঘরে। যদিও এই ছবির একজন এখন কেবলই স্মৃতি, তিনি গণেশ।

গণেশ জমাদার ছিলেন পরিচ্ছন্নতাকর্মী। চাকরি করতেন ফরিদপুর সদর হাসপাতালে। চাকরিতে থাকা অবস্থায় গণেশ অন্ধ হয়ে যান। তখন স্বামীর চাকরিটি পান ডলি। সেটা গত শতকের আশির দশকের শেষের দিকের কথা।

এরপর অন্ধ স্বামী আর এক ছেলে ও দুই মেয়ের ভরণপোষণ ছাড়াও আত্মীয়স্বজনদের নানা অভাব-অভিযোগ মেটানোর দায়িত্ব এসে পড়ে ডলির কাঁধে। তাঁদের দুই কামড়ার ঘরে ঠাঁই পেয়েছেন বিপদগ্রস্ত অনেক মানুষ।

২ এপ্রিল দুপুরে ফরিদপুরের বান্ধবপল্লিতে গিয়ে দেখা হয় ডলির সঙ্গে। তাঁর এক আত্মীয়ের মেয়ে ১১ দিন আগে সন্তান প্রসব করেছেন। সেই নবজাতককে নিজের নাতির মতো করে যত্ন করছিলেন ডলি।

স্বজনের শিশুসন্তান কোলে বান্ধবপল্লির বাড়িতে ডলি জমাদার
ছবি: প্রথম আলো

৩৬ বছর ধরে ফরিদপুর সদর হাসপাতালে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে কাজ করে সম্প্রতি ডলি অবসরে যান। বান্ধবপল্লিতে তাঁর অবসরোত্তর সংবর্ধনা অনুষ্ঠান হয়। ব্যতিক্রমী এই অনুষ্ঠান ঘিরে আলোচনায় আসেন তিনি।

ডলির শখ ছিল নিজের অবসরজীবন শুরু করবেন আড়ম্বরময় উদ্‌যাপনের মধ্য দিয়ে, যেখানে থাকবেন তাঁর আপনজনেরা, শহরের কৃতীমান ব্যক্তিরা। সে অনুযায়ী বান্ধবপল্লিতে আয়োজন করা হয়েছিল ‘সুজনমেলা অনুষ্ঠান’।

উদ্যোগটি নিয়েছিল ডলির একমাত্র ছেলে রাজেশ জমাদার। গত ১৪ মার্চ সন্ধ্যায় অনুষ্ঠান শুরু হয়। চলে রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত। অনুষ্ঠানে এসেছিলেন শিক্ষক, সাংবাদিক, সংস্কৃতিকর্মীসহ অনেক সুধীজন। অনুষ্ঠানে সব মিলিয়ে প্রায় দেড় শ অতিথি ছিলেন।

রাজেশ প্রথম আলোকে বলেন, মায়ের শখ পূরণ করতেই এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। তবে তাঁরা সবাইকে আমন্ত্রণ জানাননি। যাঁরা তাঁদের হেয় করে দেখে আনন্দ পান, তাদের অহেতুক বিব্রত করতে চাননি তাঁরা। তাঁদের যাঁরা স্বজন ভাবেন, তাঁদেরই আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। আমন্ত্রিত প্রায় সবাই এসেছিলেন।

মূল আয়োজনে ছিল খালি গলায় অনুরোধের গান। আর ছিল আপ্যায়নের ব্যবস্থা। প্রথমে ফল দিয়ে অতিথিদের আপ্যায়ন করা হয়। পরে সবাইকে নিজ হাতে রান্না করা বিরিয়ানি খাওয়ান ডলি। তিনি নিজ হাতে আমন্ত্রিত অতিথিদের উত্তরীয় পরিয়ে দেন। অতিথিরাও তাঁর হাতে ফুলের তোড়া তুলে দেন।

দেশের বিভিন্ন স্থানে যখন পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের শিশুদের হোটেলে বসে খাওয়ার অনুমতি না পাওয়া, স্কুলে পড়তে বসার অনুমতি না পাওয়ার মতো খবর শোনা যায়, তখন ডলির এই সংবর্ধনা এক ভিন্ন বার্তা দেয়।

অনুষ্ঠানের অভিজ্ঞতা নিয়ে আপ্লুত ডলি প্রথম আলোকে বললেন, ‘আপনি মানুষের সঙ্গে ভালো আচরণ করলে ঈশ্বর সেই প্রতিদান আপনাকে দিবেই।’

ফরিদপুরের ইয়াছিন কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে অবসরে গেছেন অধ্যাপক আলতাফ হোসেন। তিনি এখন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের হয়ে শিক্ষার্থীদের বইপড়া কর্মসূচিতে যুক্ত আছেন। ডলির সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সবার আগে উপস্থিত হয়েছিলেন আলতাফ হোসেন। অনুষ্ঠানে তিনি শাহেনশাহ-ই-গজল মেহেদি হাসানের ‘হামে কোই গাম নেহি থা, গামে আশিকি ক্যে প্যাহেলে...’ গজলটি গাওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। মাগুরা থেকে আসা ডলির ছোট ভাই শ্রোতাদের গজলটি গেয়ে শুনিয়েছিলেন।

আলতাফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘একজন নারী সারা জীবন পরিশ্রম করে নিজের পরিবারকে সচ্ছল করেছেন। অবসরের সময় তাঁর শখ হয়েছে, আমাদের একবেলা খাওয়াতে। কে জানে, হয়তো মনের ভেতর কোথাও সেই অচ্ছুত বা নিচু জাত শব্দটি শোনার বেদনা তাঁর হৃদয়েও আছে। সত্যি কথা হচ্ছে, শেষ পর্যন্ত ডলি জমাদারের সংবর্ধনা এত আড়ম্বরপূর্ণ হবে, কেউ ভাবেনি।’

অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন তরুণ সংস্কৃতিকর্মী শরীফ খান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, যে হাত এই শহরকে পরিচ্ছন্ন রাখতে এত দিন শ্রম দিয়েছে, সেই হাতে ফুল তুলে দিতে পেরে আমরাই বেশি সম্মানিত হয়েছি। তাঁর হাতে এখন ফুলের তোড়াই মানায়।’

আয়োজনে উপস্থিত ছিলেন গোয়ালন্দ রাবেয়া-ইদ্রিছ মহিলা কলেজের সহকারী অধ্যাপক লিয়াকত হিমু। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি নিমন্ত্রণ পেয়েই সিদ্ধান্ত নিই, উপস্থিত হব। এমন আন্তরিকতা সবাই দিতে পারে না। যে মানুষেরা এত সম্মান করে, তাঁদের সম্মান জানানো আমাদেরও কর্তব্য।’

লিয়াকত হিমু পাল্টা প্রশ্ন করেন, এই পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা যদি কাজ বন্ধ করে দেন, তাহলে একটা শহরের অবস্থা কেমন হবে বলেন? সে উদাহরণ তো ফরিদপুরের ইতিহাসেই আছে। এ প্রসঙ্গে তিনি চার দশকের বেশি সময় আগে ফরিদপুর শহরে পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের ডাকা ধর্মঘটের কথা উল্লেখ করেন।

সেই আন্দোলনের স্মৃতি এখনো ডলির মনে আছে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, চাকরি সরকারীকরণের দাবিতে তাঁরা আন্দোলন করেছিলেন। আন্দোলনে কাজও হয়েছিল। চাকরি সরকার না হলে তিনি একা এত বড় সংসার কি আর টেনে তুলতে পারতেন?

বান্ধবপল্লির জীবন

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষদিকে ও ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ফরিদপুর শহরে গড়ে উঠতে থাকে ইট-পাথরের ভবন, পাশ্চাত্য নকশার বাংলো। তখন থেকেই শহরের পরিচ্ছন্নতার কাজে যুক্ত হতে থাকেন পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা।

ব্রিটিশ আমলে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, চা-বাগানের কাজ, জঙ্গল কাটা, পয়োনিষ্কাশন প্রভৃতি কাজের জন্য ভারতের নানা এলাকা থেকে দরিদ্র দলিত মানুষদের এ অঞ্চলে আনা হয়। তাঁদের থাকতে দেওয়া হয় কাজের জায়গায়, কলোনিতে। তাঁদের কাছ থেকে সেবা নেওয়া যাবে, কিন্তু ছোঁয়া যাবে না। সেলুন, রেস্তোরাঁ, রেলের কামরা, স্কুল-কলেজ পরিষ্কার করবেন তাঁরা।

বলা হয়, কথিত এসব ‘অচ্ছুত’ মানুষকে সম্মানজনক অবস্থান দেওয়ার জন্য মহাত্মা গান্ধী তাঁদের নাম দিয়েছিলেন হরিজন। মানে ঈশ্বরের সন্তান।

ফরিদপুরের সাবেক অধ্যাপক মো. শাহজাহান জানালেন, শহরের ‘সুইপার কলোনি’ বা ‘মেথরপট্টির’ নাম রাখা হয়েছিল ‘হরিজনপল্লি’। এই শহরে আরেকজন মানুষ এসেছিলেন, যিনি নিজেকে মানবকল্যাণে অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি সুব্রত ভট্টাচার্য। তিনিই এই পল্লির নাম দিয়েছিলেন ‘বান্ধবপল্লি’।

ছেলে রাজেশ জমাদারের সঙ্গে ডলির পুরোনো ছবি
ছবি: সংগৃহীত

বান্ধবপল্লিতে আগে হেলা, হাড়ি ও ডোম সম্প্রদায়ের মানুষ বাস করত। সম্প্রতি ডোম সম্প্রদায়ের পরিবার দুটি চলে গেছে সরকারি হাসপাতালের কোয়াটারে। ডলিরা ‘হেলা’ সম্প্রদায়ের।

ফরিদপুরের আলীপুর গোরস্তান পেরিয়ে শহরের ভেতরে প্রবেশের আগে বান্ধবপল্লির অবস্থান। এখন সেখানে ২৭০ টির মতো পরিবার থাকে। পল্লিতে ঢুকলে পরিচ্ছন্নতার নজির দেখা যায়। বাড়িঘরসহ পুরো পল্লি ঝাঁ–চকচকে। সারা দিন গায়ে ময়লা, দুর্গন্ধ মেখে কাজ করতে হয় বলেই হয়তো নিজেদের পরিচ্ছন্নতা নিয়ে তাঁরা একটু বেশি সচেতন। ঘরের সামনে শুকাতে দেওয়া কাপড় থেকে ডিটারজেন্টের পাশাপাশি একটা রাসায়নিকের গন্ধও ভেসে আসছিল।

পল্লিতে ডলির ঘরের মুখোমুখি ঘরে থাকে প্রয়াত পরিচ্ছন্নতাকর্মী সিপাহি লালের পরিবার। এই পরিবারের ছোট ছেলে সুভাষ দাস। তিনি ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজ থেকে মাস্টার্স শেষ করেছেন। সম্প্রতি সুইজারল্যান্ডে শিক্ষাবৃত্তি পেয়েছেন তিনি। এখন চলছে সুভাষের বিদেশযাত্রার প্রস্তুতি।

২ এপ্রিল দুপুরে ডলির ঘর থেকে বের হতেই দেখা হয়ে গেল সুভাষের সঙ্গে। আতিথেয়তা দিতে খানিকটা জোর করেই তিনি তাঁদের ঘরে নিয়ে গেলেন। সঙ্গে ডলিও গেলেন।

সুভাষের সঙ্গে মুঠোফোনের নম্বর বিনিময় হলো। বললেন, ‘আমি বিদেশে গিয়ে আপনাকে ছবি পাঠাব।’

ডলিকে কাকি বলে ডাকেন সুভাষ। কাকিও তাঁকে ভীষণ স্নেহ করেন। সুভাষের মাথায় হাত রেখে স্নেহের স্পর্শ দিতে দিতে ডলি যেন বললেন, এই দিন আসবে বলেই তো আমাদের এত কষ্ট ছিল।

সুভাষ তাঁর মুঠোফোনে থাকা কাকি ডলির সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের ছবিগুলো দেখালেন। তিনিও আপ্লুত হলেন।