ঝুঁকিতে পিছিয়ে থাকা ১৫ ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষাও

ভাষা নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংস্থা সামার ইনস্টিটিউট অব লিঙ্গুইস্টিকস (সিল) বাংলাদেশের ১৫টি ভাষার বিপন্নতার চিত্র তুলে ধরেছে
ছবি: সংগৃহীত

শেরপুর জেলা সদরের গৃদ্দাদা নারায়ণপুর গ্রামে হুদি জাতিগোষ্ঠীর ১২টি পরিবার আছে। এ জাতিগোষ্ঠীর কেউই তাঁদের ভাষায় কথা বলতে পারেন না। এ তথ্য জানিয়ে এ জাতিসত্তার সুভাষচন্দ্র বিশ্বাস বলছিলেন, ‘আমি তো পারি না, আমার সন্তানেরাও পারে না। অভাবের কারণে সন্তানদের লেখাপড়া করাতে পারি না, সেখানে ভাষা নিয়ে চিন্তা করার সুযোগ কই?’

বাংলাদেশ সরকার ২০১৯ সালে ৫০টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর স্বীকৃতি দিয়েছে। এর মধ্যে হুদি একটি। হুদিদের নিজস্ব হিসাবে, তাদের সংখ্যা ২০ হাজারের কাছাকাছি। হুদিদের মতো অনেক জাতিসত্তা আছে, যারা ভাষাকে হারিয়ে ফেলেছে। ভাষা নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংস্থা সামার ইনস্টিটিউট অব লিঙ্গুইস্টিকস (সিল) বাংলাদেশের এমন ১৫টি ভাষার বিপন্নতার চিত্র তুলে ধরেছে। সংস্থাটি বলছে, এসব জাতিসত্তার মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থান দুর্বল, আবার তাদের ভাষার অবস্থাও ঝুঁকির মধ্যে।

কেন এই গবেষণা

সিল প্রায় তিন বছর ধরে ১৫ জাতিগোষ্ঠীর ভাষা নিয়ে গুণগত ও পরিমাণগত গবেষণা করছে। এসব জাতিগোষ্ঠী হলো কন্দ, গঞ্জু, বানাই, বাড়াইক, বাগদি, ভূমিজ, খাড়িয়া, মালো, মুসহর, তেলি, তুরি, রাজোয়ার, হুদি, পাত্র ও ভুঁইমালী।

সিলের এদেশীয় পরিচালক কর্নেলিয়াস টুডু বলেন, ‘আমরা যেসব জাতিগোষ্ঠীর ভাষা নিয়ে কাজ করেছি, তারা খুব কম পরিচিত। তাদের আরও দৃশ্যমান করা আমাদের কাজের উদ্দেশ্য ছিল। ভাষার বিপন্নতা তুলে ধরার উদ্দেশ্য হলো, তাদের সংরক্ষণে নিজেরা কাজ করা বা অন্যদের উৎসাহিত করা। আমরা দেখেছি, যে জাতিগোষ্ঠীর অবস্থা যত বিপন্ন, তাদের ভাষাও ততটাই বিপন্ন।’

ভাষার বিপন্নতা

ভাষার অবস্থা পরিমাপের জন্য বিভিন্ন মানদণ্ড রয়েছে। তার মধ্যে সিল বেছে নিয়েছে এক্সপেন্ডেড গ্রেডেড ইন্টারজেনারেশনাল ডিসরাপশন স্কেলকে (ইগিড্স)। এই মানদণ্ড অনুযায়ী, ভাষার অবস্থা বোঝার ১০টি স্তর রয়েছে। প্রথম থেকে তৃতীয় স্তরে যেসব ভাষা থাকে, সেগুলোর অবস্থা অপেক্ষাকৃত ‘ভালো’। এসব ভাষা জাতীয় বা আঞ্চলিক পর্যায়ে ব্যবহৃত। চতুর্থ ও পঞ্চম স্তরে আছে সেসব ভাষা, যেগুলো শিক্ষায় ব্যবহৃত হয় এবং সাহিত্য আছে। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম স্তর অনেকটা ঝুঁকির। ইগিড্‌সের নবম ও দশম স্তরে থাকা ভাষা বিলুপ্ত বা মৃত।

সিলের গবেষণা অনুযায়ী, মালো, বাড়াইক ও গঞ্জু সম্প্রদায়ের লোকেরা মৌখিকভাবে ‘সাদরি’ ভাষা ব্যবহার করে থাকে, তবে সাদরি ভাষার কোনো লিখিত প্রচলন তাদের মধ্যে নেই। তেলি সম্প্রদায়ের ভাষা ‘নাগরি’, তুরি সম্প্রদায়ের ‘খট্টা’, মুসহর সম্প্রদায়ের ‘দেশওয়ালি’ ও ‘নাগরি’, কন্দ সম্প্রদায়ের কুই ও উড়িয়া ভাষা এবং ভূমিজ সম্প্রদায়ের ভূমিজ ভাষা হুমকির সম্মুখীন।

পাত্র সম্প্রদায়ের ‘লালেংথার’ ভাষা এবং বানাই সম্প্রদায়ের ‘বানাই’ ভাষা হুমকির মুখে থাকলেও এ ভাষার লোকেরা নিজেরা যোগাযোগের মাধ্যমে এর ব্যবহার করে। অষ্টম স্তরে আছে রাজোয়ার সম্প্রদায়ের ‘খট্টালি’ আর খাড়িয়া সম্প্রদায়ের ‘ফার্সি’ ভাষা। দশম স্তর; অর্থাৎ বিলুপ্ত বা মৃতপ্রায় ভাষার অন্তর্ভুক্ত হলো বাগদি, হুদি ও ভুঁইমালী। এই সম্প্রদায়গুলোর ভাষার মৌখিক প্রচলন নেই, লিখিত তথ্যও পাওয়া যায়নি।

খাড়িয়া সম্প্রদায়ের সদস্যরা
ছবি: সিল–এর সৌজন্যে

আর্থসামাজিক অবস্থা

সিলের গবেষণায় ১৫ জাতিগোষ্ঠীর ভাষা নিয়ে বলা হয়েছে, ‘জীবন-জীবিকার তাগিদে ছুটতে গিয়ে ভাষা, সংস্কৃতি, রীতিনীতি ও নিজস্বতার কোনো গুরুত্ব নেই। তাদের দারিদ্র্য ও অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা মাতৃভাষা শেখার বা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তা স্থানান্তরের প্রতি অনীহা তৈরি করছে। ফলে প্রতিটি সম্প্রদায়ের ভাষা দিন দিন আরও বেশি হুমকির মুখে পড়ছে।’

মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার পাত্রখোলা চা-বাগানের শ্রমিক লিটন গঞ্জু বলছিলেন, ‘আমাদের ভাষাটার চর্চাই নেই। বেশির ভাগ মানুষ দরিদ্র, ভাষা নিয়ে ভাবার উপায় কম। কেউ তো এগিয়ে আসে না ভাষা রক্ষায়।’

গবেষণায় দেখা যায় যে, এই ১৫ ভাষাভাষীর বসবাস মূলত বাংলাদেশের সমতল অঞ্চলে। তাঁদের মধ্যে প্রায় ৮৫ শতাংশ মানুষ কৃষিকাজ করেন। এসব জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বাড়াইক, বাগদি, ভূমিজ, গঞ্জু, কন্দ, খাড়িয়া সম্প্রদায়গুলো চা-বাগানে বাস করে। তাদের দৈনিক মজুরি ১৭০ টাকা।

বেসরকারি সংস্থা সেড প্রকাশিত চা শ্রমিকের মজুরি: মালিকের লাভ, শ্রমিকের লোকসান নামের গবেষণাগ্রন্থ অনুযায়ী, মজুরি, অন্য সুবিধাসহ একজন চা-শ্রমিক মাসে সাকল্য আট হাজার টাকা আয় করেন।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর খানা আয় ও ব্যয় জরিপ (২০২২) অনুযায়ী, দেশে পরিবারপ্রতি গড় আয় ৩২ হাজার ৪২২ টাকা।

আর্থসামাজিক অবস্থার সঙ্গে ভাষার বিপন্নতার সম্পর্ক নিয়ে অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভাষার সমৃদ্ধি বা বিপন্নতার সঙ্গে অর্থনীতির একেবারে সরাসরি সম্পর্ক নেই বটে। তবে ভাষা মানুষের স্বকীয়তা তৈরি করে। কারও নিজের ভাষার অবস্থান দৃঢ় হলে অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে সে এগিয়ে থাকে। এটা ব্যক্তি এবং সমাজের ক্ষেত্রে সমানভাবে সত্য।’

পার্বত্য চট্টগ্রামের ভাষা ও সংস্কৃতির গবেষক অরুণেন্দু ত্রিপুরা বলছিলেন, পাহাড়ের জেলা পরিষদগুলো মাতৃভাষায় রক্ষায় সচেষ্ট হয়েছে। দেশের প্রতিটি জেলা পরিষদ ওই জেলায় থাকা জাতিগোষ্ঠীর ভাষায় বর্ণমালা সংগ্রহ, সাহিত্য প্রসারে ভূমিকা রাখতে পারে।

বিপন্ন ভাষাগুলো রক্ষায় করণীয় নিয়ে প্রযুক্তির সহায়তার পরামর্শ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ শাহরিয়ার রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এসব ভাষার গান, উপকথা যা আছে, তা রেকর্ড করে ইউটিউব বা অন্য কোনো সামাজিক মাধ্যমে রাখা যেতে পারে। শুধু এসব ভাষাভাষীই নন, অন্য কোনো ভাষার মানুষও তাতে আগ্রহী হতে পারেন।