৮ হাজার টাকার চাকরি ছেড়ে ঝাড়ু বানানো শুরু, আয় এখন ৩০ হাজার

নিজেই ঝাড়ু বানান আল হাসানছবি: সংগৃহীত

অনেকেই বলতেন ‘ঝাড়ুওয়ালা’। কানে আসত নানা বাজে মন্তব্য। এসব শুনে প্রথম দিকে আল হাসান কুরিয়ারে পণ্য ডেলিভারি করতে যেতে খানিকটা বিব্রত হতেন। তবে এখন আর পরিস্থিতি তেমন নেই। এখন খুশিমনে নিজের হাতে বানানো নানা রঙের ঝাড়ু বিক্রি করেন তিনি। এই ঝাড়ুকে ‘প্রিমিয়াম ঝাড়ু’ বলেন তিনি।

চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির ২৭ বছর বয়সী যুবক আল হাসান ঝাড়ুর কাঠি কিনে এনে সেগুলো প্লাস্টিকের বেতি (একধরনের রশি) দিয়ে নিজেই নকশা করে বাঁধাই করেন। আল হাসান বলেন, এতে ঝাড়ুগুলো মজবুত হয়। টেকে অনেক দিন।

ফটিকছড়িতে গ্রামে থাকলেও আল হাসানের বেশির ভাগ ক্রেতা চট্টগ্রামসহ অন্যান্য জেলার শহরে। তিনি একেকটি ঝাড়ু বিক্রি করেন ১০০ টাকায় (কুরিয়ার চার্জ ছাড়া)। গ্রামের মানুষেরা ১০০ টাকা দিয়ে এই ঝাড়ু কিনতে চান না। প্রতি মাসে গড়ে সব খরচ বাদ দিয়ে লাভ থাকছে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা।

নিজের হাতে বানানো নানা রঙের ঝাড়ু
ছবি: সংগৃহীত

আল হাসান বলেন, যে ক্রেতা একবার তাঁর বানানো ঝাড়ু কেনেন, তিনি তার পর থেকে আর অন্য কোনো জায়গা থেকে ঝাড়ু কেনেন না। নতুন ক্রেতার পাশাপাশি পুরোনো ক্রেতারাও পণ্য কেনেন বলে ব্যবসাটা ভালোই চলছে। ফটিকছড়িতে তাঁর পৈতৃক ছোট একটি বাড়ি আছে। আর দৈনন্দিন যে খরচ, তা মেটাতে খুব একটা কষ্ট হচ্ছে না আল হাসানের। তিনি বলেন, ‘এই ঝাড়ু বিক্রি করেই আমি আমার সংসার চালাচ্ছি। এখন আমি ভালো আছি।’

আল হাসান মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। বলেন, আট বছর আগে তাঁর বাবা মারা গেলে সংসারে আর্থিক টানাপোড়েন শুরু হয়। ফটিকছড়িতে বাবার ছোট একটা স্টুডিও ছিল। তা দিয়েই সংসার চলত। বাবা মারা গেলে স্টুডিওটি টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। পরিবারের বড় ছেলে হিসেবে সংসারের হাল ধরতে হয় আল হাসানকে। সৌরবিদ্যুতের একটি কোম্পানিতে আট হাজার টাকা বেতনে চাকরি নেন।

আল হাসানের এক ভাই উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা করে চট্টগ্রামে একটি জুতার কারখানায় কাজ করছেন। তিন বোনের বিয়ে হয়েছে। মা, স্ত্রী আর আড়াই বছর বয়সী মেয়েকে নিয়েই আল হাসানের সংসার। তিনি বলেন, সৌরবিদ্যুতের যে কোম্পানিতে কাজ করতেন সেখানেই এক খালা ঝাড়ু বাঁধাই করে দিতেন। সেই খালার কাজে সহায়তা করতে করতেই কাজটি রপ্ত করেছিলেন। একদিন নিজেই বাড়িতে বসে কয়েকটি ঝাড়ু বাঁধাই করেন। ইচ্ছা ছিল, বোনসহ অন্যদের উপহার দেবেন। একটি ই-কমার্স সাইটে ঝাড়ুর ছবি পোস্ট করলে সবাই বেশ উৎসাহ দেন। তারপর ব্যবসার চিন্তা মাথায় আসে। মূলত তিন–চার বছর আগে থেকেই শুরু হয়েছে ই–উদ্যোগ।

আল হাসান বলেন, ‘চাকরি করে আট হাজার টাকা বেতন পেতাম। তা দিয়ে সংসার চালানো কঠিন ছিল। তারপর চাকরির পাশাপাশি অনলাইনে ঝাড়ুর ব্যবসা শুরু করি। দুই বছরের বেশি সময় ধরে অনলাইনে উদ্যোক্তাদের গ্রুপ উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ট্রাস্টের মাধ্যমে পণ্য বিক্রি করছি। একেকটি ঝাড়ু বানাতে সময় লাগে ২০ মিনিটের মতো। খরচ হয় ৬০ টাকা। আমার ঝাড়ুর ব্যবসাটা ১২ মাসই চলে। এর সঙ্গে আমের সময় আম বা মৌসুমি পণ্য বিক্রি করি। তবে আমার মূল ব্যবসা ঝাড়ু বিক্রি।’

ঝাড়ুর ফুলগুলো পাহাড়ে বা নদীর তীরে অনেকটা আগাছার মতো প্রাকৃতিক নিয়মে জন্মে। এগুলো কিনতে পাওয়া যায়। বাজার থেকে কিনে আনা, তা রোদে শুকানো তারপর বেতি দিয়ে বাঁধাই করার কাজটি তিনি নিজেই করেন। স্ত্রী উম্মে জয়নব তাঁর কাজে সাহায্য করেন।

শহুরে বাসাবাড়িতে এই প্রিমিয়াম ফুলঝাড়ু দীর্ঘদিন ব্যবহার করা যায়, সহজে নষ্ট হয় না বলে জানান আল হাসান। মানুষ বিশ্বাস করেন এবং আস্থা পান বলে বছরের পর বছর তাঁর কাছ থেকেই ঝাড়ু কিনছেন। কেউ যখন অর্ডার দেন, একসঙ্গে পাঁচটা বা তার বেশি অর্ডার দেন বলে জানান। তিনি বলেন, ‘ক্রেতা থাকেই, তাই প্রতিদিনই আমাকে ঝাড়ু বানাতে হয়। আর সবচেয়ে বড় কথা, চাকরি করার সময় স্বাধীনতা ছিল না। এখন আমি স্বাধীন।’

মেয়ের সঙ্গে আল হাসান
ছবি: সংগৃহীত

বিভিন্ন ক্রেতা ফুলঝাড়ু কিনে তা বিদেশে থাকা আত্মীয়দের কাছে পাঠান। তবে এবার একটি কোম্পানির প্রতিনিধিরা বিদেশে পাঠানোর জন্য বড় একটি অর্ডার দিতে চাচ্ছেন বলে জানান আল হাসান। ঈদের পর গ্রামে বসেই কোম্পানির প্রতিনিধিদের সঙ্গে সেই চুক্তি সই হওয়ার কথা।

আল হাসানের মতে, অনলাইনের প্রতিযোগিতামূলক বাজারে ব্যবসায় টিকে থাকতে হলে পণ্যে নতুনত্ব আনতে হবে। পণ্যের গুণগতমান ঠিক রাখতে হবে। লক্ষ্য স্থির রেখে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। আর পরিশ্রমের কোনো বিকল্প নেই।

ঈদে মা, স্ত্রী ও মেয়ের জন্য কেনাকাটা করেছেন আল হাসান। নিজের আর ভাইয়ের জন্য কেনা হয়নি এখনো। তিনি বলেন, ঈদে ঝাড়ুর বিক্রি বাড়বে, তেমন পণ্য এটি নয়। ক্রেতাদের যখন প্রয়োজন, তখনই তাঁরা অর্ডার দেন। আল হাসান এই ঝাড়ুর ব্যবসাকে আরও বড় করতে চান। নিত্যপ্রয়োজনীয় এই পণ্যের মান উন্নয়নে বাঁধাই করার জন্য প্লাস্টিকের বেতির পরিবর্তে পাটের দড়ি বা অন্য কোনো কিছু ব্যবহার করা যায় কি না, তা নিয়েও ভাবছেন এই উদ্যোক্তা।