তাঁদের মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়?

এক.

মাস দেড়েক আগের কথা। সহকর্মী মানসুরা হোসাইন খুদে বার্তা পাঠিয়েছেন আমাকে। মানিক বাড়ৈ নামের ঢাকার একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের এক ছাত্রের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। সঙ্গে একটা চিরকুট উদ্ধার করেছে পুলিশ।

আত্মহত্যা নিয়ে প্রতিবেদন তৈরিতে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বনের কথা বলে থাকেন মনোরোগ চিকিৎসকেরা। উদ্দেশ্য, আর কেউ যেন আত্মহত্যায় আগ্রহী হয়ে না ওঠে। কিন্তু মানিকের সেই চিরকুট, যাকে বলা হয় সুইসাইড নোট, আমাকে কৌতূহলী করে তুলল।

গত ১১ জুন আত্মহত্যার আগে মানিক লিখে গেছেন, ‘আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়, আমি ব্যক্তিগত হতাশার কারণে আত্মহত্যা করছি। আমি মেডিকেলে ফেল করেছি এবং আমার লেখক হওয়ার স্বপ্ন পূরণ করতে পারিনি...।’

মানিক কবিতা লিখতেন। তাঁর লেখা কবিতা এখন বন্ধুদের হাতে হাতে—‘যেখানে রাষ্ট্র, দেশ, জাতি, মানুষ/ ঝলসে যায়/ ক্ষমতা আর লোভের কূটনৈতিক আঁচে/ যেখানে মৃত্যুরা ভীষণই ছোঁয়াচে/ সেখানে একটা মানুষকে বাঁচিয়ে/ কীভাবে আরেকটা মানুষ বাঁচে?’

বন্ধুরা বলছেন, মানিক আসলে কবিতায় মজেছিলেন। কালে কালে আসলে অনেকেই এভাবে কবিতায় মজেছেন। যেমন নির্মলেন্দু গুণ কিংবা আবুল হাসান। তাঁরা বোহেমিয়ান কবির ‘সংবিধান’ লিখেছিলেন। এর প্রথম বাক্যটি এমন ছিল, ‘আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাঝে মাঝে পড়ব, ক্লাস করব, ঘুরব-বেড়াব। কিন্তু ডিগ্রি লাভের চেষ্টা করব না। পরীক্ষা দেব না।’

‘আমার ভাই কখনো স্কুল-কলেজে দ্বিতীয় হয়নি। শেষে যে ওর কী হলো! শুধু ফেল করত। কারও সঙ্গে কথা বলত না। তারপর তো আর বাঁচলই না।’
মেহেদীর ভাই ওমর ফারুক

মানিকের আত্মহত্যার রেশ ধরে কথা বলতে শুরু করি সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ছাত্র-ছাত্রী, গবেষক আর সন্তানহারা বাবা-মা ও স্বজনদের সঙ্গে। খোঁজ নিতে গিয়ে জানতে পারি, মানিক শুধু একা নন; মেডিকেল শিক্ষার্থীদের প্রায় এক–চতুর্থাংশ শিক্ষাজীবনের কোনো না কোনো সময় আত্মহত্যার কথা ভাবেন।

আত্মঘাতী হয়েছেন কিংবা বিষণ্নতায় ভুগেছেন—এমন শিক্ষার্থীদের সম্পর্কে খোঁজ নিতে গিয়ে মাঝেমধ্যে মনে হয়েছে, বলিউডের জনপ্রিয় সিনেমা ‘থ্রি ইডিয়টস’-এর গল্প শুনছি নতুন করে। বুঝতে পারি, আমাদের তরুণদের বড় অংশের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র প্রায়ই উপেক্ষা করে। কখনো কখনো ভালো ফল করতে না পেরে কেউ কেউ বিষণ্নতায় ভোগেন, কেউ ঝরে যান, কেউ আবার অপ্রত্যাশিত মৃত্যুকে বেছে নেন।

বেসরকারি সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদন বলছে, শুধু ২০২০ সালে দেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজের ১২ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন।

উত্তরার মেডিকেল কলেজ ফর উইমেন অ্যান্ড হসপিটালের প্রাণরসায়ন বিভাগের শিক্ষক মিলিভা মোজাফফরের এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে মেডিকেল কলেজে পড়া শিক্ষার্থীদের প্রায় ২৪ শতাংশ শিক্ষাজীবনের কোনো না কোনো সময়ে আত্মহত্যার কথা ভাবেন। এই হার বেশ উদ্বেগজনক।

মিলিভা মোজাফফরের নেতৃত্বে দেশি-বিদেশি খ্যাতনামা চিকিৎসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গবেষকেরা বিভিন্ন মেডিকেল কলেজের ৫৮৩ শিক্ষার্থীর ওপর ‘বাংলাদেশের মেডিকেল শিক্ষার্থীদের আত্মঘাতী আচরণ’ শীর্ষক ওই গবেষণা করেন।

মিলিভা মোজাফফর বলেন, একই বয়সের সাধারণ শিক্ষার্থীদের তুলনায় মেডিকেলের শিক্ষার্থীরা বেশি বিষণ্নতায় ভোগেন। মেডিকেলের লেখাপড়া শ্রান্তিকর। দৈনন্দিন জীবনে এর একটা প্রভাব পড়ে। বিষণ্নতা, শারীরিক অসুস্থতা, পরিবারে আত্মহত্যার ইতিহাস অনেককে আত্মঘাতী হওয়ার দিকে ঠেলে দেয়।

দুই.

ঝিনাইদহের ছেলে মেহেদী হাসান ফারুক কুমিল্লা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন ২০০৭-০৮ শিক্ষাবর্ষে। পাস করতে পারেননি। বছর চারেক আগে হরিণাকুণ্ডুর মান্দিয়ায় গ্রামের বাড়ি থেকে ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার হয় মেহেদীর। তাঁর বন্ধু আতিকুর রহমান বলছিলেন, ‘ও একটা জেম।’

কেন আত্মঘাতী হলেন মেহেদী? বন্ধুরা বলছিলেন, তাঁর ইংরেজি উচ্চারণ ভালো নয়। আচার-আচরণে মফস্বলের ছাপ স্পষ্ট। এসব নিয়ে অনেকে টিপ্পনী কাটত। শুরুর ধাক্কায় পরীক্ষায় অকৃতকার্য হতে শুরু করেন তিনি।

আতিকরা এমবিবিএস পাস করেন ২০১৪ সালে। মেহেদী তখনো দেড় বছর পিছিয়ে। এ সময়ে তিনি রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। মেডিসিনের একটি ওয়ার্ডের কাজে অনিয়মিত হয়ে পড়েন। চূড়ান্ত বর্ষের পরীক্ষায় বারবার ওই বিষয়ে ফেল করতে থাকেন। হতাশায় মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন।

মেহেদীর ভাই ওমর ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ভাই কখনো স্কুল-কলেজে দ্বিতীয় হয়নি। শেষে যে ওর কী হলো! শুধু ফেল করত। কারও সঙ্গে কথা বলত না। তারপর তো আর বাঁচলই না।’

মেডিকেলে পড়া ভাইয়ের খরচ জোগান দিতে মেহেদীর বড় ভাই বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়া ছেড়ে বিদেশে চলে যান। মেহেদীর মৃত্যুতে পরিবারের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।

২০১৮ থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত আত্মহত্যার ১২টি ঘটনা বিশ্লেষণ করি। তাঁদের পাঁচজন বেসরকারি ও সাতজন সরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী। তাঁদের আটজনই এমবিবিএস বা বিডিএস কোর্সের লেখাপড়ায় পিছিয়ে পড়েছিলেন। জটিল মানসিক রোগ ও প্রেমের সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ায় আত্মহত্যা করেন দুজন। বাকি দুজনের আত্মহত্যার কারণ জানা যায়নি।

তিন.

মানিক বাড়ৈকে নিয়ে প্রতিবেদন শুরু করেছিলাম। ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র মানিকের সহপাঠীরা ইতিমধ্যে চিকিৎসক হয়ে গেছেন। ব্যাংক কর্মকর্তা বাবা অবসরে, অথচ মানিক পাস করতে পারছেন না—এসব নিয়ে হতাশ হয়ে পড়েন তিনি।

এর আগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে আত্মহত্যা করেন বেসরকারি প্রাইম মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী আহমাদ বিন রাফি। তিনি পরপর দুবার অ্যানাটমির (শারীরবিদ্যা) পরীক্ষায় অকৃতকার্য হন। এর এক মাস আগে রংপুর মেডিকেল কলেজের শহীদ ডাক্তার পিন্নু হল থেকে শিক্ষার্থী মুশফিকুর রহমানের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। সহপাঠীদের চেয়ে তিনি দুই বছর পিছিয়ে পড়েছিলেন।

২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত চার মাসে চার শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন। তাঁদের মধ্যে ১০ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী মেডিকেলের বিডিএস কোর্সের ছাত্রী জান্নাতুল ওয়াদিয়া, ১০ মার্চ ঢাকার শহীদ মনসুর আলী মেডিকেলের ছাত্রী তানহা রহমান, ৪ এপ্রিল কুমিল্লা মেডিকেলের মেহেদী হাসান এবং ৪ মে বগুড়ার টিএমএসএস মেডিকেলের ছাত্র বিজয় কুমার সাহা আত্মহত্যা করেন।

একই বছরের আগস্টে আত্মহত্যা করেন রাজশাহী মেডিকেলের ছাত্রী নগরীর দাসপুকুর এলাকার ফাহিমা আক্তার। ফাহিমার এক বন্ধু প্রথম আলোকে বলেন, সহপাঠীদের চেয়ে এক বছর পিছিয়ে পড়ায় হতাশ ছিলেন তিনি।

আত্মহত্যার আগে ফেসবুকে ফাহিমা শেষ স্ট্যাটাসে লেখেন, ‘ভাবিনি এটা হবে, ফেবুর ফার্স্ট অ্যান্ড লাস্ট স্ট্যাটাস। আমি সাইকো ছিলাম। মেন্টাল প্রবলেম ছিল। আর মেডিকেলটা আমার জন্য না। এইখানে পিছিয়ে পড়া স্টুডেন্টদের জায়গাটা খুব...আমিও আর পারছিলাম না।’

চার.

শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা ও আত্মহত্যার প্রবণতা নিয়ে সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষক ও স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের পাঠ্যক্রম তৈরির সঙ্গে যুক্ত কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়।
শিক্ষার্থীদের কথায় দুটি সমস্যা উঠে এসেছে। প্রথমত, অনেকের আগ্রহ নেই। পরিবারের ইচ্ছায় বাধ্য হয়ে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। বেসরকারি মেডিকেলে ভর্তি তুলনামূলক সহজ হওয়ায় অভিভাবকেরা সন্তানদের ডাক্তারি পড়াতে আগের চেয়ে বেশি উৎসাহী।

সন্তানের যোগ্যতা আছে কি না, সেটি তাঁরা বিবেচনা করছেন না। দ্বিতীয়ত, উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত বাংলা মাধ্যমে পড়ে আসার পর এমবিবিএস বা বিডিএস কোর্সে ইংরেজি ভাষা বুঝতে সমস্যায় পড়েন অনেকে। ভালোভাবে বুঝে ওঠার আগেই পরীক্ষা শুরু হয়ে যায়। আবার মেডিকেলে পড়ালেখার পরিবেশ সবার অনুকূল নয়। কোথাও তীব্র শিক্ষকসংকট, কোথাও সমানুভূতিশীল ও দায়িত্বশীল শিক্ষকের অভাব।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন পাঁচ বছরে চারটি পরীক্ষা ছাড়াও প্রতিদিন অল্প নম্বরের একাধিক ‘আইটেম’ ও ‘কার্ড’ পরীক্ষা হয়। প্রতিটি পরীক্ষায় পাস করতে হয়।

স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (গবেষণা, প্রকাশনা ও পাঠ্যক্রম উন্নয়ন) অধ্যাপক হুমায়ুন কবির তালুকদার এমবিবিএসের পাঠ্যক্রম তৈরি ও শিক্ষক প্রশিক্ষণের সঙ্গে যুক্ত। তিনি মনে করেন, মেডিকেল কলেজে ভর্তি এবং শিক্ষা ও শিক্ষণপদ্ধতির সংস্কার প্রয়োজন।

জিপিএ ও নৈর্ব্যক্তিক পরীক্ষার ভিত্তিতে ভর্তির বিদ্যমান ব্যবস্থায় পরিবর্তন জরুরি। অনেক শিক্ষার্থী পরিবারের চাপে মেডিকেলে ভর্তি হন। এমন অনেক ছাত্রছাত্রী আছেন, যাঁরা রক্ত বা মরদেহ দেখলে ভয় পান। রোগীর কাছে যেতে চান না। তাঁদের জন্য মেডিকেল কলেজ নয়। ভর্তি পরীক্ষায় লিখিত প্রশ্ন ও মৌখিক পরীক্ষা যুক্ত করা দরকার।

চিকিৎসা শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা বলছেন, এমবিবিএস বা বিডিএস কোর্স খুব আঁটসাঁট। এখানে নিবিড় মনোযোগের দরকার। চাপ কমাতে ২০২১ সালে পাঠ্যসূচিতে পরিবর্তন আনা হয়েছে। একেকটি বিষয় পড়ানোর সময় কখনো কখনো একাধিক বিভাগের চিকিৎসকের সম্পৃক্ততা দরকার হতে পারে। ক্লাসে কি এই নির্দেশনা বাস্তবায়িত হচ্ছে?

স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের শিক্ষক আবদুল মান্নান শিক্ষক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং বিশ্বের একাধিক দেশে দীর্ঘ সময় শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি বলেন, ‘ধরুন ডায়রিয়া। বিষয়টি পড়াতে অ্যানাটমি, ফিজিওলজি, বায়োকেমিস্ট্রি, ইন্টারনাল মেডিসিন ও গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজির শিক্ষক থাকার কথা। শুধু শিক্ষক থাকলেই চলবে না। শিক্ষকের সঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের নিয়মিত যোগাযোগটাও জরুরি।

পাঁচ.

এমবিবিএস কোর্সে দ্বিতীয় বর্ষ থেকেই ক্লিনিক্যাল প্লেসমেন্ট (ওয়ার্ডে রোগীর কাছে যাওয়া) শুরু হয়। বর্তমান পাঠ্যক্রম অনুযায়ী, একেকটি মেডিকেল কলেজে ১১১ জন শিক্ষক প্রয়োজন। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) নির্দেশনায় এমন কথা বলা আছে। কিন্তু সরকারি-বেসরকারি সব মেডিকেল কলেজে শিক্ষকসংকট প্রকট।

স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম এনায়েত হোসেন বলেন, খোদ সরকারি মেডিকেলে শিক্ষকদের মোট পদের ৪০ শতাংশই ফাঁকা।
এনায়েত হোসেনের কথার প্রমাণ পাওয়া যায় নেত্রকোনা ও নীলফামারী সরকারি মেডিকেল কলেজে। দুটি কলেজে শিক্ষকের সংখ্যা যথাক্রমে ৩২ ও ২১। বেসরকারি মেডিকেল কলেজের চিত্রও একই। বিএমডিসির কাছে যে ১৮ বেসরকারি মেডিকেল কলেজের তথ্য আছে, তার কোনোটিতেই পর্যাপ্তসংখ্যক শিক্ষক নেই।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক মহাসচিব ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের বেসিক সায়েন্স অনুষদের সাবেক ডিন এম ইকবাল আর্সলান বলছেন, শিক্ষকসংকট থাকার পরও কোন চিন্তাভাবনা থেকে সরকার একের পর এক মেডিকেল কলেজের অনুমোদন দিচ্ছে, তা বোধগম্য নয়। ভর্তি পরীক্ষায় ৪০ পেলেই বেসরকারি মেডিকেল কলেজে যে কেউ ভর্তি হতে পারছেন। ভর্তির পর এই ছাত্রছাত্রীরা বিপাকে পড়ছেন।

ইকবাল আর্সলান আরও বলেন, সরকারি মেডিকেল কলেজের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। পুরোনো মেডিকেল কলেজগুলোতেই পর্যাপ্ত অবকাঠামোসুবিধা নেই, অথচ কলেজের সংখ্যা বাড়ছে। এখান থেকে ছাত্রছাত্রীরা কী শিখবেন, তাঁরা স্বাস্থ্য খাতেই–বা কী অবদান রাখবেন?

দেশে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ১১৬টি মেডিকেল কলেজ রয়েছে। এর মধ্যে সরকারি মেডিকেল কলেজের সংখ্যা ৩৭।

ছয়.

ভাইবোন বা সন্তান আত্মহত্যা করেছেন—এমন তিনটি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা হয়। আত্মঘাতী এই শিক্ষার্থীদের কেউ-ই পরিবারের সঙ্গে তাঁদের বেদনা ভাগাভাগি করেননি।

জান্নাতুল ওয়াদিয়ার বাবা চাঁপাইনবাবগঞ্জের একটি কলেজের অধ্যক্ষ মতিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘মেয়ে যে পাস করতে পারছে না, এটি আমরা জানতেই পারিনি। পরে শুনেছি, সে পড়া মনে রাখতে পারছিল না। আমি অভিভাবকদের বলি, ছেলেমেয়েদের সঙ্গে দূরত্ব রাখবেন না।’

রংপুরের বেসরকারি প্রাইম মেডিকেল কলেজের ছাত্র আহমেদ বিন রাফির বোন শাওন সিফফাতও পেশায় চিকিৎসক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ভাইটি যে এমন করবেন, তা কখনো কল্পনাও করতে পারেননি। দুবার অ্যানাটমিতে ফেল করেছিলেন তিনি।

মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রাক্তন একজন ছাত্র হিসেবে বলব, মেডিকেল কলেজের পাঠ্যক্রম খুব শুষ্ক। কলেজে সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা দরকার। শিক্ষার্থীরা হয়রানির শিকার হলেও মনোরোগ চিকিৎসা বিভাগে যায় না।

মনোরোগ চিকিৎসকের পরামর্শ নিলে হয়রানি আরও বাড়তে পারে—এ আশঙ্কা থেকে তারা রোগ পুষে রাখে।’ তবে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর বলছে, শিক্ষার্থীদের হতাশা কাটাতে মেডিকেল কলেজগুলোয় বিশেষ কর্মসূচি শুরু হয়েছে। এতে মনোরোগ চিকিৎসকেরা ক্লাস নেওয়ার পাশাপাশি তাঁদের মানসিকভাবে চাঙা রাখতে নানা পরামর্শ দেন।

সাত.

সমস্যা যা-ই হোক, প্রতিবছরই মেডিকেলে ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের আবেদন বাড়ছে। যেমনটি বলছিলেন চট্টগ্রামে প্রিমিয়ার ইংলিশ স্কুলের অধ্যক্ষ ফারজানা মুনমুন। তিনি বলেন, ‘আমরা ছোটবেলায় রচনা লিখেছি, বড় হলে ডাক্তার হতে চাই। এখনো তা–ই। অথচ একটা সমাজ বা রাষ্ট্রের ভারসাম্য রাখতে অর্থনীতিবিদ, দার্শনিক, ইতিহাসবিদ, রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে নানা পেশার মানুষ প্রয়োজন। অভিভাবকদের এবার এটা বোঝানো দরকার।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে এমবিবিএস কোর্সে আবেদন করেন ৬৫ হাজার ৯১৯ প্রার্থী। এরপর ২০১৯ সালে ৬৯ হাজার ৪০৫, ২০২০ সালে ১ লাখ ২২ হাজার ৮৭৪, ২০২১ সালে ১ লাখ ৩৯ হাজার ৭৪০ এবং ২০২২ সালে ১ লাখ ৪৩ হাজার ৭৩০টি আবেদন পড়েছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সহ–উপাচার্য রশিদ-ই-মাহবুব প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের সময়ও পরিবারের চাপে ছেলেমেয়েরা মেডিকেলে ভর্তি হতো। ভালো না লাগলে ছেড়ে দিত। আত্মহত্যা করত না।’

রশিদ-ই-মাহবুব তাঁর দুই সহপাঠী গাজী মাজহারুল আনোয়ার ও জিয়া আনসারীর কথা উল্লেখ করে বলেন, ভালো লাগেনি বলে মেডিকেল কলেজ ছেড়ে দিয়েছিলেন এ দুজন। তাঁদের মধ্যে মাজহারুল আনোয়ার দেশের শীর্ষস্থানীয় গীতিকার, জিয়া আনসারী সেরা নাট্যকারদের একজন। দুজনই মেডিকেলে পড়ালেখা ছেড়ে নিজ নিজ ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রেখেছেন।

রশিদ-ই-মাহবুব আরও বলেন, এখন দুটি বিষয় দেখা দরকার—প্রথমত, শিক্ষার্থী মেডিকেলে পড়তে চান কি না এবং দ্বিতীয়ত, পড়তে চাইলে তাঁর যোগ্যতা আছে কি না।