এক বছরে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ১৪৭টি: কাপেং ফাউন্ডেশন

‘বাংলাদেশের আদিবাসীদের সামগ্রিক মানবাধিকার পরিস্থিতি শীর্ষক জাতীয় পর্যায়ে সংলাপ’–এ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা তুলে ধরে বেসরকারি সংগঠন কাপেং ফাউন্ডেশন। আসাদগেট, ঢাকা, ৩১ জানুয়ারিছবি: প্রথম আলো

বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষেরা ২০২৩ সালে ১৪৭টি ঘটনায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে নারীদের প্রতি সহিংসতার ২৩টি ঘটনায় মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে। আর ভূমিসংক্রান্ত ৩৫টি এবং নাগরিক ও রাজনীতি–সংক্রান্ত ৮৯টি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে।

বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন কাপেং ফাউন্ডেশন এ তথ্য তুলে ধরে। আজ বুধবার সকালে রাজধানীর আসাদগেটের ক্যাথলিক বিশপ কনফারেন্স বাংলাদেশ (সিবিসিবি) সেন্টারে ‘বাংলাদেশের আদিবাসীদের সামগ্রিক মানবাধিকার পরিস্থিতি শীর্ষক জাতীয় পর্যায়ে সংলাপ’–এ এসব তথ্য তুলে ধরা হয়।

কাপেং ফাউন্ডেশন নিজস্ব নেটওয়ার্ক, স্থানীয় নেতাদের তথ্য ও বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো পেয়েছে বলে প্রথম আলোকে জানিয়েছে।

সংলাপে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কাপেং ফাউন্ডেশনের প্রকল্প কর্মকর্তা মনজুনি চাকমা। প্রবন্ধে ২০২৩ সালে বাংলাদেশে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানবাধিকার পরিস্থিতি তুলা ধরা হয়। এতে তিনি গত বছরের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের ওপর সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোর সংখ্যা ও কারণ বিশ্লেষণ করা হয়।

মনজুনি চাকমা তাঁর উপস্থাপনায় বলেন, গত বছর নারীদের প্রতি সহিংসতার ২৩টি ঘটনায় মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে। এসব ঘটনায় ২৪ জন নারীকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ৩ জন নারীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। অন্তত ৭ জন নারীকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। দুজন নারীকে হত্যা করা হয়েছে। এঁদের একজন পার্বত্য চট্টগ্রামের, অন্যজন সমতলের।

পাশাপাশি একই সময়ে (২০২৩ সালে) ভূমিসংক্রান্ত ৩৫টি ঘটনায় ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষ মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৮টি এবং সমতলে ১৭টি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। নাগরিক ও রাজনীতি–সংক্রান্ত ৮৯টি ঘটনায় অন্তত ২ হাজার ৩৫৭ জনের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে বলে জানান এই কর্মকর্তা।

সংলাপের প্যানেল আলোচনায় চাকমা সার্কেল প্রধান দেবাশীষ রায় বলেন, পার্বত্য চুক্তির বাস্তবায়নের সঙ্গে বাংলাদেশের বহুত্ববাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, অসাম্প্রদায়িকতা, ইত্যাদি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। কিন্তু ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন-১৯০০’ নিয়ে অনেক ষড়যন্ত্র হচ্ছে। একটি পক্ষ চাইছে না পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষেরা তাঁদের প্রথা ও রীতি অনুসারে তাঁদের অধিকার ভোগ করুক। রেগুলেশন অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রাম যে বিশেষ শাসনব্যবস্থায় পরিচালিত হবে, এটা বলবৎ রাখতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে।

আদিবাসী ও সংখ্যালঘুবিষয়ক পার্লামেন্টারি ককাসের সমন্বয়ক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক মেসবাহ কামাল অভিযোগ করেন, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘এত নিপীড়ন-নির্যাতন হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা টিকে রয়েছেন। আশা করছি, লড়াই-সংগ্রামে তাঁরা জয়ী হবেন। লড়াই চালিয়ে গিয়ে মানুষকে নিশ্চিহ্ন করার পথ বন্ধ করতে হবে।’

লেখক ও গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, গাইবান্ধায় ইপিজেড প্রতিষ্ঠিত করতে চাওয়া, মধুপুরের কৃত্রিম লেক খননের পাঁয়তারার বিষয়গুলো বড় ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন। উত্তরবঙ্গে সেচের পানির জন্য ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের প্রাণ বিসর্জন দিতে হচ্ছে।

জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি ইউজিন নকরেক বলেন, সরকারের সুফল প্রকল্পসহ বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নতুন নতুন মামলা করা হচ্ছে। নেত্রকোনায় নির্বিচার বালু উত্তোলন হচ্ছে। এতে নদীর পাড় ভাঙছে, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ওই এলাকার ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষেরা।

সংলাপে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সচিব সেবাস্টিন রেমা। তিনি বলেন, রাষ্ট্র মানবাধিকার রক্ষা ও প্রতিষ্ঠিত করে। তবে বিভিন্ন কারণে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়। বিভিন্ন সময়ে করা মানবাধিকার প্রতিবেদনগুলোও আলোর মুখ দেখে না, বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন কাজ করার চেষ্টা করছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে তৈরি প্রতিবেদন শিগগিরই সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পৌঁছে দেওয়া হবে।

কাপেং ফাউন্ডেশনের ফাল্গুনী ত্রিপুরার সঞ্চালনায় ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমার সভাপতিত্বে সভায় আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সহসাধারণ সম্পাদক গজেন্দ্রনাথ মাহাতো, রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট কালেকটিভের (আরডিসি) সাধারণ সম্পাদক জান্নাত-ই ফেরদৌসী, উত্তরবঙ্গের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধি বিষুরাম মুর্মু, বান্দরবানের লামা উপজেলার কারবারি লাংকম ম্রোসহ পাহাড় ও সমতলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ছাত্রসংগঠনগুলোর নেতারা।