সুন্দরবনের খালপাড়ে বিপন্ন মদনটাক

সুন্দরবনের নীলকমল ফরেস্ট স্টেশনের অদূরে খালের পাড়ে বিপন্ন মদনটাক। গত ১০ সেপ্টেম্বর খুলনার কয়রা উপজেলায়
ছবি: প্রথম আলো

ঘড়িতে ঘণ্টার কাঁটা সাড়ে সাতটা ছুঁই ছুঁই। গোলগাল লাল সূর্যটা একটু একটু করে রোদ ছড়াতে শুরু করেছে। সকালের রোদ আঁচল বিছিয়েছে সুন্দরবনের বুকে। গহিন সুন্দরবনের নীলকমল ফরেস্ট স্টেশনের সামনের খাল ধরে আমাদের ছোট নৌকাটি এগিয়ে চলছে। কিছু দূর গিয়ে বনের ‘বন্ধের গাঙ’ এলাকার তিন খালের সংযোগস্থলে চোখ আটকে যায়। খালপাড়ে দুই পায়ের ওপর ভর করে শরীর-মাথা টানটান করে দাঁড়িয়ে আছে লম্বা ঠোঁটের বিশালদেহী এক পাখি।

সঙ্গে থাকা সুন্দরবনের নীলকমল ফরেস্ট স্টেশনের কর্মকর্তা জহিরুল ইসলাম জানালেন, পাখিটি খুব বেশি চতুর না, মাথায়ও টাক। তাই পাখিটাকে বলা হয় মদনটাক! এখন আর সচরাচর এ পাখি দেখা যায় না।

বিপন্নপ্রায় পাখিগুলোর একটি এই মদনটাক। অপ্রতুল বাসস্থান, জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবে এদের অস্তিত্ব আজ বিলুপ্তির পথে। আবাস মূলত দক্ষিণ এশিয়াজুড়েই; তবে কয়েকটি দেশ থেকে এরই মধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বাংলাদেশের সুন্দরবনেই কদাচিৎ দেখা মেলে পাখিটির। কদাচ উত্তরবঙ্গ ও সিলেটে দেখা যায়।

মদনটাক পাখির পিঠের দিকটা কালো। তবে তাতে নীলাভ আভা জড়ানো। মাথার তালু, কপাল, গলা পালকহীন। তবে গোলাকার মাথার পেছন দিকের দুই পাশে দু-চার গাছি করে চুল-পালকও আছে। গলা হলুদ চামড়া দিয়ে আবৃত। চোখ ধূসর সাদা। শক্ত ঠোঁটের রং ময়লাটে হলুদ। প্রজনন মৌসুমে ঠোঁটের গোড়া লালচে হয়। লেজের প্রান্ত ময়লাটে সাদা। বুক, পেট, ডানার নিচ ও লেজের তলা মাখনের মতো সাদা রঙের। লম্বা পা ও পায়ের পাতা কালো।

মদনটাকের ইংরেজি নাম ‘লেসার অ্যাডজুট্যান্ট’। বৈজ্ঞানিক নাম Leptoptilos javanicus। এটি লম্বায় ৮৭ থেকে ৯৩ সেন্টিমিটার (৩৪ থেকে ৩৭ ইঞ্চি)। পায়ের উচ্চতা ১১০ থেকে ১২০ সেন্টিমিটার। ওজন চার থেকে সাড়ে পাঁচ কেজি হয়।

স্ত্রী-পুরুষ মদনটাক দেখতে একই রকম। তবে পুরুষগুলো বড় ও পেটমোটা হয়। অপ্রাপ্তবয়স্ক মদনটাকের পিঠ অনুজ্জ্বল কালো ও মাথায় এবং ঘাড়ে পালক দেখা যায়।

মদনটাক নোনাজলের বন, নদী বা খালের মোহনায় বিচরণ করে। সচরাচর এরা একাকী চলাফেরা করতেই ভালোবাসে। পাখিটি অগভীর পানির ধারে, ঘাসযুক্ত এলাকা অথবা নরম কাদায় খাবার খুঁজে খায়। প্রধান খাদ্য মাছ। এ ছাড়া ব্যাঙ, সরীসৃপ, কাঁকড়া ও বিভিন্ন জলজ প্রাণী খায়। অনেক সময় মৃত পশুও খেতে দেখা যায়। ওড়ার আগে উড়োজাহাজের মতো লম্বা দৌড় দিয়ে তারপর ওড়ে। সচরাচর নীরব থাকে, কখনো কখনো ঠোঁটের সাহায্যে ঠক্ ঠক্ শব্দ করে।

মদনটাকের প্রজনন মৌসুম নভেম্বর থেকে জানুয়ারি। এ সময় বনের উঁচু কোনো গাছের মগডালে ডালপালা দিয়ে মাচানের মতো বাসা বানায়। একই বাসা টুকটাক মেরামত করে বছরের পর বছর ব্যবহার করে। স্ত্রী মদনটাক তিন থেকে চারটি পর্যন্ত ডিম দেয়। ডিমের রং সাদা। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৮ থেকে ৩০ দিন। মা–বাবা মিলেমিশে ছানাদের খাওয়ায় ও যত্ন করে। ছানারা ৩০-৩৫ দিনে উড়তে শিখে বাসা ছাড়ে। আয়ুষ্কাল প্রায় ১৬ বছর।

তবে সুন্দরবনের ভেতরে প্রতিবছরই মদনটাকের সংখ্যা কমছে বলে পাখিগবেষকদের ধারণা। এর প্রধান কারণ হলো খাবারের সমস্যা। সুন্দরবনের ভেতর গত কয়েক বছর অবৈধভাবে বিষ প্রয়োগে প্রচুর মাছ ধরা হয়েছে। বিষক্রিয়ায় অনেক মৃত মাছ খাল দিয়ে ভেসে যায়।

এসব মাছ খেয়ে পাখিটির প্রজননপ্রক্রিয়ায় সমস্যা হতে পারে অথবা সরাসরি বিষক্রিয়ায় পাখি মারাও যেতে পারে। তবে পাখিটি আরও কী কী কারণে কমে যাচ্ছে, এর জন্য বিশদ গবেষণা দরকার।

সুন্দরবন সংরক্ষণকাজে বন অধিদপ্তর বড় বড় উদ্যোগ নিচ্ছে। বেশ কিছু প্রজাতি সংরক্ষণে সাফল্যও এসেছে। মদনটাকটিও যেন হারিয়ে না যায়, সেদিকেও দৃষ্টি রাখা জরুরি।