অজ্ঞাত স্থানে রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্রকে নির্যাতনের অভিযোগ, সারা শরীরে ক্ষত

রাব্বীর শরীরে নির্যাতনের ক্ষত
ছবি: প্রথম আলো

হাতে, কাঁধের নিচে, বুকে ধারালো অস্ত্রের পোঁচ। হাঁ হয়ে থাকা ক্ষততে সেলাই পড়েছে সদ্য। সচিবালয়ের পাশে জাতীয় প্রেসক্লাবের ছোট ফটকের কাছে একটা চেয়ারে এমন আঘাত নিয়ে প্রায় অচেতন অবস্থায় রোববার বিকেলে বসেছিলেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাব্বী হোসেন শুভ। এক মাস অজ্ঞাত জায়গায় আটকে রেখে অপহরণকারীরা তাঁর ওপর নির্যাতন চালিয়েছে বলে পরিবারের অভিযোগ।
আজ রোববার রাব্বীকে নিয়ে পরিবারের সদস্যরা জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে আসেন বিচারের দাবিতে।

রাব্বীর বাবা মো. আলী ও মা জেমি পারভিন ছেলের ওপর ঘটে যাওয়া এই অকথ্য নির্যাতনের বিচার চান। এই দম্পতি এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে থাকেন ধানমন্ডিতে। তাঁদের গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জে। মো. আলী প্রথম আলোকে বলেন, গত ২০ মার্চ রাতে ছেলে মায়ের জন্য ওষুধ কিনতে বাইরে বেরিয়েছিলেন। তারপর থেকে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত রাব্বী নিখোঁজ ছিলেন। কোথাও তাঁকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। ১৫ এপ্রিল সন্ধ্যার পর রামপুরা থানার এক উপপরিদর্শক তাঁকে ফোন করে জানান, রাব্বীকে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় একটা ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়েছে। তিনি যেন দ্রুত ওই ক্লিনিকে চলে যান। সেখানে যাওয়ার পর চিকিৎসকদের পরামর্শে ছেলেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান মো. আলী। ক্ষততে সেলাইয়ের পর ছেলেকে নিয়ে তাঁরা তাঁদের ধানমন্ডির বাসায় চলে যান।

রাব্বী প্রথম আলোকে বলেন, অপহরণকারীরা তাঁকে একটি ঘরে আটকে রেখেছিল। অনেকবার তারা তাঁর শরীরে ইনজেকশন দিয়েছে। একপর্যায়ে তারা তাঁর চুল কেটে দেয়। শরীরের নানা জায়গায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে পোঁচ দিয়েও ক্ষান্ত হয়নি তারা। ক্ষতে লবণ ছিটিয়ে দেয়। অপহরণকারীদের কেউ কেউ তাঁকে খুনের পরিকল্পনাও করছিল।

একজন গলার কাছে ছুরি ধরেছিল। কিন্তু অপর একটি পক্ষ তাদের বাধা দেয়। তাদের যুক্তি ছিল রাব্বীকে বাঁচিয়ে রাখলেই আখেরে লাভ। সাময়িক লাভের জন্য তাঁকে হত্যা করে লাভ নেই। রাব্বি জানান, প্রায় এক মাস তিনি একরকম ঘোরের মধ্যে ছিলেন। শেষ দিনে তাঁকে গোসল করার সুযোগ দেয় অপহরণকারীরা। তাঁর কাছ থেকে অপহরণকারীদের দাবি কী ছিল? জানতে চাইলে রাব্বী বলেন, তাঁর মাকেও হত্যার চেষ্টা হয়েছিল একসময়। খুনের চেষ্টার বেশ কিছু আলামত তাঁরা রেখে দিয়েছেন। অপহরণকারীরা ওই আলামতগুলো চায়। তা ছাড়া অপহরণকারীদের বিরুদ্ধে তাঁর মা আগেই যেসব মামলা করেছেন, সেগুলো তুলে না নিলে হত্যার হুমকি দেয়।

অপহরণকারীরা রাব্বীর একমাত্র ছোট বোনকে শেষ করে ফেলারও হুমকি দিয়েছে।
রাব্বী নিখোঁজ হওয়ার পর মো. আলী ধানমন্ডি মডেল থানায় একটি মামলা করেন। ওই মামলায় তিনি সন্দেহভাজন পাঁচজন অপহরণকারীর নাম উল্লেখ করেন। আরও লেখেন, অপহরণকারীদের সঙ্গে তাঁর স্ত্রী জেমি পারভিনের জমিজমাসংক্রান্ত বিবাদ রয়েছে। বিবাদের জেরে দুই পক্ষই একে অন্যের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা করেছে। জেমি পারভিনকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে সিরাজগঞ্জে এবং অপহরণের অভিযোগে ঢাকায় মামলা করেছিলেন মো. আলী। জেমি পারভিনের নামেও বিরোধী পক্ষ মামলা করেছে।

রাব্বীর শরীরে নির্যাতনের ক্ষত
ছবি: প্রথম আলো

ধানমন্ডি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইকরাম আলী মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, অপহরণের মামলাটি পুলিশ তদন্ত করে দেখছে। রাব্বীকে রামপুরা থেকে একজন রিকশাচালক উদ্ধার করে প্রথমে স্থানীয় একটি ক্লিনিকে নিয়ে যান। ধানমন্ডি থানার পুলিশ রাব্বীর সঙ্গে কথা বলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। প্রাথমিক চিকিৎসার পর রাব্বীকে আদালতে হাজির করা হয়। সেখানে একজন বিচারিক হাকিমের কাছে রাব্বী তাঁর বক্তব্য দিয়েছেন। অপহরণের শিকার পরিবার ও অপহরণকারী হিসেবে যাদের কথা বলা হয়েছে, দুই পক্ষের বাড়িই সিরাজগঞ্জ।

পুরোনো মামলা–মোকদ্দমাও আছে। পুলিশ স্থানীয় পুলিশের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখছে।
মো. আলী পেশায় একজন ব্যবসায়ী, জেমি গান করেন। রাব্বী রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুল থেকে এসএসসির পর বিএএফ শাহীন কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে পড়েছেন। আজ কথা বলতে বলতে একপর্যায়ে চেয়ার থেকে পড়ে যান রাব্বী। তিনি বারবার বলতে থাকেন, ‘ওরা আমাকে মেরে ফেলবে বলেছে। আমি বাঁচতে চাই।’