অনেক মানুষ, অনেক বই

অমর একুশে বইমেলায় পছন্দের বই দেখছেন শিশু ও অভিভাবকেরা। গতকাল রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে।
ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

বইমেলার রেশ যে মেলার বাইরেও ছড়াতে পারে, সে দৃশ্য দেখা গেল সাপ্তাহিক ছুটির দ্বিতীয় দিনে গতকাল শনিবার। টিএসসির সামনের গেটে খুচরা পণ্য বিক্রির দোকানে বসে বাংলা স্বরবর্ণের বই পড়ছিল ছিন্নমূল দুই শিশু। তারা জানাল, এক ব্যক্তি তাদের বইটি উপহার দিয়েছেন। এমন চমৎকার একটি দৃশ্য দেখতে দেখতে গতকাল বিকেলে মেলার প্রবেশমুখে পৌঁছেছেন অনেক বইপ্রেমী। গতকাল নতুন বইও এসেছে ১১৯টি।

বইমেলায় গত শুক্রবারের তুলনায় শনিবার বিকেলে ভিড় সামান্য কম ছিল। তবে সন্ধ্যা ছয়টার দিকে হঠাৎই শুরু হলো জনস্রোত। স্বাধীনতাস্তম্ভের চারপাশজুড়ে মানুষের বসার জায়গা। সেখানে তিনজনের জায়গায় পাঁচজনও গাদাগাদি করে বসেছে। মানুষ আসছে, বই দেখছে, পরিচিতজনের সঙ্গে ছবি তুলে রাখছে।

মৌলভীবাজারের সুমন সুপান্থ দুদিন পরই ফিরে যাবেন যুক্তরাজ্যের প্রবাসজীবনে। শেষ সময়ে বইমেলায় এসেছেন পরিচিতজনদের দেখা পেতে। জানালেন, গত দুই বছর আসতে পারেননি। এ বছর শুধু বইমেলার জন্যই দেশে এসেছিলেন। অনেক দূরে যাওয়ার আগে মেলায় যাঁকে দেখছেন, তাঁকেই আপন মানুষ মনে হচ্ছে বলে জানালেন তিনি।

শত শত মানুষের এ নানা রকম আবেগের সাক্ষী হয়ে থাকছে এবারের অমর একুশে বইমেলা। করোনার জন্য গত বছর তো মেলায় মানুষই আসেনি বলে মন্তব্য করলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার শিক্ষক গওহর গালিব। কথা প্রসঙ্গে গালিব বললেন, করোনার পর থেকে মেলায় মানুষের আচরণেও পরিবর্তন এসেছে। কারও সঙ্গে দেখা হলে ওই মুহূর্তই বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। কিছুক্ষণ আগে যে আরেকজনকে দেখা করার কথা দিয়েছিলেন, তা ভুলে যাচ্ছেন। এর কারণ, মৃত্যুর আতঙ্ক মানুষের জীবনে সবকিছু ক্ষণস্থায়ী, এ বোধ এনে দিয়েছে।

বইমেলায় গতকাল যে লেখকদের বই প্রকাশিত হয়েছে, তাঁদের অনেকেই মেলায় উপস্থিত ছিলেন। কেউ স্টলের ভেতরে, কেউ সামনে দাঁড়িয়ে পাঠকদের সঙ্গে বই নিয়ে কথা বলেছেন। অনন্যা প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী মনিরুল হক বললেন ‘এবার তুলনামূলকভাবে নতুনদের বইয়ে বেশি আগ্রহ পাঠকের। সংকলন বা একটু গম্ভীর বই মানুষ পড়তেই চাচ্ছে না। এর একটি কারণ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রচারণা।’

চৈতন্য প্রকাশনীর রাজীব চৌধুরী প্রকাশনার কাজ করেন সিলেটে থেকে। মোটামুটি গুছিয়ে আনার পর তিনি মেলায় আসছেন দুদিন ধরে। রাজীব জানালেন, অনুবাদের বইয়ে আগ্রহ বাড়ছে পাঠকের। চৈতন্য থেকে এগিয়ে কথাপ্রকাশের দিকে যেতেই দেখা লেখক, অনুবাদক আফসানা বেগমের সঙ্গে। তিনি বলছিলেন, ‘অনুবাদের বইয়ে মূল নামটি থাকলে পাঠক সহজে সংযোগ অনুভব করে। অনেক সময় ভাষান্তর হলে পাঠক ঠিক বুঝতে পারে না এটি কোন বই।’

বইমেলায় প্রবেশমূল্য থাকা উচিত কি না, সে আলোচনা এখনো চলছে। যদিও কর্তৃপক্ষ এবার কোনো প্রবেশমূল্য রাখেনি। ঢাকার মোহাম্মদপুর থেকে আসা নিজাম উদ্দিন আর তাঁর দুই বন্ধু কথা বলছিলেন বইমেলায় টিকিট নিয়ে। জানতে চাইলে বললেন, ‘প্রবেশমূল্য নির্ধারণ করা চলবে না। তবে যদি করেই বসে, ২০ টাকা হলেও চলবে।’

নতুন বই

শনিবার মেলায় যে ১১৯টি নতুন বই এসেছে, তার মধ্যে গল্প ১০টি, উপন্যাস ১৫টি আর কবিতার বই ৩৫টি। বাকিগুলো অন্যান্য বই। এবারের মেলায় ১২ দিনে নতুন বইয়ের সংখ্যা দাঁড়াল ১ হাজার ৩৬২। গতকাল নতুন বইয়ের মধ্যে আগামী প্রকাশনী এনেছে মোহাম্মদ আবু সালেহর প্রবন্ধ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও রবীন্দ্র বিতর্ক, আহমদ পাবলিশিং হাউস থেকে এসেছে শাহ্ সিদ্দিকের প্রবন্ধ রাজধানী ঢাকার রাজকাহন, আদর্শ প্রকাশনী এনেছে শাকিল আহমেদের বাংলাদেশ রেলওয়ের ইতিহাস গ্রন্থ। অন্বয় প্রকাশন থেকে এসেছে শাহেদ ইকবালের রহস্যগল্প জাদুনগরীর চাবি, আদর্শ এনেছে মোরশেদ শফিউল হাসানের গল্পের বই আত্মপক্ষ ও অন্যান্য গল্প, নিমফিয়া এনেছে পার্থ সন্‌জয়ের চলচ্চিত্রবিষয়ক ভ্রমণগদ্য কান ডায়েরি ওহ্ বাংলাদেশ!, নাসরীন জাহানের সমুদ্র আমার একলা জলের নাম কবিতার বইটি কয়েক দিন আগেই মেলায় এনেছে অনার্য পাবলিকেশন।

মেলার অন্য আয়োজন

গতকাল মেলা বেলা ১১টা থেকে শুরু হয়ে চলে রাত ৯টা পর্যন্ত। বিকেলে মূলমঞ্চে আয়োজিত হয় ‘অমর একুশে সাহিত্য ও সংস্কৃতি’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ। সভাপতিত্ব করেন মফিদুল হক। আর গেটের বাইরে প্রতিদিনের মতো সালাহউদ্দিন মিয়া বাজাচ্ছিলেন তাঁর হাতে বানানো বেহালা। পুরোনো দিনের বাংলা গানের সুর শুনে বই হাতে দাঁড়িয়ে পড়ছিলেন মেলায় আসা কেউ কেউ।