আয় আয় চাঁদ মামা

মা, শিশু আর চাঁদের মধ্যে কি কোনো একটা সম্পর্ক আছে? মায়ের কোলে শিশু থাকে, মা ভাবেন, খোকনসোনা, এ তো চাঁদের কণা! আর মায়ের কোলে বসা শিশু আকাশের চাঁদ দেখে হাত বাড়ায়, অস্ফুট নানা কথা কইতে থাকে। মা সুর করে ছড়া বলতে থাকেন, আয় আয় চাঁদ মামা, টিপ দিয়ে যা, চাঁদের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যা। আমি নিশ্চিত, আমার মা–ও প্রথম আমাকে এই ছড়াটাই শুনিয়েছিলেন। আর ঘুম পাড়ানোর সময়? ঘুমপাড়ানি মাসি পিসি মোদের বাড়ি এসো, খাট নাই পালং নাই, চোখ পেতে বসো। বাটা ভরে পান দেব, গাল ভরে খেয়ো, খোকার চোখে ঘুম নাই ঘুম দিয়ে যেয়ো।

মায়েদের গায়ে একটা অদ্ভুত গন্ধ থাকত। বোধ হয় তেল-হলুদ–মসলার ঘ্রাণ। মায়ের বুকে মাথা রেখে, মায়ের হাতের আদরের চাপড় খেতে খেতে আমরা ঘুমিয়ে পড়তাম।
আরেকটা ছড়া আমাদের কালের মায়েরা–খালারা সুর করে বলতেন। খোকা ঘুমাল পাড়া জুড়াল বর্গি এল দেশে...বর্গির ভয়েই হোক, মায়েদের ছড়াগানের সুরের মায়ায় হোক, আমরা ঘুমিয়ে পড়তাম। আতাপাতা হাহা, আগডুম বাগডুম এসব ছড়া তো চলতই।

আমার আম্মা রূপকথার গল্পও বলতেন। সেই গল্পটা খুব করুণ ছিল। আমার ভাইবোনেরা আমার চেয়ে বড় ছিল। রাতে আম্মার পাশে শুয়ে তারা এই গল্প বারবার শুনত। আমি শুনতে পারতাম না। খুব দুঃখের গল্প। রাজপুত্র পাষাণ হয়ে গেছে। তার মা ছেলের জন্য কাঁদছে...আমি ভয়ে–দুঃখে ঘুমিয়ে পড়তাম।

আমরা বাবা-মা হওয়ার পর টুইংকেল টুইংকেল, বা বা ব্ল্যাকশিপও ঘুমপাড়ানি ছড়ার জায়গা নিতে শুরু করে। আর এখন তো বাচ্চারা মোবাইল ফোন দেখলেই কেড়ে নেয় আর চলে যায় ইউটিউবে...ছড়াগান বের করে নিজেরাই শোনে...ক-য়ে কলা খ-য়ে খাই থেকে শুরু করে টু লিটল ব্ল্যাক বার্ডস পর্যন্ত।

ভাষাবিজ্ঞানীরা কী বলবেন? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিউনিকেশন ডিজঅর্ডার বিভাগের চেয়ারপারসন তাওহিদা জাহান বলেন, ‘যে শিশু মাতৃভাষা ভালো করে শেখে, সে অন্য ভাষাও ভালো করে শিখতে পারবে।’ তিনি বলেন, ‘শিশুর ভাষা বিকাশের ক্ষেত্রে শূন্য থেকে চার বছর খুব গুরুত্বপূর্ণ। এ সময় শিশু তার চারপাশ থেকে ভাষিক তথ্য সংগ্রহ করে তার সর্বজনীন ব্যাকরণ–কাঠামোর সঙ্গে মিলিয়ে তার ভাষাবোধ তৈরি করে। তাই শিশুকে প্রথমেই মাতৃভাষার পারিপার্শ্বিক যে সংস্কৃতি বিদ্যমান তার সঙ্গে আত্মস্থ করার ক্ষেত্রে সহায়তা করতে হবে। যাতে সে মাতৃভাষার ব্যাকরণ–কাঠামোকে তার ভাষাবোধের মধ্যে ধারণ করতে পারে। এটি সম্ভব হলে পরে অন্য যেকোনো ভাষা শেখা তার জন্য সহজতর হয়।

‘দৃশ্যমান ও শ্রবণ—দুটি মাধ্যম শিশুর ভাষার বিকাশের সময়ে বড় ভূমিকা রাখে। সে ক্ষেত্রে শিশু যদি টেলিভিশনে বা অনলাইনে মাতৃভাষার ছড়া, গান বা যেকোনো ভিডিও দেখে সেটি তার ভাষাবোধ তৈরি করার ক্ষেত্রে তাৎপর্য রাখে।

‘তবে কোনো বাংলাভাষী শিশু যদি ভাষিক বিকাশের সময়ে একসঙ্গে বাংলা, ইংরেজি বা হিন্দি ভাষায় ইনপুট গ্রহণ করে সে ক্ষেত্রে একের অধিক ভাষা তার ভাষাবোধে ধারণ করতে ও প্রক্রিয়াকরণ করতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। এর ফলে তার ভাষা অর্জন দেরিতে হতে পারে। সে ক্ষেত্রে শিশুর প্রথম ভাষা মাতৃভাষা হওয়াই বাঞ্ছনীয়।’

আপনার সন্তানকে আপনি কোন বাংলা গান বা ছড়া শুনিয়ে ঘুম পাড়ান? বা আপনি যখন ছোট ছিলেন আপনাকে কোন গান বা ছড়া শুনিয়ে ঘুম পাড়ানো হতো? সন্তানের সঙ্গে আপনার বিশেষ মুহূর্ত আমাদের ভিডিও করে পাঠান। বা আপনার ছোটবেলার স্মৃতি লিখেও পাঠাতে পারেন এই ঠিকানায় ghumparani.com.
আপনার ভিডিও বা লেখাটি পাঠাতে হবে ২২ ফেব্রুয়ারির মধ্যে। অংশগ্রহণকারীদের মধ্য থেকে নির্বাচিত বিজয়ীদের জন্য থাকবে আকর্ষণীয় পুরস্কার।

* লেখক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক