রাজধানীর উত্তরার ১৩ নম্বর উদ্যানের মাঠের ঠিক মাঝখানে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে শরীরচর্চার পর্বগুলো সেরে নিচ্ছিলেন জনাদশেক প্রবীণ ব্যক্তি। তখনো সূর্যের আলো ছড়ায়নি সেভাবে। আকাশে মেঘের ঘনঘটা, অনেকটা বৃষ্টি হবে হবে ভাব। শরীরচর্চায় ব্যস্ত ব্যক্তিদের সেদিকে মন নেই, তাঁদের সতেজ চেহারায় হাসি। ভোরের নির্মল বাতাস আর স্নিগ্ধ প্রকৃতির ছোঁয়ায় কোথায় যেন হারিয়ে গেছেন তাঁরা।

শহরে ‘জীবন’ বলতে বোঝায় অফিসের কাজ, যানজট, গাড়ির শব্দ, ধোঁয়া, ধুলা আর নানা হতাশার গল্প। আর এমন জীবনে দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে তাঁরা আজ অনেকটাই ক্লান্ত। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া শরীর যেন সব সময় খুঁজে বেড়ায় একটু প্রশান্তি, একটু ভালো লাগার কারণ। তাই সকালের শুরুতে প্রকৃতির কাছে আসেন তাঁরা।

হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হলে কী করবেন, এমন প্রশ্ন করতেই ব্যায়ামের ফাঁকে ষাটোর্ধ্ব এক বৃদ্ধের উত্তর, ‘সকালের সতেজতার সঙ্গে আকাশের মেঘ বা অন্য কিছু নিয়ে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। একটু পরই শুরু হবে নগরজীবনের কর্মব্যস্ততা। তখন শত চেষ্টা করলেও মুহূর্তটুকু ফিরে পাওয়া যাবে না। তাই সামান্য বৃষ্টির হাতছানিতে ভয় পাই না আমরা।’

কথা শেষ না হতেই ব্যায়াম থামিয়ে কথা ধরলেন মো. মুস্তাফিজুর রহমান নামের এক প্রকৌশলী। তিনি বললেন, ‘এটা আমাদের ফুয়েল (শক্তি) নেওয়ার জায়গা। আমরা প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিটের জন্য হলেও এখানে আসি। সবাই একত্র হই। শরীরচর্চার পাশাপাশি গল্প, হাসিঠাট্টা করে সময় কাটাই। এতে শরীর, মন—দুটোই ভালো থাকে। আর দিনের শুরুটাও হয় খুব সুন্দরভাবে।’

তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই ঘড়িতে সময় সকাল সাড়ে ছয়টা। ততক্ষণে আকাশের মেঘ সরে গেছে। অল্প অল্প করে রোদ ছড়াতে শুরু করেছে সূর্য। এক এক করে মাঠে জড়ো হচ্ছেন নানা বয়সের মানুষ। এর মধ্যে ফুটবল হাতে মাঠে হাজির হতে দেখা গেল ১২ থেকে ১৩ সদস্যের একটি দলকে (কিকব্যাক গ্রুপ)। তাঁদের বয়স ৩০ থেকে ৫৫ বছরের মধ্যে। কিছুটা সময় দল বেঁধে শরীরচর্চা শেষে দুই দলে ভাগ হয়ে নেমে পড়লেন মাঠে। তাঁদের হাসি-হইহুল্লড়ে মুখর চারপাশ।

খেলা শুরুর আগে কথা হচ্ছিল মুশফিকউল ইসলাম মারুফ নামের একজনের সঙ্গে। তিনি একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের তথ্য ও প্রযুক্তি বিভাগের প্রধান। তিনি বলেন, ‘প্রতিদিনই বাচ্চাদের স্কুল, টিউশন আর অফিসের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়। দিন শেষে একঘেয়েমি ভাব চলে আসে। কিন্তু দিনের শুরুটা একটু বিনোদন বা হাসিমুখে শুরু হলে সারা দিন কর্মোদ্যম পাওয়া যায়। এখানে আমরা সবাই পরিবারের মতো।’
খেলার মাঠ পেরিয়ে কিছুটা সামনে এগোতেই নারীদের জন্য আছে একটি বিশাল উদ্যান।

ভেতরে প্রচুর গাছপালা। তার মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে হাঁটাপথ বা ওয়াকওয়ে। আর সবার মাঝখানে রয়েছে বিশাল ডালপালা বিস্তৃত একটি বটগাছ। গাছের নিচে সুবিন্যস্ত বেঞ্চ। এমন পরিবেশে উদ্যানে আসা নারীদের কেউ হাঁটছেন, কেউবা বসে গল্প করছেন বটতলায়।

উদ্যানের মূল ফটক ধরে ভেতরে ঢুকতেই হাতের বায়ে একটি বেঞ্চে বসে গল্প করছিলেন মাঝবয়সের তিন নারী নিলুফা, জেসমিন ও ইভা খানম। পাশেই কোনো এক মুঠোফোন থেকে মৃদু শব্দে ভেসে আসছিল রবীন্দ্রসংগীত—‘মোর বীণা ওঠে কোনো সুরে বাজি/কোন নব চঞ্চল ছন্দে’ গান। নিলুফারা গল্পের মাঝেই যেন হারিয়ে যাচ্ছিলেন সেই গানে।

পরিচয় দিয়ে কথা হলে এই তিন নারী বলেন, তাঁদের দিনের শুরু হয় এই উদ্যানে। বিশুদ্ধ বাতাস, নানা গাছের পাতার নাচন তাঁদের মনকে আন্দোলিত করে। এই আনন্দটুকু পেতে তাঁরা প্রতিদিন ভোরে ছুটে আসেন এখানে। নিলুফার ভাষ্য, একদিন কোনো কারণে এখানে না এলে, সবার সঙ্গে দেখা না হলে মনে হয়, কী যেন একটা অপূর্ণ থেকে গেছে। তখন দিনটা আর ভালো কাটে না। এখানকার হাসিখুশি সকালটা খুব মিস করেন তিনি।

হাসিমুখে দিন শুরুর এমন আরও অনেক গল্প আছে রাজধানীর উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টর পার্কে। এখানে স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য আছে একটি উদ্যান ও খেলার মাঠ। প্রতিদিন ভোর হতেই বাসিন্দারা এক এক করে জড়ো হতে থাকেন এসব উদ্যান ও মাঠে। শরীরচর্চা, খেলাধুলা, গল্প-আড্ডায় শুরু হয় তাঁদের সকাল। মানসিক প্রশান্তি নিয়ে এখান থেকে ফেরেন তাঁরা।