খুদে পদার্থবিদদের স্বপ্নের একদিন

শিক্ষককে প্রশ্ন করছে এক শিক্ষার্থী।

দেশের আট বিভাগের নাম অনুসারে সারিবদ্ধভাবে শিক্ষার্থীরা দাঁড়ানো। সবার গায়ে হলুদ রঙের টি-শার্ট। তাতে হ্যাশট্যাগ ‘আই এম ফিজিকস’। কপালে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা বাঁধা। তাদের কথায়-আচরণে পদার্থবিদ্যায় পারদর্শী হয়ে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার স্বপ্ন। জাতীয় ফিজিক্স অলিম্পিয়াডের পরীক্ষা, প্রশ্নোত্তর ও বিজ্ঞানীদের পরামর্শের মধ্য দিয়ে খুদে পদার্থবিদদের দিনটি কেটেছে স্বপ্নের মতো।

ঢাকার সেন্ট যোসেফ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে আজ শুক্রবার হয়েছে ‘ডাচ্-বাংলা ব্যাংক-প্রথম আলো জাতীয় ফিজিক্স অলিম্পিয়াড ২০২২’। ডাচ্-বাংলা ব্যাংক লিমিটেডের পৃষ্ঠপোষকতায় ও প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ ফিজিক্স অলিম্পিয়াড কমিটি এই আয়োজন করে। করোনা সংক্রমণের কারণে গত দুই বছর জাতীয় ফিজিক্স অলিম্পিয়াডের আয়োজন হয় অনলাইনে। এবার পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক হওয়ায় আনন্দ-উচ্ছ্বাসে সরাসরি অলিম্পিয়াডে অংশ নেয় শিক্ষার্থীরা।

অনুষ্ঠান এসে মেয়েকে ছবি তুলে দিচ্ছেন মা।

সকালে উদ্বোধনী পর্বে জাতীয় সংগীতের সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন সেন্ট যোসেফ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলের অধ্যক্ষ ব্রাদার সুবল লরেন্স রোজারিও। বাংলাদেশ ফিজিক্স অলিম্পিয়াডের পতাকা উত্তোলন করেন প্রথম আলোর যুব কার্যক্রমের প্রধান মুনির হাসান। আন্তর্জাতিক ফিজিক্স অলিম্পিয়াড কমিটির পতাকা উত্তোলন করেন বাংলাদেশ ফিজিক্স অলিম্পিয়াড কমিটির সাধারণ সম্পাদক ফয়েজ আহমেদ জাহাঙ্গীর।

শুভেচ্ছা বক্তব্যে মুনির হাসান শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেন, ‘যেসব দেশে ভালো মানের বিজ্ঞানী, পদার্থবিদ ও গণিতবিদ রয়েছে, তারা দ্রুত এগোচ্ছে৷ এ জন্য তোমাদেরকেই লড়তে হবে।’

ফয়েজ আহমেদ বলেন, ‘একসঙ্গে শিক্ষার্থীদের খোলা মাঠে জড়ো করতে পেরে ভালো লাগছে। এই শিক্ষার্থীদের হাত ধরেই বিজ্ঞানের যাত্রা এগিয়ে যাবে।’
অলিম্পিয়াডের উদ্বোধন ঘোষণা করে ব্রাদার সুবল লরেন্স রোজারিও বলেন, ‘এই শিক্ষার্থীদের নিয়ে দেশ বড় স্বপ্ন দেখে।’

এরপর মাঠে বেলুন ওড়ানো হয়। শিক্ষার্থীরা চলে যায় পরীক্ষার হলে। সকাল ১০টায় শুরু হয়ে পরীক্ষা চলে দুই ঘণ্টা। এবার অলিম্পিয়াডে অংশ নিতে অনলাইনে ১০ হাজার ৭৮০ শিক্ষার্থী নিবন্ধন করে। অনলাইন বাছাই ও আঞ্চলিক অলিম্পিয়াডে বিজয়ী ৯৬০ শিক্ষার্থী জাতীয় পর্যায়ে অংশগ্রহণের সুযোগ পায়।

পরীক্ষার শেষে পরিবেশিত হয় ফিজিক্স অলিম্পিয়াডের থিম সং। এরপর ছিল মজার প্রশ্নোত্তর পর্ব। ‘আলো সোজা পথে চলে নাকি বক্র পথে’, ন্যাচারাল ল আর ফিজিক্সের ল সাংঘর্ষিক হলে কোনটি প্রাধান্য পাবে’—শিক্ষার্থীদের এমন নানা প্রশ্নের উত্তর দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আরশাদ মোমেন।
রংপুর পুলিশ লাইন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী আবরার আল নাহিয়ান প্রথম অলিম্পিয়াডে এসেছে। সে বলল, ‘জাতীয় পর্বে এবারই প্রথম সুযোগ পেয়েছি। এখানে এসে অনেক কিছু জানতে পেরেছি।’

মধ্যাহ্নভোজের বিরতির পর মূলমঞ্চের পর্দায় দেখানো হয় প্রথম আলোর ২৩তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র আয়রনম্যান। এরপর শিল্পী ম্যাক অ্যাপেল সংগীত পরিবেশন করেন। নৃত্য পরিবেশন করেন নিত্যরঙ্গের শিল্পীরা। জাদু দেখান স্বপন দিনার। কৌতুক নিয়ে বিশেষ পর্বে ছিলেন মীরাক্কেলখ্যাত জামিল হোসেন। মুখ দিয়ে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের আওয়াজ করে শোনান বিটমোসফিয়ার বাংলাদেশের সদস্যরা।
সমাপনী পর্বে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, যেকোনো বিষয়ের মূল হচ্ছে পদার্থবিদ্যা। মুখস্থ কম, বুঝতে হবে বেশি। কোনো বিষয় যত ব্যাখ্যা করা শিখবে, তত আনন্দ পাবে।

বাংলাদেশ ফিজিক্স অলিম্পিয়াড কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, জীবন হতে হবে আনন্দময়। গবেষণার মতো আনন্দ দ্বিতীয়টি নেই।

র‌্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার বিজয়ী বিজ্ঞানী ফেরদৌসী কাদরী বলেন, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিত—এই চার বিষয়ে পড়ার প্রতি শিক্ষার্থীদের ঝোঁক বাড়াতে হবে।

খাতায় স্বাক্ষর করছেন এক পরীক্ষক।

প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম বলেন, কোনো কিছু কেন, কীভাবে হয়, এই প্রশ্নগুলো করতে পারলে বিজ্ঞানের বড় অংশ জানা হয়ে যাবে।

এবার প্রথমবারের মতো আয়োজন করা হয় বাংলাদেশ উইমেনস ফিজিক্স অলিম্পিয়াড। কমিটির সভাপতি ইয়াসমীন হক বলেন, পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে ধীরে ধীরে নারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমছে।

শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান ও বই পড়ার পরামর্শ দেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আনিসুল হক।

প্রশ্নের উত্তর লিখছে শিক্ষার্থীরা

ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কাশেম মো. শিরিন বলেন, শিক্ষার সঙ্গে সব সময় জড়িত ডাচ্-বাংলা ব্যাংক। অলিম্পিয়াডের মতো বিভিন্ন শিক্ষামূলক আয়োজনে তাদের ব্যাংক পৃষ্ঠপোষকতা করছে। তারা এখন পর্যন্ত প্রায় ৬০ হাজার শিক্ষার্থীকে শিক্ষাবৃত্তি দিয়েছে।

চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের পরিচালক সেঁজুতি সাহা বলেন, পদার্থবিদ্যা ছাড়া বিজ্ঞানের অন্যান্য বিষয় বুঝতে পারা সম্ভব নয়।

সমাপনী পর্বে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ উইমেনস ফিজিক্স অলিম্পিয়াড কমিটির সহসভাপতি সুপ্রিয়া সাহা।

অনুষ্ঠান শেষে অলিম্পিয়াডে তিনটি ক্যাটাগরিতে ৯৫ জনকে পুরস্কার দেওয়া হয়। এ ছাড়া উইমেন ফিজিক্স অলিম্পিয়াডে পুরস্কার দেওয়া হয় আট বিজয়ীকে।