গাজীর জীবনজুড়ে কুকুর এবং বিশ্বাসভঙ্গের কিছু ঘটনা

কাজ যখন না থাকে, তখন ইসমাত নামের এই কুকুরের সঙ্গেই সময় কাটান গাজী রহমান।
ছবি: প্রথম আলো

বয়স জিজ্ঞাসা করলে গাজী রহমান বলেন, ‘৭০ কম দুই বছর।’ মুক্তিযুদ্ধের পর জয়পুরহাট থেকে ঢাকায় আসেন। রিকশাই চালিয়েছেন জীবনের বেশির ভাগ সময়। গাজীর জীবনের বড় অংশজুড়ে আছে কুকুর এবং বিশ্বাসভঙ্গের কিছু ঘটনা। ধানমন্ডি–কলাবাগান এলাকায় একজন কুকুরপ্রেমী রিকশাচালক হিসেবেই তিনি পরিচিত।
গত রোববার ধানমন্ডি ১৩ নম্বর সড়কে গিয়ে গাজী রহমানের খোঁজ করতেই সবাই চিনলেন। কয়েকটি কুকুর সেখানে বসে ছিল। আসলে ওরা অপেক্ষা করছিল গাজীর রিকশার জন্য। দুটি কুকুর হঠাৎ ১৩ নম্বর সড়কের ডান পাশের মোড়ে দৌড়ে গেল। ওদের খাবার নিয়ে হাজির গাজী রহমান। এই সড়কে পাঁচ থেকে ছয়টি কুকুরকে তিনি নিয়মিত খাওয়ান।

লেজ নাড়তে নাড়তে গাজীকে ঘিরে ধরেছে ওরা। গাজী সড়কের একপাশে খাবার ছিটিয়ে দিলেন। মেন্যু ছিল বিরিয়ানি। গাজী রহমান থাকেন মিরপুরে। সেখান থেকে প্রতিদিন সকালে কলাবাগানে আসেন। সেখানে থাকে তাঁর ইসমাত নামের এক কুকুর, যাকে সে পেলে-পুষে বড় করেছে। ইসমাতকে খাওয়ান। যাত্রী পেলে গন্তব্যে যান। নয়তো কলাবাগান পদচারী–সেতুতেই ইসমাতের সঙ্গেই সময় কাটান তিনি।

গতকাল সোমবার কলাবাগানে গিয়ে দেখা যায়। পদচারীর–সেতুর পাশে রিকশায় গাজী বসা এবং ফুটপাতে ইসমাত শুয়ে আছে। ইসমাতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। এটা যে তাঁর কুকুর এবং কেউ যেন আঘাত না করে, তাই গলায় টিয়া রঙের বেল্ট লাগিয়েছেন।

গাজী রহমান মুক্তিযুদ্ধের পরেই ঢাকায় চলে আসেন এবং কলাবাগান এলাকায় থাকা শুরু করেন। শুরুর দিকে তিনি নিজেই কিছু কুকুর লালন-পালন করতেন। ওদের কেউ হারিয়ে যায়, কেউ মারা যায়। এরপর রাস্তার বেওয়ারিশ কুকুরকে দেখভাল করা শুরু করেন। এদেরই কেউ কেউ তাঁর ভক্ত হয়ে যায়। একসময় নিজেই রান্না করে কুকুরকে খাওয়াতেন। এরপর ধানমন্ডির এক বাসিন্দা তাঁর এই কুকুরপ্রীতির কথা জেনে নিয়মিত খাবারের জোগান দেওয়া শুরু করেন। প্রতিদিন দুপুরে গাজী সেখান থেকে খাবার এনে ধানমন্ডি ও কলাবাগানের কুকুরগুলোকে খাওয়ান। এ ছাড়া কুকুরের পেছনে দিনে তিনি ১০০ টাকার মতো খরচ করেন।

নিজের সংগতি খুব একটা ভালো নয়, কিন্তু কুকুরকে নিয়ম করে খাওয়ানো এবং এই মায়া কেন? এই বৃদ্ধের উত্তর, ‘ওদেরকে আমার ভালো লাগে, মানুষের চেয়ে আমি ওদের বেশি ভালোবাসি।’

ধানমন্ডি ও কলাবাগানের বেশ কিছু কুকরকে নিয়মিত খাওয়ান রিকশাচালক গাজী রহমান।
ছবি: প্রথম আলো

গাজীর রহমানের জীবনে কিছু বিশ্বাসভঙ্গের ঘটনা আছে বলে জানান। এক সঙ্গীর পেছনে লাখ দুয়েক টাকা খরচ করেছিলেন। সঙ্গী তাঁকে ছেড়ে পালিয়ে যান বলে দাবি। গাজীর ভাষায়, ‘মানুষ খুব জ্বালায়ছে। আমি মানুষকে বাদ দিয়ে এখন কুকুরকে খিলান শুরু করিছি। আমি এখন কুকুরকে ভালোবাসি। মানুষকে ঠকায় গেলে নিজেই ঠকতি হয়।’

গাজী আরও বলেন, ‘মানুষ আর কুকুরের মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। মানুষ বেইমান হতে পারে, কিন্তু কুকুর বেইমান নয়। কুকুর পাললে মানুষের কথা শোনে।’
কুকুরকে খাওয়ানোর পরে বিকেল থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত রিকশা চালান গাজী। বয়সের ভারে কাবু হলেও তিনি বলেন, ‘আমার রিকশা চালাতে ভালো লাগে।’ রিকশাও নিজের। কথা শুনে কিছুটা স্বাধীনচেতা মনে হয়। খুব বেশি যে আয় করতে হবে, সেই ভাবনা নেই। কাজ শেষে কলাবাগানেই রিকশা রেখে বাসে মিরপুরে যাতায়াত করেন। গণপরিবহন বন্ধ থাকলে রিকশা ভাড়া করে যান।

গাজী রহমানের দুই স্ত্রী। একজন জয়পুরহাটে থাকেন। আরেকজন রাজধানীতেই। তিন মেয়ের বিয়ে হয়েছে। দুই সংসারেরই খরচ তিনি দেন বলে দাবি করেন।
কুকুরকে খাওয়ানো বন্ধ করেননি বলে জানান গাজী। বলেন, ‘যত দিন বাঁচি থাকব। কুকুরকে খিলায়ে যাব।’