গোসল নিয়ে ভয়ে থাকে বস্তিতে থাকা ৭২ শতাংশ মেয়ে: জরিপ

নিম্ন আয়ের এলাকায় থাকা কিশোরী ও তরুণীদের জন্য নিরাপদ গোসলখানা নিয়ে জরিপ প্রতিবেদন তুলে ধরে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ
ছবি: প্রথম আলো

‘খোলা জায়গায় গোসলের সময় লোকজন তাকিয়ে থাকত। খুব অস্বস্তি হতো। সবচেয়ে বেশি অসুবিধা হতো মাসিকের সময়।’

রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে ধলপুর (১৪ নম্বর আউটফল) এলাকার একটি বস্তিতে থাকা এক কিশোরী এভাবেই জানিয়েছিল তার অসুবিধার কথা। তবে এখন সে স্বস্তিতে গোসল করতে পারবে। কারণ, একটি প্রকল্পের আওতায় তার বস্তিতে মেয়েদের জন্য ছাদযুক্ত পাকা গোসলের জায়গা করে দেওয়া হয়েছে।

ওই বস্তিতে থাকা কিশোরীদের এখন আর খোলা গোসলখানায় গোসল করতে হবে না। ভেজা অবস্থায় সবার সামনে ঘরে যেতে হবে না। তবে নিম্ন আয়ের পরিবারের বসবাসের স্থান বা বস্তিতে থাকা অনেক কিশোরী ও তরুণী এখনো এই সুবিধার বাইরে।
আজ শনিবার রাজধানীর পুরানা পল্টন এলাকায় এক রেস্তোরাঁয় আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে নিম্ন আয়ের এলাকায় থাকা কিশোরী ও তরুণীদের জন্য নিরাপদ গোসলখানা নিয়ে জরিপ প্রতিবেদন তুলে ধরে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ।

‘নিরাপদ গোসলখানা সবার জন্য সবখানে’ স্লোগান নিয়ে রাজধানীর ধলপুর, মালেক মেম্বার, আইজি গেট এবং ম্যাচ কলোনি বস্তিতে এ বছরের মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত জরিপ পরিচালনা করা হয়। এতে অংশ নেয় ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী ৪১৭ জন কিশোরী ও তরুণী।

জরিপের অন্তর্ভুক্ত চারটি স্থানের তথ্য বলছে, ৭২ শতাংশ কিশোরী-তরুণী উন্মুক্ত গোসলখানায় তাদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় থাকে। ওই এলাকার কেউবা আশপাশের উঁচু ভবন থেকে, কেউ উন্মুক্ত গোসলখানায় গোসলের দৃশ্য ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছে কি না, তা নিয়ে ভয়ে থাকে অনেক মেয়ে। এ ছাড়া উন্মুক্ত গোসলখানায় পুরুষ ও বয়স্ক নারীদের বকাঝকা, যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার ঘটনাও ঘটে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই চার এলাকার ৯৯ শতাংশ গোসলখানাই উন্মুক্ত। ওই সব গোসলখানার মাত্র ১৫ শতাংশ মেয়েদের জন্য আলাদা। বাকিগুলো নারী-পুরুষকে একসঙ্গেই ব্যবহার করতে হয়। গোসলখানাগুলোতে ছাদ ও দেয়াল না থাকায় মেয়েদের কোনো গোপনীয়তা থাকে না। অনেক কিশোরী বয়স্ক নারীদের অশোভন মন্তব্যের শিকার হয়। গোসলের সময় পুরুষেরা থাকায় অস্বস্তিতে ভোগে তারা।

প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ এমপাওয়ারিং গার্লস ফর ইকোনমিক অপরচুনিটি অ্যান্ড সেফ স্পেস—ই গ্লস মডেল প্রকল্পের আওতায় ওই চার স্থানে ১৫টি পাকা গোসলখানা স্থাপন করেছে। এতে সহযোগী সংস্থা ছিল পপুলেশন সার্ভিসেস অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার (পিএসটিসি)। নিরাপদ গোসলখানার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার ও সমীক্ষা পরিচালনায় সহায়তা করে যুব সংগঠন বাংলাদেশ ইয়ুথ সোসাইটি (বিওয়াইএস)।

জরিপ প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, একটি গোসলখানা ৩৫ থেকে ৪৫ জন ব্যবহার করে থাকে। ফলে দীর্ঘ সারি থাকে গোসলের জন্য। ৭৫ শতাংশ অংশগ্রহণকারী মেয়ে জানিয়েছে, তারা সহজে জায়গা পায় না। কিছুটা বেশি সময় লাগলে অন্যদের গালমন্দ শুনতে হয়। মাসিকের সময় দুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করে। রাতের বেলায় গোসলের জন্য তারা অপেক্ষা করে। সেটা তাদের জন্য আরও নিরাপত্তাহীন। আটজন মেয়ে জানিয়েছে, ছবি ও ভিডিওর মাধ্যমে তারা ব্ল্যাকমেলিংয়ের শিকার হয়েছে।

জরিপ প্রতিবেদন উপস্থাপন করেছেন প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের ওয়াশ স্পেশালিস্ট এস এম তারিকুজ্জামান।

সংবাদ সম্মেলনে সংস্থার প্রকল্প ব্যবস্থাপক মানিক কুমার সাহা বলেন, বাংলাদেশে পাঁচ হাজারের মতো বস্তি এলাকা রয়েছে। সেসব এলাকায় মেয়েদের একটি নিরাপদ গোসলখানার প্রয়োজনীয়তার কথা ভাবা হয় না। নীতিনির্ধারকদের কাছে সমস্যাটি তুলে ধরে স্থায়ী সমাধানের জন্য আলোচনাটি অব্যাহত থাকা জরুরি।

পিএসটিসির প্রকল্প সমন্বয়কারী শিরোপা কুলসুম বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুসারে, মাসিকের সময় স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়াতে একটি মেয়েকে ২৪ ঘণ্টায় অন্তত চারবার প্যাড বা কাপড় পরিবর্তন করতে হবে। ওই সব এলাকায় উন্মুক্ত গোসলখানার কারণে মেয়েরা সারা দিন একটি প্যাড বা কাপড় পরে থাকতে বাধ্য হয়। পরিষ্কার করার জন্য তারা রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করে। এতে তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হয়।

বিওয়াইএসের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক ফায়েজ বেলাল বলেন, নিম্ন আয়ের এলাকার মেয়েদের ভোগান্তির বিষয়গুলো উপলব্ধি করতে হবে এবং নিরাপদ গোসলখানার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আওয়াজ তুলতে হবে।

অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের প্রচার ব্যবস্থাপক সেমন্তী মঞ্জরী। ধন্যবাদ জানান সংস্থার কেন্দ্রীয় ও উত্তরাঞ্চলের প্রধান আশিক বিল্লাহ।