গ্রাহক ৪৩ লাখ, মিটারে মাত্র সাড়ে ৩ লাখ

বিতরণ কোম্পানিগুলো বলছে, অর্থায়নের অভাবে কাজ এগোচ্ছে না। নিজস্ব অর্থায়নে করার সুপারিশ সংসদীয় কমিটির।

প্রতীকী ছবি

রাজধানীর মিরপুরের বাসিন্দা রোকন উজ জামান। দুই চুলা জ্বালাতে গ্যাসের জন্য মাসপ্রতি তাঁর খরচ পাঁচ শ থেকে সাড়ে পাঁচ শ টাকা। তিনি বলেন, গ্যাসের মিটার বসানোর পর মাসে গড়ে চার শ টাকা করে সাশ্রয় হচ্ছে। আগে গ্যাস ব্যবহার না করলেও বিল দিতে হতো ৯৫০ টাকা।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় গ্যাসের প্রিপেইড মিটার ব্যবহার করে দুই চুলা জ্বালানো অন্তত ১০ জন গ্রাহকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, সবার অভিজ্ঞতা প্রায় একই। অথচ যাঁদের মিটার নেই, তাঁরা চুলা না জ্বালালেও ৯৫০ টাকা দিচ্ছেন প্রতি মাসে।

এ কারণেই যত দ্রুত সম্ভব গ্যাসের প্রিপেইড মিটার চালুর দাবি গ্রাহকদের। বর্তমানে সারা দেশে এ খাতে আবাসিক গ্রাহক আছেন প্রায় ৪৩ লাখ। এর মধ্যে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রিপেইড মিটার পেয়েছেন মাত্র ৩ লাখ ৬২ হাজার ৫০ জন গ্রাহক।

বিতরণ কোম্পানির কর্মকর্তারা বলছেন, অর্থায়নের অভাবে মিটার চালুর প্রকল্প নেওয়া যায়নি। এখনো একাধিক প্রাক্‌-প্রকল্প প্রস্তাব অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে (ইআরডি) আটকে আছে।

ধীরগতি নিয়ে ক্ষোভ

বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশনের (পেট্রোবাংলা) অধীনে দেশে গ্যাস বিতরণকারী কোম্পানি আছে ছয়টি। এই কোম্পানিগুলোর মিটার স্থাপনের কাজ করার কথা। এগুলো হলো তিতাস গ্যাস, কর্ণফুলী ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড, জালালাবাদ গ্যাস ট্রান্সমিশন ও ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম লিমিটেড, বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড, পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড এবং সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড। এর মধ্যে তিতাস ঢাকার গ্রাহকদের গ্যাস সরবরাহ করে। এ ছাড়া কর্ণফুলী চট্টগ্রামে, জালালাবাদ সিলেটে, বাখরাবাদ কুমিল্লা অঞ্চলে, পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস সিরাজগঞ্জ অঞ্চলে এবং সুন্দরবন খুলনা অঞ্চলে গ্যাস সরবরাহ করে থাকে।

২০২৫ সালের মধ্যে আবাসিক গ্রাহকদের শতভাগ প্রিপেইড মিটারের আওতায় আনার লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে সরকার। ২০১১ সালের শুরুর পর গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঢাকায় তিতাস ৩ লাখ ২ হাজার ৫০টি মিটার স্থাপন করেছে। আর চট্টগ্রামে কর্ণফুলী ৬০ হাজার গ্রাহককে মিটার দিয়েছে। বাকি চারটি কোম্পানি কোনো মিটার দিতে পারেনি। এই হিসাবে দেশে ১০ বছরে মিটারের আওতায় এসেছেন মাত্র ৮ শতাংশের কিছু বেশি গ্রাহক।

বিতরণ কোম্পানির কর্মকর্তারা বলছেন, অর্থায়নের অভাবে মিটার দেওয়া যায়নি। তিতাসের ১২ লাখ ৪৯ হাজার মিটার বসানোর দুটি প্রকল্প অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে (ইআরডি) আটকে আছে। এ ছাড়া বাখরাবাদের দুটি প্রকল্প ও পশ্চিমাঞ্চলের একটি প্রকল্প অর্থায়নের অভাবে আটকে আছে। তবে কর্ণফুলী নিজস্ব অর্থায়নে ১ লাখ মিটার ও জালালাবাদ নিজস্ব অর্থায়নে ৫০ হাজার মিটার বসানোর কাজ শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন কোম্পানি দুটির কর্মকর্তারা।

দ্রুত মিটার বসাতে তাগাদা

এদিকে দ্রুত গ্রাহকদের প্রিপেইড মিটার দিতে বিতরণ কোম্পানিকে চিঠি দিয়ে একাধিকবার তাগাদা দিয়েছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। প্রিপেইড মিটারের ধীরগতি নিয়ে গত ডিসেম্বরে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। এরপর গত সেপ্টেম্বরে সর্বশেষ বৈঠকে নিজস্ব অর্থায়নে প্রিপেইড মিটার বসাতে বিতরণ কোম্পানিগুলোর প্রতি সুপারিশ করে এই কমিটি।

এ বিষয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিতরণ কোম্পানির নিজস্ব অর্থায়নে অনাগ্রহের কারণে দেরি হয়েছে। আগামী দুই বছরে অন্তত ২০ লাখ গ্রাহক মিটার বসানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া গতি বাড়াতে বেসরকারি খাতে মিটার আমদানি উন্মুক্ত করা হয়েছে। গ্রাহক নিজে কিনে মিটার বসাতে পারবে।’

জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ বলছে, বিতরণ কোম্পানি বিনিয়োগ না করায় বেসরকারি খাতে মিটার বিক্রির জন্য ২০১৯ সালে একটি নীতিমালা তৈরি করা হয়। সম্প্রতি এই নীতিমালা সংশোধনও করা হয়েছে। ইতিমধ্যে ব্যবসায়ীদের অনেকে মিটার আমদানির অনুমোদনের জন্য আবেদন করতে শুরু করেছেন পেট্রোবাংলার কাছে।

গ্যাস সাশ্রয় হবে

বুয়েটের পেট্রোলিয়াম ও মিনারেল রিসোর্স প্রকৌশল বিভাগের প্রধান মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, আবাসিকে মিটার বসানো হলে গ্যাসের অপচয় কমবে। গ্রাহকের খরচ কমে যাওয়ায় তিতাসের আয়ও কমবে।

তবে বিতরণ কোম্পানির কর্মকর্তারা বলছেন, আবাসিক গ্রাহকের থেকে আয় কমলেও ক্ষতি নেই। সাশ্রয়ী গ্যাসশিল্প খাতে সরবরাহ করে আরও বেশি আয় করতে পারবে বিতরণ কোম্পানি।

বিইআরসির একজন ও সবচেয়ে বড় বিতরণ কোম্পানি তিতাস গ্যাসের দুজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, মিটার বসালে এক বাসাতেই মাসে গড়ে ৩০ ঘনমিটার গ্যাস সাশ্রয় হবে। এই হিসাবে সারা দেশে ৪৩ লাখ গ্রাহক প্রিপেইড মিটারের আওতায় এলে মাসে ১৬০ কোটি টাকার গ্যাস সাশ্রয় সম্ভব হবে।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) বলছে, অনেক এলাকায় আবাসিক গ্রাহকেরা নিয়মিত গ্যাস পান না। তবুও বিল দিতে হয়। মিটার বসানোর ধীরগতি নিয়ে ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, গ্রাহকের উপকারে আসে বা তাঁদের স্বার্থ সুরক্ষা হয়—এমন কোনো কাজ করছে না জ্বালানি বিভাগ।