জঙ্গি জিয়া সম্পর্কে বাবা: সে ছিল ধর্মান্ধ ও একরোখা

সৈয়দ জিয়াউল হক

জানুয়ারির মাঝামাঝিতে ফোনে পুত্রবধূর উৎকণ্ঠিত গলা শুনে একটু অবাকই হয়েছিলেন জিল্লুল হক। তাঁর ছেলে সৈয়দ জিয়াউল হককে নাকি পাওয়া যাচ্ছে না। এমন একটা সুরক্ষিত জায়গায় ছেলের জীবনযাপন, সেখান থেকে ছেলে নিখোঁজ হয়, এ আবার কেমন কথা! ভাবলেন, হয়তো কোথাও কোনো কাজে আটকা পড়েছে। ফিরে আসবে।

তবে ছেলে যে শিগগিরই আর ফিরছে না, সে ইচ্ছে করে সবার চোখে ধুলো দিয়ে আত্মগোপন করেছে—দিন দুয়েক পরই পত্রিকা মারফত জানতে পারলেন। ২০ জানুয়ারি ২০১২–এর সেই দিনটিতে প্রায় সব জাতীয় দৈনিকের শিরোনামই ছিল অভিন্ন। প্রথম আলোর প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল লাল কালিতে—‌সরকার উৎখাতের চেষ্টা ব্যর্থ, অভ্যুত্থানের চেষ্টা প্রতিহত করল সেনাবাহিনী, গ্রেপ্তার ২।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সোর্ড অব অনার ও দুটি সোনার মেডেল পাওয়া চৌকস সেনা কর্মকর্তার বাবা জিল্লুল হক এক নিমেষে হয়ে গেলেন একজন দেশদ্রোহীর বাবা।
রোববার মুঠোফোনে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন জিল্লুল হক। তিনিই একসময়ের চৌকস সেনা কর্মকর্তা ও পরে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসার আল–ইসলামের সামরিক বিভাগের প্রধান সৈয়দ জিয়াউল হকের বাবা।

এই চাকরিচ্যুত মেজর জিয়া বিজ্ঞানমনস্ক লেখক অভিজিৎ রায়, জাগৃতি প্রকাশনের ফয়সাল আরেফিন দীপন ও কলাবাগানে জুলহাস-তনয় খুনের ঘটনায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। গত ২০ ডিসেম্বর মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাঁর ব্যাপারে তথ্য চেয়ে ৫০ লাখ ডলার ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশ সরকার অবশ্য ২০১৬ সালেই জিয়ার সন্ধানদাতার জন্য ২০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিল।

গত সোমবার পর্যন্ত পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের কাছে সৈয়দ জিয়াউল হকের অবস্থান সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই। সিটিটিসি প্রধান আসাদুজ্জামান প্রথম আলোকে তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। আদতে ২০২০ সালে জিয়ার একজন সহযোগী গ্রেপ্তারের পর থেকেই তাঁর সম্পর্কে আর কোনো তথ্য পায়নি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

আর জিল্লুল হক বলেছেন, ২০১১ সালের ডিসেম্বরের পর থেকে তাঁর সঙ্গে ছেলের দেখা হয়নি। বারিধারার বাসা থেকে ওই দিন তিনি স্ত্রী-কন্যাদের নিয়ে মিরপুর ডিওএইচএসে সৈয়দ জিয়াউল হকের বাসায় গিয়েছিলেন নাতি–নাতনিদের দেখতে। এরপর আর কোনো দিন ছেলেকে দেখেননি, এমনকি ফোনেও কথা হয়নি। ফেরার এই ছেলে একদিন পিটি, ড্রিল, ফায়ারিং ও লেখাপড়া—সব শাখায় সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমিতে সেরা হয়েছিল। ছেলের এই পরিণতি ৭৩ বছর বয়স্ক বাবাকে কখনো কষ্ট দেয়, কখনো ক্ষুব্ধ করে।

জিল্লুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘‌জিয়া আমার ছেলে, তবে তার সঙ্গে আমার মেলে না। দেশের আইন সবাইকে অবশ্যই মানতে হবে। আইন অমান্য করা একদম পছন্দ করি না আমি। আমাকে যদি বলতে বলেন, আমি বলব জিয়া ধার্মিক ছিল না, ও ছিল ধর্মান্ধ এবং প্রচণ্ড একরোখা।’

জিয়া সম্পর্কে একটা ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছিল ১৯ জানুয়ারি সেনা সদর দপ্তরের সংবাদ সম্মেলনেও। সেখানেও তাঁর ধর্মান্ধতার প্রসঙ্গটি এসেছিল। সেনাবাহিনীর পারসোন্যাল সার্ভিসেস পরিদপ্তরের তৎকালীন পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাসুদ রাজ্জাক ওই দিন বলেছিলেন, ‘‌‌সম্প্রতি কিছু প্রবাসী বাংলাদেশির ইন্ধনে সেনাবাহিনীর সাবেক ও বর্তমান কিছু কর্মকর্তা ধর্মান্ধতাকে পুঁজি করে সেনাবাহিনীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে গণতান্ত্রিক ধারাকে ব্যাহত করার চেষ্টা চালিয়েছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তা সফল হতে দেয়নি।’

ওই সংবাদ সম্মেলনে আরও বলা হয়, তথ্যের ভিত্তিতে দুই সেনা কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। চাকরিরত একজন কর্মকর্তা পালিয়ে গেছেন। পালিয়ে যাওয়া এই সেনা কর্মকর্তাই ছিলেন আজকের সবচেয়ে দামি ফেরার আসামি সৈয়দ জিয়াউল হক।

ছেলেকে নিয়ে যা বললেন জিল্লুল হক

জিল্লুল হক ও জাহানারা বেগমের ছেলে সৈয়দ জিয়াউল হকের জন্ম ১৯৭৮ সালের ৬ নভেম্বর মৌলভীবাজারে। স্ত্রী-সন্তানকে রেখে কর্মসূত্রে সৌদি আরবে থাকতেন। বাড়িতে বৃদ্ধ মা–বাবার সেবা–শুশ্রূষার জন্য ওদের রেখে গিয়েছিলেন তিনি। আট-নয় বছর বয়স পর্যন্ত সৈয়দ জিয়াউল হককে সামলানোই ছিল দায়। খুবই দুরন্ত ছিলেন। বয়স যখন বছর দশেক, তখন থেকেই শান্ত হতে শুরু করেন জিয়া। শুধু শান্ত না, প্রচণ্ড একরোখাও। লেখাপড়ায় ভালো ছিলেন, সিলেট ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হতে বেগ পেতে হয়নি।

ছেলেকে ক্যাডেট কলেজে ভর্তি করে স্ত্রী ও এক মেয়েকে নিয়ে সৌদি আরবে চলে যান জিল্লুল। ছেলে ক্যাডেট কলেজ থেকে ছুটিতে কয়েকবার সৌদি আরবে মা–বাবার কাছে গেছে। এন্ট্রি-এক্সিট (প্রবেশ ও প্রস্থান) ভিসায় কিছুটা গোলমাল হওয়ায় জিয়া সৌদি আরবে নিয়মিত যেতে পারছিলেন না। জিল্লুল ভেবেছিলেন, সৌদি আরবে নিয়ে আসার চেয়ে বরং ক্যাডেট কলেজে রাখাই ভালো। লেখাপড়াটা ঠিকঠাক হবে, সুশৃঙ্খল একটা জীবন পাবে। এই ভাবনা থেকেই সিদ্ধান্ত হয় ছুটিছাটায় মৌলভীবাজারের মোস্তফাপুরের দাদির বাসায় চলে যাবেন সৈয়দ জিয়াউল হক।

সৌদি আরব থেকে তাঁরা যখন আসতেন দেখা হতো, কখনো কখনো ক্যাডেট কলেজের প্যারেন্টস ডেতেও ঘণ্টাখানেকের জন্য ছেলের সঙ্গে দেখা হতো। দূরত্বের কারণে হোক বা প্রথা, বাবার সঙ্গে ছেলের সম্পর্কটা কখনো আর মসৃণ হয়নি। এর মধ্যেই কিছু ঘটনায় খটকা লাগে জিল্লুল হকের।

জিল্লুল খবর পাচ্ছিলেন ক্যাডেট কলেজের ভেতর ছেলে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি শুরু করেছেন। ক্যাডেট কলেজের নিজস্ব রীতিনীতি আছে, তার বাইরে গিয়ে জিয়া ছেলেদের নামাজের ওয়াক্তে ডেকে তুলছেন। এতে ব্যবস্থাপকেরা ছেলের ওপর বেশ রুষ্ট। ছেলে আর সব দিকে বেশ, লেখাপড়া-খেলাধুলায় কোথাও পিছিয়ে নেই। জিয়া ১৯৯৫ সালে মাধ্যমিক ও ১৯৯৭–তে উচ্চমাধ্যমিক পাস করলেন কৃতিত্বের সঙ্গেই। এরপর যোগ দেন সেনাবাহিনীতে।

জিল্লুল হক স্ত্রী ও দুই কন্যাকে নিয়ে দেশে এসে থিতু হন ১৯৯৯ সালে, ৪১তম লং কোর্স শেষে জিয়া কমিশন পাওয়ার তিন দিন আগে। ছেলে এখানেও সেরা। সোর্ড অব অনার পেয়েছেন, দুটি গোল্ড মেডেলও।

সৈয়দ জিয়াউল হককে প্রথমেই পাঠানো হয় রাঙামাটির মারিষ্যায়। এরপর তিনি ঢাকা, কুমিল্লা, চট্টগ্রামে কাজ করেছেন। ক্যাপ্টেন পদে পদোন্নতির পর ঘটা করে পারিবারিক পছন্দে বিয়ে করেছিলেন জিয়া। স্ত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পলিটিক্যাল সায়েন্সে স্নাতকোত্তর করেছেন, বাবা বিচারপতি। তাঁদের বাড়িও সিলেট। সবকিছুই চলছিল ঠিকঠাক। জিয়া এক পুত্রসন্তানের বাবাও হন।

ছেলেটা যখন বছর তিনেকের, তখন জিয়ার প্রথম স্ত্রী ব্লাড ক্যানসারে আক্রান্ত হন। থাইল্যান্ডে নেওয়া হয়েছিল, বাঁচানো যায়নি। সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে মারা যান তিনি।

এই সময়ের আগে-পরে সৈয়দ জিয়াউল হকের আচার-আচরণে কিছুটা বিরক্ত হতে শুরু করেন জিল্লুল হক। ছেলের বাসায় নিয়মিত তখন এক পিএইচডিধারী ব্যক্তি আসছেন। বিকেলে জিয়ার কিছুটা অবসর থাকত। লোকটি পবিত্র কোরআন ও তাফসির নিয়ে আলোচনা করতে বসে যেতেন। তিনি কোনো ইসলামি চিন্তাবিদ ছিলেন না, সম্বল ছিল ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করা তথ্য। কিন্তু জিয়াকে তাঁর সান্নিধ্য থেকে সরানো যাচ্ছিল না। উল্টো তাঁর পীড়াপীড়িতে তিনিও দু-এক দিন বসেছেন আলোচনায়, দু-চারটে মৌলিক প্রশ্ন করেছিলেন। ওই ব্যক্তি সঠিক জবাব দিতে পারেননি। তিনিও আর কথা বাড়াননি।

জিল্লুল প্রথম আলোকে বলেন, ‌‌‌‘আমি আমার বন্ধুবান্ধবকেও বলেছিলাম লোকটাকে আমার ভালো লাগেনি। বিষয়টা কোনোভাবে সামরিক বাহিনীকে জানানো যায় কি না।’
অভ্যুত্থানচেষ্টা নিয়ে সংবাদ সম্মেলনের পর জিল্লুল হকের ডাক পড়েছিল কর্তৃপক্ষের কাছে। তখন কি এই লোকটি সম্পর্কে কিছু জানিয়েছিলেন? জবাবে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‌‌‘আমাকে কিছু বলতে হয়নি। ওই লোকটির সঙ্গে অতিরিক্ত মেলামেশার বিষয়টি অন্যদেরও চোখে পড়েছিল।’

কখন চোখে পড়েছিল, কীভাবে? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‌‌ওর প্রথম স্ত্রী মারা যাওয়ার পর জানাযাসহ সব ধরনের ধর্মীয় অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন ওই লোকটি। আমি ছিলাম ওখানে, আমার বেয়াই সাহেবও ছিলেন। কিন্তু আমরা ঘেঁষতেই পারছিলাম না।’

প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর খুব অল্প সময়ের মধ্যে সৈয়দ জিয়াউল হক আবারও বিয়ে করেন। ওই বিয়েটিও সন্দেহভাজন লোকটির ইচ্ছেতেই হয়। কনেও তাঁর ‌সাগরেদ। বাড়ি পটুয়াখালীর সবুজবাগ। এই নারীকে বিয়ের জন্য জিয়া তাঁর মা–বাবার ওপর চাপ সৃষ্টি করছিলেন। রাজি না হলে তিনি নিজেই বিয়ে করে নেবেন—এমনটাও জানতে পেরেছিলেন তাঁরা। শেষ পর্যন্ত বিয়েটা হয়ে যায়। এই পরিবারে জিয়ার একটি কন্যা ও একটি ছেলেসন্তান রয়েছে।

সৈয়দ জিয়াউল হক সেনানিবাস থেকে পালিয়ে যাওয়ার আগে একটি দীর্ঘ প্রশিক্ষণ কোর্সে অংশ নিতে ঢাকায় এসেছিলেন। প্রথমে বনানী ডিওএইচএসে ছিলেন, এরপর মিরপুরে ওঠেন সপরিবার।

সেনা সদর দপ্তরের সংবাদ সম্মেলনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ সালের ১৩ ডিসেম্বর সৈয়দ জিয়াউল হকের সঙ্গে সেনাবাহিনীর সাবেক এক কর্মকর্তা যোগাযোগ করেন। ২২ ডিসেম্বর তিনি আরেক সেনা কর্মকর্তাকে তাঁর সঙ্গে যোগ দিতে বলেন। বিষয়টি তিনি যথাযথ কর্তৃপক্ষকে জানালে জিয়ার ছুটি ও বদলি আদেশ বাতিল করে তাঁকে ঢাকার লগ এরিয়া সদর দপ্তরে যোগ দিতে বলা হয়। কিন্তু তিনি আর ফিরে যাননি।

জিল্লুল বলছিলেন, ওই বছরের ডিসেম্বরের মাঝামাঝির পর ছেলের কোনো খবর পাননি। এরপর যা জেনেছেন, তা নানা ধরনের জেরায়, একের পর এক হত্যাকাণ্ডের রায়ে। জিল্লুলের সঙ্গে ছেলের দূরত্ব ছিল আশৈশব। কিন্তু মা কী বলেন? একমাত্র ছেলে, বড় ছেলে—মা মন খারাপ করেন না? এমন প্রশ্নে জিল্লুল হক বলেন, ‘‌হ্যাঁ, আগে কান্নাকাটি করত। কিন্তু আমি খুব শক্ত মানুষ। তাকে বুঝিয়ে বলেছি সব, ল অব দি ল্যান্ড মাস্ট বি অ্যাবাইডেড (দেশের আইন অবশ্যই মানতে হবে)।’

জিল্লুল আরও বলেন, একসময় অপরাধবোধেও ভুগতেন তাঁর স্ত্রী। তাঁকে তিনি বলেছেন, ছেলে একটি সুশৃঙ্খল, সুরক্ষিত জায়গায় ছিল, ছেলে প্রাপ্তবয়স্ক। তার দোষের ভাগীদার তাঁরা নন।

প্রায়ই নিশ্চয় নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়, নানা তির্যক মন্তব্য শুনতে হয়, বিরক্ত হন না? জিল্লুলের জবাব ছিল, ‌‌কখনো কখনো হই। আবার আমার তো মানুষকে বলতেও হবে। আমি অভিভাবকদের বলি, ছেলে বড় হয়ে গেলেই তাঁর খোঁজখবর নেওয়াটা দয়া করে ছেড়ে দেবেন না।’