টিকাটুলির মোড়ে একটা হল রয়েছে...

নাগরিক বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম চলচ্চিত্র। গত আড়াই দশকে ঢাকায় তিনটি সিনেপ্লেক্স হলেও নতুন কোনো সিনেমা হল তৈরি হয়নি। এই শহরে নব্বইয়ের দশকে অর্ধশত সিনেমা হল থাকলেও কমতে কমতে হলের সংখ্যা এখন ২৬টিতে এসে ঠেকেছে। পুরোনো এসব হল নিয়েই এই সাপ্তাহিক আয়োজন

অভিসার সিনেমা হলের গতকাল শুক্রবারের চিত্র। লাইন ধরে ঢুকছেন সিনেমাপ্রেমীরা
অভিসার সিনেমা হলের গতকাল শুক্রবারের চিত্র। লাইন ধরে ঢুকছেন সিনেমাপ্রেমীরা

‘আরে টিকাটুলির মোড়ে একটা অভিসার সিনেমা হল রয়েছে, হলে নাকি এয়ারকন্ডিশন রয়েছে’—একটি প্রতিষ্ঠান কতটা পরিচিতি পেয়েছে, তা বোঝার জন্য এই গানটিই যথেষ্ট। রাজধানীর টিকাটুলি বা হাটখোলার সঙ্গে ৪৮ বছর ধরে জড়িয়ে আছে ‘অভিসার’ নামটি।

১৯৬৯ সালে ঢাকার প্রাণকেন্দ্র মতিঝিলের কাছাকাছি অভিসার হলের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ব্যবসায়ী কামাল উদ্দিন আহমেদ। তিনি কিংবা তাঁর পরিবারের কেউই এখন হলটির সঙ্গে নেই।

হলটির প্রথম দিনের কথা জানা গেল প্রতিষ্ঠানটির প্রবীণ কর্মী ওসমান গনি এবং চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মিয়া আলাউদ্দিনের কাছে।

’৬৪ সালে সিনেমা হলে চাকরি শুরু করেন ওসমান গনি। ’৬৯ সালে ‘বুকিংম্যান’ হিসেবে কাজ করতেন মুনলাইট সিনেমা হলে। টিকাটুলিতে ২৬ কাঠা জমির ওপর একটা বড় সিনেমা হল হয়েছে শুনে দেখতে এসেছিলেন। প্রথম দিন এই হলে তিনি দেখেছিলেন চেঙ্গিস খান ছবিটি। এখন তিনি অভিসার হলেই চাকরি করছেন।

অভিসার সিনেমা হল। একবার বন্ধ হয়ে আবার সচল
অভিসার সিনেমা হল। একবার বন্ধ হয়ে আবার সচল

অভিসার সিনেমার প্রথম সপ্তাহের দর্শক মিয়া আলাউদ্দিন তখন ছাত্র। পুরান ঢাকার নারিন্দায় একটি বাসায় লজিং থাকতেন। সে সময় নতুন চালু হওয়া অভিসারে তিনি দেখেছেন লি জে টম্পসনের দ্য গানস অব নাভারন ছবিটি। বড় পর্দায় দেখা সেই ছবিটির কথা পরিষ্কার মনে আছে তাঁর। সেকি উত্তেজনা! তুরস্কের একটি দ্বীপে দুটি বড় কামান ধ্বংসের জন্য একটি অকুতোভয় দলের অভিযান। গ্রেগরি পেক ছিলেন সেই দলের অন্যতম ক্যাপ্টেন কিথ মেলোরির ভূমিকায়। আরও ছিলেন ডেভিড নিভেন, অ্যান্থনি কুইন, স্ট্যানলি বেকার, অ্যান্থনি কোয়েলে, জেমস রবার্টসন জাস্টিস ও আইরিন পাপাসর মতো শিল্পী। সে সময় অভিসারে আরও দেখানো হয় আজিজুর রহমানের মেরে আরমান মেরে স্বপ্নে, কাজী জহিরের মেহেরবান, রহমানের চলো ম্যান গ্যায়ে, মুস্তাফিজ পরিচালিত পায়েল, নুরুল হক পরিচালিত জলতে সুরজ কে নিচে ইত্যাদি।

প্রথম দিকে নিয়মিত উর্দু ও ইংরেজি ছবি দেখানো হতো। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি ডাকু মনসুর ছবি দিয়ে শুরু হয় বাংলা ছবির প্রদর্শনী। আশির দশকের শেষের দিকে অভিসারের ব্যবসায় মন্দা দেখা দেয়। এরপর বেশ কিছুদিন বন্ধ ছিল হলটি।

নতুন করে অভিসার চালুর গল্প শুনতে যাই দীর্ঘদিন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা মোহাম্মদ শহীদুল্লাহর কাছে। জীবনের প্রায় পুরোটা সময় জড়িয়ে ছিলেন সিনেমা হলের সঙ্গে। অন্তত ২০টি হলে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। এখন থাকেন অভিসার হলের বিপরীতে একটি ভবনে। নিজের ঘর থেকে হল দেখতে পাবেন, এই আশায় ভবনটা তিনি বেছে নিয়েছেন।

অভিসারের প্রসঙ্গ আসতেই পানি ঝরল শহীদুল্লাহর চোখ দিয়ে। বয়সের ভারে ন্যুব্জ শহীদুল্লাহ বলতে পারেননি কিছুই। অভিসার নতুন করে চালুর বিষয়ে তাঁর মেয়ে মাকসুদা শহীদ জানান, ব্যবসাসফল ছবি কেয়ামত থেকে কেয়ামত মুক্তি পেয়েছিল ’৯৩ সালে। তার দুই বছর আগে নতুন করে যাত্রা করে অভিসার।

হলের কর্মকর্তা–কর্মচারীরা l ছবি: প্রথম আলো
হলের কর্মকর্তা–কর্মচারীরা l ছবি: প্রথম আলো

প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান মহাব্যবস্থাপক ক্রীড়াসংগঠক জামিল এ নাসের বলেন, করখেলাপি হওয়ায় দীর্ঘদিন হলটি বন্ধ ছিল। ওই সময়ে অভিসার হলের প্রথম উদ্যোক্তা কামাল উদ্দিন আহমেদ প্রতিষ্ঠানটি বিক্রির সিদ্ধান্ত নেন। পরে চলচ্চিত্র ব্যবসায়ী কে এম আর মঞ্জুর এবং তাঁর বন্ধু সফর আলী ভূঁইয়া তা কিনে নেন। বকেয়া কর পরিশোধ করে ১৯৯০ সালের ২১ জুন নতুন করে চালু হয় অভিসার। ফয়েজ চৌধুরী পরিচালিত রাজার মেয়ে বেদেনি ছবিটি দিয়ে পুনর্জন্ম হয় অভিসারের। ’৯৩ সালে অভিসারের ওপরে চালু করা হয় নেপচুন নামের আরেকটি হল। দুটি হলের অন্যতম অংশীদার কে এম আর মঞ্জুর কয়েক বছর আগে মারা যান। বর্তমানে তাঁর পরিবারের সদস্য এবং সফর আলী ভূঁইয়ার মালিকানায় চলছে অভিসার হল।

ব্যবসাসফল ছবির বিষয়ে জানতে চাইলে অভিসারের বর্তমান ব্যবস্থাপক খায়রুল কবির প্রথমেই উল্লেখ করেন দংশন ছবির কথা। এ ছবি ২৯টি প্রদর্শনী ‘হাউসফুল’ গেছে। যা অভিসারের ইতিহাসে আর ঘটেনি। এরপর প্রেম দিওয়ানা ছবিটির ২৮ প্রদর্শনী হাউসফুল গেছে। সর্বশেষ শাকিব খানের নবাব ছবিটির ৮টি প্রদর্শনী ‘হাউসফুল’ হয়েছে। তিনি বলেন, এখন ছবির ব্যবসা রীতিমতো লোকসান দিয়েই চালাতে হচ্ছে। একে তো নতুন ছবি নেই, তার ওপর দর্শকের খরা। শুধু মালিকপক্ষের আন্তরিকতার জন্যই হলটি টিকে আছে।

অভিসারে নিয়মিত ছবি দেখতেন স্বামীবাগের মনোয়ার হোসেন। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এই কর্মী বলেন, ‘ছাত্রজীবনে সর্বশেষ পুরো ছবি দেখেছি রাঙাবউ। এখনো চোখে ভাসে হ‌ুমায়ুন ফরীদি এবং ঋতুপর্ণা অভিনীত ছবির দৃশ্য।’ আক্ষেপ নিয়ে তিনি বলেন, ‘খুব আগ্রহ নিয়ে গত বছর একটি ছবি দেখতে গিয়েছিলাম। কিন্তু পর্দার অবস্থা দেখে বিরতির আগেই বেরিয়ে পড়ি। আর যাওয়া হয়নি। আমাদের কৈশোর, তারুণ্যের এ প্রতিষ্ঠানটি সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারেনি। সেই আগের অবস্থায় আছে।’

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির মহাব্যবস্থাপক জামিল এ নাসের বলেন, ‘যেহেতু এটি লিমিটেড কোম্পানি, তাই সিদ্ধান্ত নিতে সময় লাগছে। হয়তো সংস্কার না করে পুরোপুরি আঙ্গিকে ভিন্ন পরিসরে চলবে অভিসার।’

গতকাল শুক্রবার ঘুরে দেখা যায়, হলের পরিবেশ মোটামুটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। হলে চলছে ভারতীয় বলো দুগ্গা মাঈকী...ছবিটি। বিকেলের প্রদর্শনীতে মোটামুটি ভিড় ছিল। সন্ধ্যায় বেশ ভালোই ভিড় দেখা যায়।

হলসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, সপ্তাহের অন্য দিনগুলোতে হলে দর্শকখরা থাকলেও শুক্রবার কিছুটা ভিড় হয়।

গোপীবাগ থেকে আসা রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘বাসা কাছে। তাই নতুন ছবি মুক্তি পেলে পরিবার নিয়ে চলে আসি এখানে।’ তিনি বলেন, ‘এই হলের সামনে এসে আড্ডা দিতেও ভালো লাগে। উৎসবগুলোতে নানা রঙে সাজানো হয়। বিজয় দিবসে পতাকা ওড়ায়। ভালোই লাগে।’

ব্যবস্থাপক খায়রুল কবির জানান, বিশেষ দিনে কর্মীদের জন্য বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা করা হয়।

বর্তমানে প্রতিদিন ৪টি শো হয় অভিসারে। হলের আসনসংখ্যা ১ হাজার ২৪০টি। নেপচুনে আছে ৫০০টি। দুই প্রতিষ্ঠানে কর্মী আছেন ৩২ জন। কর্মীদের বেশির ভাগই ’৯১ সালের পর নতুন আঙ্গিকে শুরু হওয়ার পর কাজে যোগ দিয়েছেন। সে সময় থেকে হলে আছেন বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক মোহাম্মদ মোস্তফা। জানালেন তখনকার ব্যবস্থাপক শহীদুল্লাহ তাঁকে ভবনের ভেতরে সংস্কারকাজের সহকারী হিসেবে সুযোগ দেন। বলেন, ‘এই হলটার মায়া ছাড়তে পারি না। তাই আর কোথাও যাওয়ার চেষ্টা করিনি।’

অভিসার-নেপচুনে কানাঘুষা শোনা যায়, মালিকেরা আর হল চালাবেন না। ভবন ভেঙে বড় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হবে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মহাব্যবস্থাপক জামিল এ নাসের বললেন, হল ভেঙে বাণিজ্যিক ভবন হলেও ছোট পরিসরে সিনেপ্লেক্সের মতো করে থাকবে অভিসার।