ডিএনএ না মিললে মেয়েকে কই পাব

৪৯ মরদেহ শনাক্ত করতে দুদিন ধরে চলছে স্বজনদের নমুনা সংগ্রহ।ছবি: তানভীর আহমেদ

দুই বোন রোজিনা খাতুন ও অমৃতা বেগম। দুজনই কাজ করতেন নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের হাসেম ফুডস লিমিটেডের কারখানায়। অমৃতা করতেন ওই কারখানার আগুন লাগা ভবনে। আর পাশের ভবনে কাজ করতেন রোজিনা। তিন দিনেও বোনের খোঁজ পাচ্ছেন না রোজিনা। তাঁর আকুতি, ‘আমার বইনের লাশটা অন্তত দেন।’

শনিবার বিকেলে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গের সামনে কথা হয় রোজিনার সঙ্গে। তাঁর বোন অমৃতা ১ জুন থেকে ৫ হাজার টাকা বেতনে এ কারখানায় কাজে যোগ দেন। তাঁদের গ্রামের বাড়ি হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলায়। ঘটনার দিন সকালেও দুই বোন একসঙ্গে কাজে যান।

অমৃতার সাত বছর বয়সী মেয়ে সোমা আক্তার
ছবি: দীপু মালাকার

রোজিনা বলেন, ‘তিন দিন ধইরা আমার বোনডারে খুঁজতেছি। ওই দিন সারা রাত খুঁজছি, বোনেরে পাই নাই। এক মাস আগে অমৃতা কাজে যোগ দিল, এক মাস পরেই ওরে আমরা হারাইলাম।’

গত বৃহস্পতিবার বিকেলে আগুনের ঘটনার পরপরই রোজিনা যে ভবনে কাজ করছিলেন, সেখান থেকে নেমে আসেন। দেখেন, পাশের ভবনে আগুন তখনো বড় আকারে ছড়ায়নি। কিন্তু মানুষ সেখান থেকে বের হতে পারছিল না। নিরাপত্তাকর্মীরা তখন গেট খুলতে দেননি। তিনি বলেন, ‘যে যেভাবে পারছে বাঁচার চেষ্টা করেছে, ভবন থাইকা লাফ দিছে। ছয়তলা ছাদ থেকে দড়ি দিয়ে মানুষ নামছে। আমার বোনরে আর পাই নাই। সন্ধ্যা পর্যন্ত খুঁজছি, বোন পাই নাই।’

ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে রোজিনা যখন তাঁর বোনের কথা বলছিলেন, পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছিল অমৃতার সাত বছর বয়সী মেয়ে সোমা আক্তার। অমৃতার একটাই মেয়ে। সোমা প্রথম আলোকে বলে, ‘আম্মুকে খুঁজতে অনেক জায়গায় গেছি। গার্মেন্টসে গেছি, হাসপাতালে গেছি, সবাই মিলে গেছি, আমার আম্মুরে পাইছি না।’

গত বৃহস্পতিবার বিকেলে নারায়ণগঞ্জের হাসেম ফুডস লিমিটেডের কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ১৯ ঘণ্টা পর শুক্রবার আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। ঘটনার দিন রাতেই ভবন থেকে লাফিয়ে পড়েন তিনজন। এতে দুজন ঘটনাস্থলেই মারা যান। আর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় একজনের মৃত্যু হয়। আহত হন অর্ধশত শ্রমিক। সব মিলিয়ে এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৫২ জনের প্রাণহানি হয়েছে।

৫৬ স্বজনের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ

নারায়ণগঞ্জের হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডের অগ্নিকাণ্ডে নিহত ব্যক্তিদের স্বজনেরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডিএনএ নমুনা দিতে আসেন। ঢাকা, ১০ জুলাই
ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

ঢাকা মেডিকেল কলেজ সূত্রে জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জের আগুনের ওই ঘটনায় ৫০ জনের লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হয়। এর মধ্যে একজনের লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে। মর্গে আছে ২৬ জনের মরদেহ, ঢাকা মেডিকেল কলেজের জরুরি বিভাগের মর্গে আছে আটজনের মরদেহ এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে রাখা আছে ১৫ জনের মরদেহ।

এই ৪৯ মরদেহ শনাক্ত করতে দুদিন ধরে চলছে স্বজনদের নমুনা সংগ্রহ। ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গের বাইরে একটি বুথ স্থাপন করা হয়েছে। সেখানে শনিবার সকাল আটটা থেকে স্বজনদের কাছ থেকে ডিএনএ নমুনা নিচ্ছে সিআইডির ফরেনসিক ডিএনএ ল্যাবরেটরির একটি দল। এখন পর্যন্ত ৪০টি মরদেহ শনাক্ত করতে ৫৬ জনের ডিএনএ নমুনা নেওয়া হয়েছে।

সিআইডির সহকারী ডিএনএ অ্যানালিস্ট নুসরাত ইয়াসমিন প্রথম আলোকে বলেন, নিকটাত্মীয় যেমন বাবা, মা, ভাই, বোনের শরীর থেকে ডিএনএ নমুনা নেওয়া হয়েছে। ডিএনএ নমুনার ফল আসতে ২১ থেকে ৩০ দিন লাগবে। এ ফল এলে থানা-পুলিশ থেকে স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হবে।

‘আম্মুর ফোন রিং হয়েছিল, ধরেনি’

বোনের নাজমার সন্ধানে মর্গের সামনে আহাজারি করেন মমতাজ বেগম ও সালমা বেগম। সঙ্গে নাজমার ছবি হাতে মেয়ে পাখি
ছবি: দীপু মালাকার

শনিবার সকাল থেকেই ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে প্রিয়জনের মরদেহ খুঁজতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এসেছেন স্বজনেরা। দুপুরে ডিএনএ নমুনা দিতে এসেছে ১৩ বছর বয়সী নাজমুল হোসেন। সে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের হাসেম ফুডস লিমিটেডের কারখানার দোতলায় টেস্টিং সল্ট মেশিনে মালামাল দেওয়ার কাজ করে। তার মা নাজমা বেগম কাজ করতেন ওই কারখানার চারতলায়। এক বছর আগে তাঁর মা এ কারখানায় কাজ নেন।

নাজমুল জানায়, ছয় হাজার টাকা বেতন পায় সে। বৃহস্পতিবার বিকেল চারটার দিকে তার ছুটি হয়ে গেলে সে বাসায় চলে যায়। পাঁচটার দিকে আগুন লাগার খবর পায়। নাজমুল প্রথম আলোকে বলে, ‘মায়ের খোঁজে ছুটে যাই কারখানায়। গিয়ে দেখি, কারখানায় ঢোকা যাচ্ছে না, ভবনে আগুন। আম্মুর ফোনে রিং হয়, ব্যস্ত দেখায়, কিন্তু কেউ ধরে না। রাত ১২টা পর্যন্ত আম্মুকে ফোন করেছি। এরপর ফোন বন্ধ হয়ে যায়। আমার আম্মুকে কি খুঁজে পাব না?’

টুকটুকির প্রথম চাকরিই শেষ চাকরি

হাসানুজ্জামান সরকার
ছবি: দীপু মালাকার

গত ৭ মার্চ রূপগঞ্জের হাসেম ফুডস লিমিটেডে কাজে যোগ দেন গাইবান্ধা সদরের প্রফেসর কলোনি এলাকার বাসিন্দা নুসরাত জাহান টুকটুকি। ২৪ বছর বয়সী টুকটুকি কারখানার পাশেই ভাড়া বাসায় থাকতেন। এখন মেয়েকে হারিয়ে পাগলপ্রায় বাবা হাসানুজ্জামান সরকার। টুকটুকি তাঁর ছোট মেয়ে।

হাসানুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, পলিটেকনিকের খাদ্য নিয়ে পড়ালেখা শেষে বিএসসি করার আগে সময় পাওয়ায় তাঁর মেয়ে এই চাকরিটা নেয়। তিনি বলেন, ‘মেয়ে বলত, বাবা বসে না থেকে একটা চাকরি করি। পরে বিএসসিতে ভর্তি হব। আমার মেয়ের এটাই জীবনের প্রথম চাকরি। এই চাকরিই তাঁর শেষ চাকরি হলো।’

ডিএনএ না মিললে মেয়েকে কই পাব

ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গের সামনে অসহায় হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জের বাসিন্দা মো. স্বপন মিয়া। তাঁর মেয়ে মোসাম্মাত সাগরিকা শায়লা রূপগঞ্জের ওই কারখানায় সাড়ে তিন বছর ধরে কাজ করতেন। কারখানার তিনতলায় সেজান জুসে কাজ করে মাসিক বেতন পেতেন পাঁচ হাজার টাকা। মেয়ের কথা বলতে গিয়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদছেন স্বপন মিয়া। সেদিন সকাল ৭টা ১০ মিনিটে বাসা থেকে বের হন সাগরিকা। আর ফেরেননি।

তিনি বলেন, ‘ঢাকা মেডিকেল কলেজে এসেও মেয়েকে পাওয়া গেল না। এখানে যে লাশগুলো আছে, এগুলো দেখার মতো পরিস্থিতি নেই। বস্তায় ভরা পোড়া লাশ দেখেও কিছু চেনা যায় না। হাড্ডি আছে, ছেলে না মেয়ে কিছু বোঝা যায় না।’ স্বপন মিয়া বলেন, ‘তিন মাসে আগে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। তিন মাস পরেই মেয়েটাকে হারাইলাম। এখানে ডিএনএ নমুনা দিলাম, ফল পেতে ২১ দিন থেকে ৩০ দিন লাগবে। যদি না মিলে তাহলে আমার মেয়ে কই পাব?’

স্বপন মিয়াদের বাসা রূপগঞ্জের শান্তিনগর এলাকায়। নারায়ণগঞ্জ থেকে কীভাবে এলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মেয়ের খোঁজে সকালে নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকা মেডিকেল আসছি রিকশা দিয়ে। লকডাউনে গাড়ি চলাচল বন্ধ, ভেঙে ভেঙে এসেছি।’