ঢাকাকে বিচ্ছিন্ন রাখার চেষ্টা

ঢাকার আশপাশের জেলা মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ ও গাজীপুর

এবং মাদারীপুর, রাজবাড়ী ও গোপালগঞ্জে চলাচল বন্ধ ঘোষণা।

সপ্তাহব্যাপী কঠোর বিধিনিষেধের প্রথম দিনে ফরিদপুর শহরের প্রবেশমুখে ২১টি চেকপোস্ট বসিয়েছে পুলিশ। বিধিনিষেধ অমান্য করে অটোরিকশায় যাত্রীরা শহরে প্রবেশ করতে চাইলে পুলিশ বাধা দেয়। গতকাল দুপুরে শহরের গোয়ালচামট এলাকায়।
ছবি: আলীমুজ্জামান

করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে রাজধানীকে সারা দেশ থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ঢাকার আশপাশের চারটি জেলাসহ মোট সাতটি জেলায় জরুরি সেবা ছাড়া সব ধরনের চলাচল ও কার্যক্রম বন্ধ থাকবে। এমন বিধিনিষেধ আজ মঙ্গলবার সকাল ছয়টা থেকে শুরু হয়ে চলবে ৩০ জুন মধ্যরাত পর্যন্ত।

এই সাত জেলা হলো মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, গাজীপুর, মাদারীপুর, রাজবাড়ী ও গোপালগঞ্জ। এসব জেলায় ঢাকা থেকে দূরপাল্লার বাস চলবে না। দূরের যাত্রার ট্রেন চললেও এই সাত জেলায় থামবে না। ঢাকা থেকে যাত্রীবাহী নৌযানও চলবে না। এর ফলে নয় দিন কার্যত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকবে রাজধানী।

দেশে করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ন্ত্রণে সরকার এ বছর প্রথমে ৫ এপ্রিল থেকে সাত দিনের জন্য গণপরিবহন চলাচলসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপ করেছিল। পরে তা আরও দুই দিন বাড়ানো হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আসায় ১৪ থেকে ২১ এপ্রিল পর্যন্ত আরও কঠোর বিধিনিষেধ দিয়ে ‘সর্বাত্মক লকডাউন’ শুরু হয়। পরে তা আরও আট দফা বাড়িয়ে ১৫ জুলাই পর্যন্ত করা হয়।

কিন্তু দেশে সংক্রমণ পরিস্থিতি এখন চলতি বছরের এপ্রিলের মতো আবারও ভয়ংকর রূপ নিচ্ছে। গতকাল সোমবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, গত রোববার সকাল আটটা থেকে গতকাল সকাল আটটা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ৪ হাজার ৬৩৬ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে। এক দিনে রোগী শনাক্তের এই সংখ্যা গত দুই মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এর চেয়ে বেশি করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছিল গত ১৪ এপ্রিল (৫ হাজার ১৮৫ জন)। গত ২৪ ঘণ্টায় পরীক্ষার বিপরীতে রোগী শনাক্তের হার ছিল ১৯ দশমিক ২৭ শতাংশ। গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় আক্রান্ত ৭৮ জনের মৃত্যু হয়েছে।

যে সাত জেলায় লকডাউন দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে গোপালগঞ্জ ও রাজবাড়ী ছাড়া বাকি পাঁচটিতে গত ২৪ ঘণ্টায় রোগী শনাক্তের হার ২০ শতাংশের নিচে ছিল। তবে গোপালগঞ্জে এই হার ছিল ৪২ দশমিক ৪৫ শতাংশ এবং রাজবাড়ীতে ছিল ৬৩ দশমিক ১১ শতাংশ, আর ঢাকায় রোগী শনাক্তের হার ছিল প্রায় ১২ শতাংশ।

করোনা সংক্রমণের এমন পরিস্থিতিতে ঢাকাকে প্রায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে গতকাল সোমবার অনেকটা আকস্মিকভাবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ নতুন করে সাত জেলার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ দিয়ে আদেশ জারি করে। এতে বলা হয়, এই সময়ে ওই সাত জেলায় শুধু আইনশৃঙ্খলা এবং জরুরি পরিষেবা, যেমন কৃষি উপকরণ (সার, বীজ, কীটনাশক, কৃষি যন্ত্রপাতি ইত্যাদি), খাদ্যশস্য ও খাদ্যদ্রব্য পরিবহন, ত্রাণ বিতরণ, স্বাস্থ্যসেবা, কোভিড-১৯ টিকা প্রদান, বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস বা জ্বালানি, ফায়ার সার্ভিস, বন্দরগুলোর (নদীবন্দর) কার্যক্রম, টেলিফোন ও ইন্টারনেট (সরকারি-বেসরকারি), গণমাধ্যম (প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া), বেসরকারি নিরাপত্তাব্যবস্থা, ডাক সেবাসহ অন্যান্য জরুরি ও অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ও সেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অফিসগুলো, তাদের কর্মচারী ও যানবাহন এবং পণ্যবাহী ট্রাক বা লরি এই নিষেধাজ্ঞার আওতার বাইরে থাকবে।

এ বিষয়ে গতকাল সচিবালয়ে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘কয়েক দিন ধরে করোনা সংক্রমণ বেড়ে চলেছে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে সিদ্ধান্ত হয়েছে, ঢাকাকে আমরা একটু কাট-অফ (বিচ্ছিন্ন) রাখতে চাই অন্য জেলার সঙ্গে। ঢাকার সঙ্গে প্রায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলে এমনিতেই চলাচল কমে যাবে।’ তিনি বলেন, প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে এই সাত জেলা ৩০ জুন পর্যন্ত ‘লকডাউনে’ আনা হয়েছে। এই সময়ে মানুষও যাতায়াত করতে পারবে না।

হঠাৎ এই সিদ্ধান্ত আসায় রাজধানীবাসীর মধ্যে যাঁরা নানা কাজে ঢাকার বাইরে গেছেন, আবার বাইরের জেলাগুলো থেকে যাঁরা ঢাকায় এসেছেন তাঁরা নিজের বাসস্থানে ফেরা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন।

দূরপাল্লার বাস চলবে না

চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা সাত জেলার মধ্যে মানিকগঞ্জের ওপর দিয়ে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর যানবাহন চলাচল করে। আর নারায়ণগঞ্জের সীমানার ওপর দিয়ে চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলের গাড়ি চলাচল করে। গাজীপুরের ওপর দিয়ে ময়মনসিংহ অঞ্চল এবং উত্তরাঞ্চলের গাড়ি চলাচল করে। আর মুন্সিগঞ্জের ওপর দিয়েও চলে বিভিন্ন জেলার গাড়ি।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ওই সব জেলার ওপর দিয়ে কোনো গাড়ি চলবে না, মানুষও চলাচল করবে না। ওই সব জেলা দিয়ে চলতে না পারা মানে ঢাকা ‘সিল’ করা।

ঢাকা থেকে দূরপাল্লার বাস ছেড়ে যাবে না বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ।

এই সাত জেলা ছাড়াও বর্তমানে রাজশাহী মহানগর, কুষ্টিয়া, নোয়াখালী, সাতক্ষীরা, নাটোর সদর ও সিংড়া উপজেলা, বগুড়া সদর, দিনাজপুর সদরসহ কিছু এলাকায় স্থানীয় প্রশাসন ‘লকডাউন’ ঘোষণা করেছে।

মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, যদি স্থানীয় কর্তৃপক্ষ মনে করে, তাদের এলাকায় করোনা সংক্রমণ বেশি ছড়িয়ে গেছে, তাহলে তারা বন্ধ করতে পারবে। এ বিষয়ে আগেই তাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

ট্রেন ও নৌযান

রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরে যেসব ট্রেন চলে, সেগুলো বন্ধ থাকবে। কিন্তু দূরের যাত্রার ট্রেনগুলো যথারীতি চলবে। তবে যে সাত জেলায় বিধিনিষেধ দেওয়া হয়েছে, সেখানে ট্রেন থাকবে না।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) চেয়ারম্যান কমোডর গোলাম সাদেক গতকাল সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, বিধিনিষেধের মধ্যে সাত জেলায় যাত্রীবাহী নৌযান চলবে না।

রাতে সাড়ে ১১টার দিকে বিআইডব্লিউটিএ সংশোধিত জরুরি বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, মঙ্গলবার (আজ) সকাল ৬টা থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত সাতটি জেলার (মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, গাজীপুর, মাদারীপুর, রাজবাড়ী ও গোপালগঞ্জ) নৌ চলাচল বন্ধ থাকবে। পাশাপাশি ঢাকা থেকে সারা দেশে যাত্রীবাহী নৌযান চলাচল বন্ধ থাকবে। তবে পণ্য পরিবহনকারী ও জরুরি সেবা এই নিষেধাজ্ঞার বাইরে থাকবে।

সরকারের এই সিদ্ধান্তের ব্যাপারে জনস্বাস্থ্যবিদ মুশতাক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘যেসব জেলায় শনাক্তের হার ১০ শতাংশের বেশি, সেখানে যাতায়াত নিয়ন্ত্রণে রাখা দরকার। আগামী ঈদের সময় সংক্রমণ আরও বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি আছে। ঈদের আগে সারা দেশে শনাক্তের হার ১০-এর নিচে থাকা দরকার। তাই ঢাকার সঙ্গে অন্যান্য জেলার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রাখার সিদ্ধান্ত সঠিক হয়েছে বলে মনে করেন তিনি।