দখলদার রয়ে গেল, সরে এল গৃহায়ণ

মিরপুরে বেদখল জমি উদ্ধার করতে না পেরে কল্যাণপুরে পুরোনো আবাসন প্রকল্পের ‘খেলার মাঠে’ ভবন নির্মাণের উদ্যোগ

কল্যাণপুর হাউজিং এস্টেটের খেলার মাঠে ভবন নির্মাণের জন্য মিনি গোলপোস্ট ভেঙে দিয়েছে গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ। গত রোববার দুপুরে রাজধানীর কল্যাণপুরে।
ছবি: প্রথম আলো

রাজধানীর মিরপুরে নিজেদের একটি আবাসন প্রকল্পের বেদখল জমি উদ্ধার করতে না পেরে পরিকল্পনাই বদলে ফেলেছে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ। সংস্থাটি ভবন নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে আরেকটি পুরোনো আবাসন প্রকল্পের উন্মুক্ত জায়গায়।

এই পরিকল্পনায় অবশ্য আপত্তি পুরোনো আবাসন প্রকল্পটির বাসিন্দাদের। তাঁরা বলছেন, যে জায়গায় ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তার একাংশ শিশু-কিশোর ও তরুণেরা খেলার মাঠ হিসেবে ব্যবহার করে। আরেকাংশ গাছগাছালিতে ভরা। ভবন নির্মাণ করতে হলে সেগুলো কাটতে হবে।

গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, মিরপুর ১৪ নম্বরের ভাষানটেক বস্তিসংলগ্ন ধামালকোট এলাকায় ‘গৃহসূচনা’ প্রকল্পের অধীনে আটটি ভবন করার কথা ছিল। কিন্তু যে পরিমাণ জমি তারা উদ্ধার করতে পেরেছে, সেখানে ছয়টি ভবন নির্মাণ সম্ভব হচ্ছে। এই ভবনগুলোর নির্মাণকাজ চলছে ২০১৮ সাল থেকে। বাকি দুটি ভবন তারা কল্যাণপুর হাউজিং এস্টেটের ভেতরের উন্মুক্ত এলাকা হিসেবে নির্ধারিত জমিতে করতে চায়।

পরিকল্পিত আবাসিক এলাকার ভেতরে কেন এই ভবন করা হচ্ছে, তা জানতে চাইলে গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মো. দেলওয়ার হায়দার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ডিপিপি (প্রকল্প প্রস্তাব) সংশোধন করে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এর বাইরে আর কিছু বলার নেই।’

কল্যাণপুর হাউজিং এস্টেটের অবস্থান মিরপুরের সরকারি বাঙলা কলেজের ঠিক বিপরীত দিকে। ১৯৮৪ সালে সেখানে প্রায় ১০ একর জমিতে ১২টি ভবন তৈরি করে ২৪০টি ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেওয়া হয়। হাউজিংয়ের বাসিন্দারা জানান, গত ৩০ জুন অভিযান চালিয়ে ফুটবল খেলার মাঠের গোলবার ও কমিউনিটি ক্লাব হিসেবে ব্যবহার করা ভবন ভেঙে ফেলা হয়। এরপর জমি টিনের বেড়া দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়।

গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের গৃহসংস্থান বিভাগ-২-এর নির্বাহী প্রকৌশলী আবু হোরায়রা প্রথম আলোকে বলেন, যে জায়গায় ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেটি নকশা অনুযায়ী খেলার মাঠ নয়। সেখানে আরেকটি খেলার মাঠ আছে।

কল্যাণপুর হাউজিং এস্টেটে যে আর ভবন করা সম্ভব নয়, তা উঠে এসেছিল গৃহায়ণের জরিপেই। ১৯৯৭ সালে এই জরিপে বলা হয়, প্রকল্পের নকশায় কমিউনিটি সেন্টারের জন্য জায়গা বরাদ্দ আছে। বাকি খোলা জায়গা ফুটবল ও ক্রিকেট খেলার মাঠ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। পাশাপাশি সমিতির অফিস করা হয়েছে। এসব সুবিধা রেখে নতুন ভবন তৈরি সম্ভব নয় বলে প্রতীয়মান হয়। হাউজিংয়ের বাসিন্দা এস এম মোফাজ্জল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, এত বছর পর এসে নতুন ভবন নির্মাণ করে একটি পরিকল্পিত আবাসন প্রকল্পকে নষ্ট করা হচ্ছে।

এদিকে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইট ঘেঁটে দেখা যায়, গৃহসূচনা আবাসন প্রকল্পে স্বল্প ও মধ্যম আয়ের মানুষের জন্য ৪৬০টি ফ্ল্যাট তৈরির কথা, যার বেশির ভাগ ইতিমধ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি গিয়ে দেখা যায়, ধামালকোটে প্রকল্পের এক পাশে বস্তিঘরে নিম্ন আয়ের মানুষের বাস। নাম প্রকাশ না করার শর্তে গৃহায়ণের এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, এই প্রকল্প এলাকায় গৃহায়ণের আরও জমি বেদখল হয়ে আছে। উদ্ধার করা গেলে আটটি ভবন এক জায়গায় নির্মাণ করা যেত।

বাংলাদেশের কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের (সিএজি) ২০২০ সালের বার্ষিক নিরীক্ষা প্রতিবেদন বলছে, মিরপুরের বিভিন্ন মৌজায় গৃহায়ণের অন্তত ৮৪৮ একর জমি বেদখল হয়ে আছে। মৌজা দরে এসব জমির বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ১১ হাজার ৮৩৪ কোটি টাকা। প্রতিবেদনে এ-ও বলা হয়, কিছু লোককে অনৈতিক সুবিধা দেওয়ার জন্য এবং দায়িত্ব পালনে গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারণে দখলদারের হাত থেকে সরকারি জমি উদ্ধার করা যাচ্ছে না।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান প্রথম আলোকে বলেন, কোন গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার জন্য সরকারি জমি উদ্ধার না করে পরিকল্পিত আবাসনের ভেতরে বহুতল ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তার তদন্ত হওয়া উচিত।