দিনে লিফটম্যান, রাতে আঁকিয়ে
গ্রামে যে কারও ছবি দেখে হবহু এঁকে দিতে পারতেন। প্রকৃতি, প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের জীবনের গল্প তুলির আঁচড়ে তুলে আনতেন। মাটি দিয়ে ভাস্কর্য বানাতেন। রংতুলির সঙ্গে যে আত্মিক সম্পর্ক অনুভব করতেন, আর্থিক লড়াইয়ের মুখে পড়ে তা ফিকে হতে থাকে। তবে এই লড়াইয়ের কঠিনতম সময়ে প্রিয় মানুষের অনুপ্রেরণায় আবারও রংতুলিতে ফিরে পেয়েছেন স্বাচ্ছন্দ্য। দিনে একটি বাণিজ্যিক ভবনের লিফটম্যানের কাজ করেন। কাজ থেকে বাড়ি ফিরে গভীর রাত পর্যন্ত চলে শিল্পচর্চা।
এই শিল্পীর নাম জিয়াবুল হক ওরফে জনি (৩৫)। তিনি দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকার ইউনুস সেন্টারের লিফটম্যান।
জিয়াবুলের বাড়ি চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলায়। বাবার নাম সুজা মিয়া। মা বিবি হাওয়া। বাবা বেঁচে নেই। চার ভাই এক বোনের মধ্যে জিয়াবুল চতুর্থ। স্ত্রী শিরিন আক্তার এবং ১১ বছর বয়সী ছেলে মো. আনাসকে নিয়ে ডেমরার কোনাপাড়া এলাকায় শাহজালাল রোডে দুই কক্ষের একটি বাড়িতে ভাড়া থাকেন।
প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপচারিতায় জিয়াবুল জানান, ছবি আঁকা ও ভাস্কর্য তৈরির বিষয়ে তাঁর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। তিনি কারও কাছে আঁকা শেখেননি। সম্পূর্ণ নিজের ভালো লাগা ও আগ্রহ থেকে শিখেছেন।
চাল-সুপারি বিক্রি করে রং কেনা
জিয়াবুলের ভাষায়, লেখাপড়ার চেয়ে আঁকাআঁকিতে মনোযোগ ছিল বেশি। এ কারণে স্কুলের গণ্ডি পেরোনো হয়নি। স্কুলে ক্লাস চলার সময়ে ছবি আঁকার কারণে শিক্ষকের বকা খেয়েছেন।
পরিবার থেকে সমর্থন না পেলেও এঁকে যেতেন জিয়াবুল। রং-কাগজ কিনতেন কীভাবে জানতে চাইলে বলেন, ওই সময় তিন টাকায় রং পাওয়া যেত। আর দুটি কাগজের দাম ছিল এক টাকা। রং-কাগজ কেনার কথা বাসায় বলাই যেত না। তাই এই টাকা জোগাড় করতে বাড়ির গাছের সুপারি আর ঘরে থাকা চাল লুকিয়ে নিয়ে বিক্রি করে দিতেন। ছবি এঁকে মাটির ঘরের দেয়ালজুড়ে লাগিয়ে রাখতেন। গ্রামে এই সব ছবির কোনো কদর ছিল না। আঁকতে ভালো লাগত বলে নিজের জন্য এঁকে যেতেন। গ্রামের এক চাচা একবার তাঁর চায়ের দোকানের জন্য কয়েকটি ছবি চেয়ে নিয়েছিলেন।
জিয়াবুলের মা বিবি হাওয়া প্রথম আলোকে বলেন, জনি অনেক মেধাবী ছিল। ওর আঁকা ছবি, মাটি দিয়ে বানানো গরু দেখলে সবাই প্রশংসা করত। কিন্তু পড়াশোনা করল না। তিনি বলেন, ‘ছোটবেলায় অনেক মারতাম। বলতাম, এগুলা কইরা কী করবি? ছবি আঁকলে কি জীবন চলে!’ এখন ছেলের আঁকা ছবি দেখলে তাঁর ভালো লাগে বলে জানালেন। তবে ছেলের আর্থিক সংকট তাঁকে তীব্র কষ্ট দেয়। ছেলে সারা দিন লিফটম্যানের কাজ করে। আর মধ্যরাত পর্যন্ত ছবি আঁকে। ছেলে এই কষ্টের যেন প্রতিদান পায়, সেই প্রার্থনা তাঁর।
রংতুলিতে ফেরা
আঁকা নেশা হলেও চিত্রকর্ম ও ভাস্কর্য বিক্রি করে কখনো আয় করার কথা মাথায় আসেনি জিয়াবুলের। ৭ থেকে ১৫ বছর বয়স পর্যন্ত শুধু নিজের জন্য এঁকেছেন। এরপর তা অনিয়মিত হয়ে পড়ে। এর মধ্যেই বেকার অবস্থায় ২০১০ সালে বিয়ে করেন। মূলত দুই ভাই আর শ্বশুরবাড়ির সহায়তায় সংসার চলত তাঁর। এরপর সাহস করে স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে ২০১৪ সালে চলে এলেন ঢাকায়। প্রচণ্ড অর্থকষ্টে দিন যাপন করছিলেন। ওই সময় ইউনুস সেন্টারে ছয় হাজার টাকা বেতনে লিফটম্যানের চাকরি পান। ওই টাকায় বাসাভাড়া দিয়ে ভাত-কাপড় জোগাড় করাই মুশকিল হয়ে যায়। এই সময় স্ত্রী শিরিন তাঁকে আবার ছবি আঁকতে শুরু করতে বলেন।
জিয়াবুল বলেন, ‘স্ত্রী আমাকে অনুপ্রেরণা দেয়। এত অভাবের মধ্যে ছিলাম, স্ত্রী কোনো দিন কোনো কিছুর জন্য চাপ দেয়নি। একদিন আমাকে বলল, তুমি এত সুন্দর ছবি আঁকতে পারো, সেগুলো এঁকে বিক্রি করো।’
জিয়াবুল জানান, ২০১৭ সালে তিনি ক্যানভাসে কাজ শুরু করেন। ভাতের মাড় আর কাগজ দিয়ে ভাস্কর্য করেন। নানা জায়গায় ধরনা দিয়ে ছবি বিক্রি শুরু করেন। করোনাকালের আগে বনানী সুপারমার্কেটের ওয়ার্ল্ড আর্ট গ্যালারিতে ছবি দিতেন বিক্রির জন্য। করোনার জন্য এখন সব বন্ধ।
ওয়ার্ল্ড আর্ট গ্যালারির ব্যবস্থাপক সুজন হালদার প্রথম আলোকে জানান, তাঁরা ৪০-৫০ জন শিল্পীর কাছ থেকে ছবি কিনে নেন। এর মধ্যে জিয়াবুলও একজন।
শুক্রবার ছুটির দিনে জিয়াবুল বাড়িতে দুটি শিশুকে চিত্রাঙ্কন শেখান। তাঁর পাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দা সানোয়ারা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, বছর তিনেক ধরে তাঁরা প্রতিবেশী। তখন থেকেই দেখছেন জিয়াবুল ছবি আঁকেন। জিয়াবুলের আঁকা দেখলে তিনি মুগ্ধ হন।
‘ছোট আর্টিস্ট’
ইউনুস সেন্টারে অবস্থিত একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তার স্ত্রী জাকিয়া আক্তার গত জুলাই মাসে চার হাজার টাকায় জিয়াবুলের কাছ থেকে ছবি কিনে নেন। জাকিয়া আক্তার প্রথম আলোকে ছবিটির ব্যাপারে উচ্চ প্রশংসা করেন। তাঁর দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা চিত্রকর্মটির একটি ছবি প্রথম আলোকে পাঠান। তিনি বলেন, ‘একজন লিফটম্যান এত ভালো ছবি আঁকে শুনেই ছবিটি কিনতে আগ্রহী হই।’
জিয়াবুল জানালেন, ওই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের আরেক কর্মকর্তাও তাঁর কাছ থেকে কয়েকটি ছবি নিয়েছেন এবং যখনই দেখা হয়, তাঁকে উৎসাহ দিয়ে আঁকা চালিয়ে যেতে বলেন।
তবে জিয়াবুলের মনে দুঃখ, ‘ছোট আর্টিস্ট’ বলে বড় প্রতিষ্ঠানগুলো তাঁকে পাত্তা দেয় না। একবার এক প্রতিষ্ঠানের জন্য একটি চিত্রকর্ম দিয়েছিলেন। তবে অখ্যাত শিল্পী বলে ওই চিত্রকর্মে নিজের নাম স্বাক্ষর করতে পারেননি। এর ওপর লিফটম্যান শুনলে অনেকে বিশ্বাসই করতে চায় না তিনি আঁকতে পারেন।
চিত্রকর্মে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই, পুঁথিগত বিদ্যা কম, ‘ছোট চাকরি’ এসব ছাপিয়ে শুধু শিল্পী পরিচয়ে এগিয়ে যেতে চান জিয়াবুল।