দীর্ঘমেয়াদে এলএনজি আমদানি করা ঠিক হবে না: সিপিডি
চাহিদা ও সরবরাহের ঘাটতি মেটাতে আমদানি করা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) ওপর নির্ভরতা বাড়ছে। তবে দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হিসেবে এলএনজি আমদানির বিষয়টি বিবেচনা করা ঠিক হবে না বলে মনে করছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)।
রোববার ‘জ্বালানি সরবরাহে গ্যাস-এলএনজি বিতর্ক: বিদ্যুৎ খাতে এলএনজি আমদানির ব্যয়জনিত প্রতিক্রিয়া’ শিরোনামে একটি গবেষণা নিবন্ধে এমন প্রতিক্রিয়া জানায় সিপিডি। অনলাইনে অনুষ্ঠিত এক ওয়েবিনারের মাধ্যমে গবেষণা নিবন্ধটি তুলে ধরা হয়।
নিবন্ধে বলা হয়, দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হিসেবে এলএনজি আমদানির বিষয়টি বিবেচনা করা ঠিক হবে না, বিশেষ করে বিদ্যুৎ খাতে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের দিকে যেতে হবে। এ ছাড়া দেশীয় উৎস থেকে গ্যাস উৎপাদন ও সরবরাহে জোর দিতে হবে।
২০২০-২১ অর্থবছরে প্রতি ইউনিট (ঘনমিটার) এলএনজি আমদানিতে ৩১ টাকা ৫৩ পয়সা খরচ হয়েছে বলে জানায় সিপিডি। অথচ একই সময়ে বিদ্যুৎ খাতে প্রতি ইউনিট গ্যাস বিক্রি হয়েছে ৪ টাকা ৪৫ পয়সায়। এলএনজি আমদানির কারণে ২৭ টাকা বাড়তি খরচের বোঝা যুক্ত হয়েছে।
অপরদিকে ২০২১-২২ অর্থবছরে এলএনজি আমদানিতে খরচ বাড়বে ৭২ শতাংশ। গড়ে প্রতি ইউনিট এলএনজি কিনতে হবে ৩৪ টাকা ৩৭ পয়সায়। এটি সরবরাহ পর্যন্ত পেট্রোবাংলার ইউনিট প্রতি খরচ পড়বে ৫০ টাকা ৩৯ পয়সা।
ওয়েবিনারে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) চেয়ারম্যান আবদুল জলিল বলেন, এলএনজি আমদানি এখনই বন্ধ করা যাবে না। দক্ষ ব্যবস্থাপনা ও সাশ্রয়ী ব্যবহারের মধ্য দিয়ে চলমান সংকট উত্তরণ করতে হবে। গ্যাসের দাম শতভাগ বাড়ানোর প্রস্তাব দিতেই পারে। কিন্তু আইন ও বিধি মেনে সিদ্ধান্ত নেবে কমিশন। আতঙ্কের কিছু নেই। দাম অবশ্যই সহনশীল হবে।
এলএনজি টার্মিনাল আরও বাড়ানো এবং পাইপ লাইন তৈরিতে জোর দেওয়া দরকার বলে মনে করেন আবদুল জলিল। এতে করে খোলাবাজারে দাম কমলে এলএনজি কিনে মজুত করা যাবে। আর এলএনজি কিনতে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি আরও বাড়াতে পারে সরকার।
বিইআরসির সদস্য মকবুল-ই-এলাহী চৌধুরী বলেন, গ্যাস অনুসন্ধানে বিদেশি কোম্পানির আগ্রহ কমার কথা বলা হচ্ছে। অথচ তেল-গ্যাস সম্পর্কিত সব তথ্য তাদের দেওয়া হচ্ছে না। তথ্য ছাড়া তারা কীভাবে আগ্রহী হবে। তথ্য থাকার পরও সমুদ্রে বহুমাত্রিক জরিপ চালাতে না পারাকে দোষারোপ করা হচ্ছে।
সব বিকল্প নিয়েই বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সমন্বিত মহাপরিকল্পনা করা হচ্ছে বলে জানান বিদ্যুৎ বিভাগের নীতি-গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন। তিনি বলেন, বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো এখন চাহিদার ৪২ শতাংশ গ্যাস পাচ্ছে। অথচ ক্যাপটিভে (শিল্পে নিজস্ব উৎপাদিত বিদ্যুৎ) গ্যাস দেওয়া হচ্ছে। প্রয়োজনে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের চুক্তি করে হলেও ক্যাপটিভে গ্যাস সরবরাহের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করতে হবে।
ওয়েবনিয়ারে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ম তামিম বলেন, পেট্রোবাংলা নিজেই প্রক্ষেপণ করেছে, গ্যাসের চাহিদা বাড়বে ও উৎপাদন কমবে। অথচ অনুসন্ধান ও উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়নি। আমদানিতে জোর দিয়েছে। সবার মধ্যে একটি আমদানি মানসিকতা তৈরি হয়েছে। আবার দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি থেকে সরবরাহের নিশ্চয়তা বাড়ানো হয়নি। এখন হয়তো তেলের চেয়ে এলএনজির দাম বেশি। এটা সাময়িক। এ ধাক্কা সামলাতে হবে। হঠাৎ করে এলএনজি আমদানি থেকে সরে আসার সুযোগ নেই।
ভূতত্ত্ববিদ বদরুল ইমাম বলেন, প্রাকৃতিক গ্যাসের সম্ভাবনাময় একটা দেশে এ সংকট দুঃখজনক। গ্যাসের সরবরাহ কমার এ সংকট অবহেলাজনিত। গত ২২ বছরে প্রতি বছর গড়ে একটি অনুসন্ধান কূপ খনন করা হয়েছে। এটি না করার মতোই। স্থলভাগে তিন ভাগের দুই ভাগ এখনো অনুসন্ধানের বাইরে পড়ে আছে। আর সমুদ্র তো আছেই। ১০ থেকে ২০ বছরের কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা দরকার, যেখানে সবার আগে থাকবে অনুসন্ধান।
অনুষ্ঠানের শুরুতে স্বাগত বক্তব্য দেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। তিনি বলেন, সাধারণ মানুষের ওপর যেন চাপ না পড়ে। আবার অর্থনীতিতে ভর্তুকির বিষয়টিও বিবেচনা করা লাগবে। এলএনজি আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে যেতে হবে।
গবেষণাটি করেছেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, জ্যেষ্ঠ গবেষণা সহযোগী আবদুল্লাহ ফাহাদ ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের অধ্যাপক শাহ মো. আহসান হাবীব। গোলাম মোয়াজ্জেম ও আবদুল্লাহ ফাহাদ যৌথভাবে নিবন্ধটি উপস্থাপন করেন।