দুর্নীতি, অনিয়ম সবই হয় পরিবহন বিভাগে

নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার পর গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন।

নাঈম হাসান

ময়লাবাহী গাড়িচাপায় নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার পর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে পরিবহন বিভাগের দুর্নীতি, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার বিষয়টি উঠে এসেছে। তদন্ত প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, দুর্নীতি করতে পরিবহন বিভাগের কর্মকর্তারা অনেক ক্ষেত্রে তথ্য গোপন করেন। গাড়ি বরাদ্দ দেওয়ার ক্ষেত্রে পরিবহন বিভাগের মহাব্যবস্থাপকের অনিয়মের তথ্যও পেয়েছে তদন্ত কমিটি। এমন পরিস্থিতিতে কমিটি বলেছে, পরিবহন বিভাগকে নতুন করে ঢেলে সাজানো না হলে ময়লার গাড়ির চাপায় সড়কে দুর্ঘটনা ঘটতেই থাকবে।

দক্ষিণ সিটির দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তা এসব বিষয় নিশ্চিত করেছেন। তাঁরা বলছেন, তদন্ত কমিটি জানতে পেরেছে, শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার ঘটনায় মো. হারুন মিয়া নামে ময়লাবাহী গাড়ির যে চালককে কর্মচ্যুত করা হয়েছে, তিনি আসলে সিটি করপোরেশনের নিয়োগপ্রাপ্ত কোনো কর্মীই নন। হারুন নিজেও বিষয়টি কমিটির কাছে স্বীকার করেছেন। করপোরেশনের কর্মী না হয়েও ১৮ মাস ধরে ময়লাবাহী ওই গাড়ি (ঢাকা মেট্রো শ ১১-১২৪৪) তাঁর নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলেন। এ জন্য তাঁকে পরিবহন বিভাগের কর্মকর্তাদের নানাভাবে ‘ম্যানেজ’ করতে হয়েছে।

সিটি করপোরেশন হারুনকে কর্মচ্যুত করার সময় দৈনিক মজুরিভিত্তিক পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে উল্লেখ করেছিল। তবে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হারুন বহিরাগত, পরিচ্ছন্নতাকর্মী নন।

গত ২৪ নভেম্বর দুপুরে রাজধানীর গুলিস্তান এলাকায় ময়লাবাহী গাড়ির চাপায় নিহত হন নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থী নাঈম হাসান। ওই দিন সন্ধ্যায় তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি করে সিটি করপোরেশন। কমিটিকে সাত কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। গত রোববার বিকেলে তদন্ত প্রতিবেদন ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়রের কাছে জমা দিয়েছে কমিটি। তদন্ত কমিটির কর্মপরিধির মধ্যে ছিল দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান করে দোষী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা যাতে না ঘটে, সে বিষয়ে সুপারিশ করা।

দক্ষিণ সিটির একাধিক কর্মকর্তা জানান, তদন্ত প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে পরিবহন শাখার মহাব্যবস্থাপক বিপুল চন্দ্র বিশ্বাস তদন্ত কমিটির কাছে ময়লাবাহী গাড়ির বিপরীতে চালকদের যে তালিকা দিয়েছেন, তাতে হারুনের নামে কোনো গাড়ি বরাদ্দ নেই। তবে গাড়ির বিপরীতে করপোরেশন থেকে তেলের টোকেন সংগ্রহ, পাম্প থেকে তেল সংগ্রহ থেকে শুরু করে সব স্থানেই হারুনের সই রয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে গাড়ি মেরামতের জন্য নির্ধারিত ফরমেও তিনি সই করেছেন।

ময়লাবাহী গাড়িচাপায় শিক্ষার্থী নাঈম নিহত হওয়ার পর ঘটনাস্থল থেকে আটক করা রাসেল ছিলেন হারুনের সহযোগী। তদন্ত কমিটি রাসেল সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারেনি। তবে রাসেলও করপোরেশনের নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মী নন।

তদন্ত প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, শিক্ষার্থীকে চাপা দেওয়া ময়লাবাহী গাড়িটির প্রকৃত চালক মো. ইরান মিয়া। তাঁর নামে এই গাড়ি বরাদ্দ থাকলেও তাঁকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি। ইরান মিয়াই জানেনই না এই গাড়ি তাঁর নামে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তবে কমিটির কাছে ইরান মিয়া বলেছেন, তাঁর নিয়ন্ত্রণে ১৪-০৭০৪ সিরিয়ালের ময়লাবাহী একটি গাড়িটি রয়েছে। তবে এই গাড়ি তিনি চালান না। তাঁর ছেলে রবিন মিয়া গাড়িটি চালান। রবিন সিটি করপোরেশনের নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মী নন।

দক্ষিণ সিটি সূত্র জানায়, পরিবহন বিভাগের মহাব্যবস্থাপক বিপুল চন্দ্র বিশ্বাস চলতি বছরের ২৮ এপ্রিল ৮৮টি ময়লাবাহী ভারী গাড়ি পরিচালনার দায়িত্ব বন্টন করেছেন। এই ৮৮টি গাড়ি বরাদ্দপ্রাপ্তদের মধ্যে ভারী গাড়ির চালক ছিলেন ২২ জন। মশককর্মী, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, ওষুধ সরবরাহকারী ও বহিরাগত ব্যক্তি ছিলেন ৪৪ জন। আর হালকা গাড়ির চালক ছিলেন ২২ জন। ময়লাবাহী গাড়ি বরাদ্দে পরিবহন বিভাগের মহাব্যবস্থাপকের দেওয়া আদেশের আইনি বৈধতা খুঁজে পায়নি তদন্ত কমিটি।

দক্ষিণ সিটির একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, পরিবহন বিভাগের মহাব্যবস্থাপক বিপুল চন্দ্র বিশ্বাস কোনোভাবেই বহিরাগত লোকদের নামে সরকারি গাড়ি বরাদ্দ দিতে পারেন না। এভাবে সরকারি গাড়ি বরাদ্দ দেওয়ার পেছনে রয়েছে আর্থিক লেনদেন। তদন্ত কমিটি বৈধ ও নিয়োগপ্রাপ্ত চালকদের দিয়ে ময়লাবাহী গাড়ি চালানোর সুপারিশ করেছে।

তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক সিতওয়াত নাঈম ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা। তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে গতকাল সোমবার রাতে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, রোববার তিনি প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। এর বাইরে কিছু বলতে রাজি হননি তিনি।

ঢাকা দক্ষিণ সিটির পরিবহন বিভাগে শৃঙ্খলা ফেরানোর লক্ষ্যে আজ মঙ্গলবার বিকেলে সভা আহ্বান করেছেন মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। এই সভায় করপোরেশনের পরিবহন শাখা, যান্ত্রিক বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকবেন। এই সভায় পরিবহন বিভাগের অনিয়ম-দুর্নীতি এবং তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন ও সুপারিশ নিয়ে আলোচনা হবে বলে জানিয়েছেন দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের একাধিক কর্মকর্তা।