দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভিত্তিতেই রাজনীতি করতে হবে: নিম চন্দ্র ভৌমিক

হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের ৩৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ও ৫১তম ঐতিহাসিক চুকনগর গণহত্যা দিবস উপলক্ষে পরিষদের ব্যানারে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মোমবাতি প্রজ্বালন ও সমাবেশের আয়োজন করা হয়
ছবি: প্রথম আলো

বাংলাদেশে রাজনীতি করতে হলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভিত্তিতেই করতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের অন্যতম সভাপতি নিম চন্দ্র ভৌমিক। আজ শুক্রবার সন্ধ্যায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আয়োজিত এক মোমবাতি প্রজ্বালন ও সমাবেশ কর্মসূচিতে সভাপতির বক্তব্যে নিম চন্দ্র ভৌমিক এসব কথা বলেন।

নিম চন্দ্র ভৌমিক বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পরিচালিত গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মেলেনি। এর জন্য ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর বাংলাদেশে আবার ‘পাকিস্তানি ধারা’ প্রতিষ্ঠাকে দায়ী করেছেন তিনি।

হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের ৩৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ও ৫১তম ঐতিহাসিক চুকনগর গণহত্যা দিবস উপলক্ষে পরিষদের ব্যানারে এই কর্মসূচির আয়োজন করা হয়। কর্মসূচিতে মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তির অবসান কামনা করে মোমবাতি প্রজ্বালন করা হয়। জ্বলন্ত মোমবাতি হাতেই মাইকে চলে সমাবেশের বক্তব্য।

বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের অন্যতম সভাপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক নিম চন্দ্র ভৌমিক বলেন, ‘অনেকে প্রশ্ন করেন, একাত্তরের গণহত্যা কেন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়নি। যদিও বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ইউনেসকোর রেকর্ডভুক্ত হয়েছে। কিন্তু একাত্তরের গণহত্যা এখনো স্বীকৃতি পায়নি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর আবার পাকিস্তানি ধারা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালানো হয় দেশে। পাকিস্তান ও চীনের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করা হয়, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী প্রচারণা চালানো হয় এবং সংবিধানকে বৈষম্যমূলক করা হয়।এসব কারণেই মূলত একাত্তরের গণহত্যা এখনো স্বীকৃতি পায়নি। হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টানের মিলিত রক্তস্রোতে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ চার মূলনীতির ভিত্তিতেই চলবে। এর বাইরে কোনো কিছুই এ দেশের জনগণ মেনে নেবে না। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অপশক্তির বিরুদ্ধে চলমান কর্মকাণ্ডকে আমরা সহযোগিতা করব।’

নিম চন্দ্র ভৌমিক আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে এমনও রাজনৈতিক দল এবং নেতা-নেত্রী রয়েছেন, যাঁরা মনে করেন যে ৩০ লাখ লোক মুক্তিযুদ্ধে হত্যাকাণ্ডের শিকার হননি। কিন্তু আমরা জানি যে ওই গণহত্যা বিশ্বব্যাপী নিন্দিত হয়েছিল। লাখ লাখ লোকের প্রাণ ও দুই লাখ নারীর নিপীড়নের শিকার হওয়ার বিনিময়ে, বিশ্ববাসীর সমর্থন এবং ভারতের সর্বাত্মক সমর্থনে আমরা বিজয় অর্জন করি। সেই প্রেক্ষাপটেই বাহাত্তরের সংবিধান হয়েছিল। যাঁরা বাংলাদেশে রাজনীতি করতে চান, গণতন্ত্রের কথা বলেন, কেউ কেউ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেও নিজেকে জাহির করেন; গণতন্ত্র যে জাতিরাষ্ট্রের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেই রাষ্ট্রের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের নীতিমালা, সংবিধানের চার মূলনীতি এবং ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সভ্যতাকে তাঁদের স্বীকার করতে হবে। যাঁরা এগুলো স্বীকার করেন না, তাঁদের বাংলাদেশে রাজনীতি করার কোনো অধিকার নেই। এই দেশে রাজনীতি করতে হলে বাহাত্তরের পরিপূর্ণ সংবিধানকে মেনে নিতে হবে। স্বাধীনতাবিরোধীদের বিচার অব্যাহত রাখতে হবে। মুক্তিযুদ্ধে আমাদের সহযোগিতা করা ভারতসহ গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক আরও জোরদার করতে হবে। জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।’

এ সময় চুকনগর গণহত্যা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল৷ ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। হাজার হাজার নিরস্ত্র জনতাকে হত্যা করা হয়৷ পরবর্তীকালে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় হত্যাকাণ্ড চালানো হয়৷ এর অন্যতম ২০ মে চুকনগর হত্যাকাণ্ড৷ মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী হিসেবে রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনী গঠিত হয়েছিল৷ তারা গ্রামগঞ্জে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সহযোগিতা করছিল৷ ওই সময় হাজার হাজার লোক বৃহত্তর খুলনার বিভিন্ন এলাকা থেকে ডুমুরিয়ার চুকনগরে গিয়ে আশ্রয় নেয়৷ ২০ মে সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত সেখানে হত্যাকাণ্ড চালানো হয়৷ কমপক্ষে ১০ হাজার লোককে সেদিন হত্যা করা হয়৷ সেখানে একটি স্মৃতিসৌধ করা হয়েছে৷ দেশের বিভিন্ন স্থানে যে হত্যাকাণ্ড হয়েছে, তাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নিয়েছে৷ কিন্তু এটাই পরিপূর্ণ নয়৷ অনেক হত্যাকাণ্ড হয়েছে, যার প্রতিবেদন এখনো প্রকাশিত হয়নি৷

আজকের বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ নয় বলে মন্তব্য করেন হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত৷ তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের শহীদেরা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য আত্মাহুতি দিয়েছিলেন৷ আমরা পরিষ্কার করে বলতে চাই, আজকের বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ নয়৷ ধর্মপরিচয়নির্বিশেষে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাঙালি হিসেবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ পুনঃপ্রতিষ্ঠার লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে৷ বাহাত্তরের সংবিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে আমরা এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই৷ এটি না করতে পারলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ বিপর্যয় অনিবার্য৷ এই বিপর্যয় দেখার জন্য আমরা মুক্তিযুদ্ধ করিনি৷’

রানা দাশগুপ্ত আরও বলেন, ‘১৯৭১ সালের ২০ মে খুলনার চুকনগরে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরেরা শরণার্থী হিসেবে ভারতে যাচ্ছিল, এমন মানুষদের ওপর গুলি চালিয়ে ১০-১২ হাজার নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করেছিল৷ পৃথিবীর গণহত্যার ইতিহাসে এক দিনে এত মানুষের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা আর কোথাও ঘটেছে বলে আমাদের জানা নেই৷’ তিনি জানান, আগামীকাল শনিবার সকাল ১০টায় রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির নসরুল হামিদ মিলনায়তনে ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ: প্রসঙ্গ চুকনগর গণহত্যা’ শিরোনামে একটি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে৷

সমাবেশে অন্যদের মধ্যে ঐক্য পরিষদের অন্যতম সভাপতি নির্মল রোজারিও, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজল দেবনাথ, সুব্রত চৌধুরী, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মণীন্দ্র কুমার নাথ প্রমুখ বক্তব্য দেন৷ সমাবেশে বক্তারা সদ্য প্রয়াত লেখক, কলামিস্ট ও বিশিষ্ট সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানান।