দোকানের অপেক্ষায় ২৬ বছর

এসব মার্কেটে দোকান বরাদ্দের নামে ৭৩ কোটি টাকা আদায় করা হয়েছে। একটি মার্কেটের নির্মাণকাজ চলছে ২৬ বছর ধরে।

নিউ ঢাকা সিটি করপোরেশন মার্কেট ভবনের কাঠামো নির্মাণ হলেও আনুষঙ্গিক কাজ এখনো শেষ হয়নি। সম্প্রতি মিরপুর ১১ নম্বর সেকশনে
ছবি: আশরাফুল আলম

মিরপুরের বাসিন্দা আবদুল জলিল নিউ ঢাকা সিটি করপোরেশন মার্কেটে দোকান পেতে টাকা জমা দেন নব্বইয়ের দশকের শুরুতে। ১৯৯৬ সালে মার্কেটের নির্মাণকাজ শুরু হয়। কিন্তু গত ২৬ বছরেও কাজ শেষ হয়নি। দোকান পাওয়ার আশায় দিন কাটানো আবদুল জলিল ২০১৩ সালে মারা যান। এখন দোকান পাওয়ার অপেক্ষায় আছে তাঁর পরিবার।

আবদুল জলিলের পরিবারের মতো কয়েক হাজার পরিবারের দোকান পাওয়ার অপেক্ষা শেষ হচ্ছে না। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) তিনটি মার্কেটের একটির নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল ২৬ বছর আগে, আরেকটির ২৫ বছর আর অন্যটির ১৮ বছর আগে। এখন পর্যন্ত কোনোটিরই নির্মাণকাজ শেষ হয়নি। অথচ দোকান বরাদ্দের নামে কয়েক হাজার ব্যক্তির কাছ থেকে প্রায় ৭৩ কোটি টাকা আদায় করা হয়েছে।

২০১১ সালে সিটি করপোরেশন বিভক্তির পর মার্কেট নির্মাণের দায়িত্ব পায় উত্তর সিটির প্রকৌশল বিভাগ আর দোকান বরাদ্দের সালামি আদায়ের দায়িত্ব পায় রাজস্ব বিভাগ। মার্কেট নির্মাণে দীর্ঘসূত্রতার জন্য এই দুই বিভাগ পরস্পরকে দোষারোপ করছে। এই মার্কেট তিনটির নির্মাণ নিয়ে সিটি করপোরেশনের দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেই। বছরের পর বছর একইভাবে পড়ে আছে।

সিটি করপোরেশনের নিজস্ব আয়ে মার্কেট নির্মাণ কষ্টসাধ্য। নিজস্ব অর্থায়নে নাকি তহবিল গঠন করা হবে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি।
আবদুল হামিদ, প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা, ডিএনসিসি

উত্তর সিটির প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা আবদুল হামিদ মিয়া বলেন, ব্যবসায়ীরা অনেক দিন ধরে টাকা দিয়ে রেখেছেন। মার্কেট নির্মাণের বিষয়ে একাধিকবার প্রকৌশল বিভাগকে বলা হয়েছে। কিন্তু সিটি করপোরেশনের নিজস্ব আয়ে মার্কেট নির্মাণ কষ্টসাধ্য। নিজস্ব অর্থায়নে নাকি তহবিল গঠন করা হবে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে মিরপুরের শাহ আলী মার্কেটের নির্মাণকাজ শুরু করা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।

সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা যায়, মিরপুর ১১ নম্বর সেকশনে নিউ ঢাকা সিটি করপোরেশন মার্কেটের নির্মাণকাজ শুরু হয় ১৯৯৬ সালে। নকশা অনুযায়ী ছয় বিঘা জমির ওপরে ছয়তলা মার্কেট ভবন নির্মাণের কথা। জায়গাটির সামনের দিকের একটি অংশে আছে আটকে পড়া পাকিস্তানিদের কিছু পরিবার। তাই নকশার এ অংশ বাদ রেখে এবং কোনো রকম সীমানাপ্রাচীর না তুলে মার্কেটের নির্মাণকাজ শুরু করা হয়।

পাঁচতলা ভবনের কাঠামো নির্মাণের পর চারপাশের দেয়াল ও আনুষঙ্গিক কাজ বাদ রেখে ২০০৭ সালে নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেয় সিটি করপোরেশন। ঠিকাদারেরা অতিরিক্ত অর্থ দাবি করায় তখন কাজ বন্ধ হয়ে যায় বলে সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা যায়। এরপর প্রায় ১৫ বছর ধরে মার্কেটটি পরিত্যক্ত অবস্থায় ফেলে রাখা হয়েছে।

১০ মে সরেজমিনে দেখা যায়, মার্কেটটির একাংশ দখল করে কমিউনিটি বিট পুলিশের কার্যালয় এবং পশ্চিমে আওয়ামী লীগের ঢাকা মহানগর উত্তর ৩ নম্বর ওয়ার্ডের ১৩ নম্বর ইউনিটের প্রধান কার্যালয় নির্মাণ করা হয়েছে।

একটি মার্কেটের নির্মাণকাজ দু-তিন বছরেই শেষ করা যায়। সেখানে দুই যুগ পড়ে থাকাটা হতাশাজনক।
আদিল মুহাম্মদ খান, নির্বাহী পরিচালক, আইপিডি

এই মার্কেটে ২ হাজার ৩৬৩টি দোকান আছে। এগুলো বরাদ্দের জন্য সিটি করপোরেশন প্রায় ১৪ কোটি টাকা সালামি সংগ্রহ করে তিনটি সমিতির মাধ্যমে। এর একটি নিউ সোসাইটি মার্কেট ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের কোষাধ্যক্ষ ইমতিয়াজ আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা টাকা জমা দিয়ে ফেঁসে গেছি। যারা টাকা দিয়েছেন, তাঁদের অনেকেই মারা গেছেন। সিটি করপোরেশনের কোনো মাথাব্যথা নেই। যে যার মতো দখল করেছে। মার্কেটের ভেতরে গত বছরে এক ব্যক্তি খুনও হয়েছেন।’

মিরপুর ১ নম্বরের হজরত শাহ আলী (রহ.) মার্কেটের নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০০৪ সালে। এখানে ৩ হাজার ৪৩৫টি দোকান হওয়ার কথা। দোকান বরাদ্দ বাবদ সিটি করপোরেশন প্রায় ৫৯ কোটি টাকা আদায় করেছে।

ডিএনসিসি সূত্রে জানা যায়, ১০ তলা মার্কেট ভবন নির্মাণের কথা ছিল। চারতলা পর্যন্ত নির্মিত হয় ২০১৬ সালে। আংশিক নির্মিত এই অংশে দোকান আছে ২৯৬টি। কিছুসংখ্যক দোকান চালুও হয়েছে। বাকি দোকান কবে নির্মিত হবে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু বলতে পারেননি সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা।

সিটি করপোরেশন শাহ আলী মার্কেটে দোকান বরাদ্দে একটি কমিটি করে। কমিটি যাচাই-বাছাই করে ১৭টি সমিতির সদস্যদের মধ্যে দোকান বরাদ্দের সুপারিশ করে। কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী মিরপুর ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সদস্যরা ৭০০টি দোকান পাবেন। সমিতির সাধারণ সম্পাদক আতিকুর রহমান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, সিটি করপোরেশন মার্কেট নির্মাণ নিয়ে একেবারে উদাসীন।

তৃতীয় মার্কেটটির নির্মাণকাজ শুরু হয় ১৯৯৭ সালে। মিরপুরের বাউনিয়া বাঁধ এলাকায় টিনশেড মার্কেটে বিভিন্ন আকারের ৩৭৪টি দোকান হওয়ার কথা। কিন্তু সিটি করপোরেশন মার্কেটের জায়গায় অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ করতে না পারায় নির্মাণকাজ বন্ধ হয়ে যায়।

পরে উত্তর সিটি ২০১১ সালে এই জায়গায় একটি বহুতল মার্কেট নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়। তবে সেই সিদ্ধান্তও বাস্তবায়িত হয়নি। সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, মার্কেটটির নির্মাণ শুরুর সময় সীমানাদেয়াল না দেওয়ায় অবৈধ দখলকারীরা অস্থায়ী দোকান নির্মাণ করে ব্যবসা শুরু করেন। মার্কেটটি এখনো সে অবস্থাতেই পড়ে আছে।

সিটি করপোরেশনের এমন কর্মকাণ্ডে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের প্রতি জনগণের আস্থাহীনতা তৈরি হচ্ছে বলে মনে করেন ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক আদিল মুহাম্মদ খান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, একটি মার্কেটের নির্মাণকাজ দু-তিন বছরেই শেষ করা যায়। সেখানে দুই যুগ পড়ে থাকাটা হতাশাজনক। যাদের দায়িত্বহীনতা ও অবহেলায় এমন পরিস্থিতি, তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা জরুরি।