ধ্বংসস্তূপে বসে বই বিলাচ্ছেন পুঁজি হারানো বিক্রেতারা

মো. জহির সকাল থেকে পুড়ে যাওয়া বইয়ের ধ্বংসস্তূপের ওপর বসে বই বিলানছবি: শেখ সাবিহা আলম

নীলক্ষেত বইবাজারের আগুনে নিউ বুক গার্ডেন একরকম ছাই হয়ে গেছে। মঙ্গলবার মধ্যরাত পর্যন্ত তাই দাঁড়িয়ে থেকে দেখেছেন দোকানের মালিক মো. জহির। আজ বুধবার তাঁকে দেখা গেল সেই ধ্বংসস্তূপের ওপর বসে বই বিলাতে।

দুপুর ১২টার দিকে জহির হাঁকছিলেন, ‘এই যে এই দিকে ম্যানেজমেন্ট ফার্স্ট ইয়ার, ফার্স্ট ইয়ার।’ চোখে চোখ পড়তে বললেন, অনেক বইয়ের চারপাশটা পুড়ে গেছে, কোনোটা ভিজে গেছে। একটু রোদে শুকিয়ে নিলে ব্যবহার করা যাবে। তাই বিনা মূল্যে দিয়ে দিচ্ছেন।

সোমবার রাতে ২০ লাখ টাকার বই তুললাম। আমরা ছোট পুঁজির দোকানদার। এই বাজারে এমন দোকানদার আছে যাদের বই বিক্রি হলে বাজার হয়, না হলে হয় না
মো. সাব্বির, আলম বুক সেন্টারের মালিক

জহিরসহ আরও বেশ কিছু বই বিক্রেতাকে ঘিরে ধরেছিলেন ছাত্রছাত্রীরা। এঁদের একজন দীপ বক্সি। পাবনার এডওয়ার্ড কলেজ থেকে স্নাতক পাস করেছেন। বোনকে ইডেন কলেজে ঢুকিয়ে নীলক্ষেতে এসেছেন দীপ। বেশ বড় একটা গাঁট্টি দেখিয়ে তিনি বললেন, কিছু বই নীলক্ষেত থেকে কিনেছেন, বিনা মূল্যের কিছু বই ছোট ভাইবোনদের জন্য নিয়েছেন।

গতকাল নীলক্ষেতের বইবাজারের দোতলার একটি বইয়ের দোকান থেকে সন্ধ্যা ৭টা ৪৩ মিনিটে আগুনের সূত্রপাত হয়। মুহূর্তেই তা ছড়িয়ে পড়ে আরও বেশ কিছু দোকানে। ১০টি ইউনিটের চেষ্টায় ৮টা ৫০ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক লে. কর্নেল জিল্লুর রহমান বলেন, ৩৫-৪০টি দোকান পুড়েছে।

দোকানপাট থেকে পুড়ে যাওয়া বই সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে
ছবি: প্রথম আলো

রাতে গোটা এলাকা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন ছিল, ধোঁয়ার কুণ্ডলী আশপাশের এলাকাকেও ছেয়ে ফেলে। বইয়ের বাজারের ভেতরের ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে ধারণা করা যায়নি। আজ বইবাজারে আগুন না থাকলেও ছিল ধোঁয়ার গন্ধ। বিক্রেতারা পুড়ে যাওয়া ও পানিতে ভিজে যাওয়া বই এক জায়গায় জড়ো করে দোকানপাট পরিষ্কারের কাজ করছিলেন। এ কাজে কত দিন লাগবে বুঝতে পারছেন না। আলম বুক সেন্টারের মালিক মো. সাব্বির আগুন থেকে শ খানেক বই বাঁচাতে পেরেছেন। বাকি সব নষ্ট হয়ে গেছে।

সাব্বির প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়ার ঘোষণা দিল। আর আমি সোমবার রাতে ২০ লাখ টাকার বই তুললাম। আমরা ছোট পুঁজির দোকানদার। এই বাজারে এমন দোকানদার আছে যাদের বই বিক্রি হলে বাজার হয়, না হলে হয় না।’ ক্ষতিপূরণ বা কোনো সাহায্য চান কি না জানতে চাইলে বলেন, তাঁরা জানেন না কোথায় সাহায্য চাইতে হয়। তাঁর যতটা ক্ষতি হয়েছে, ততটা পূরণ হবে কি না, তা নিয়েও সংশয় আছে।

সাদ্দাম হোসেন নামের আরেক ব্যবসায়ী বলেন, করোনার পর তিনি অনেক টাকা ঋণ নিয়ে দোকানটা গুছিয়ে ছিলেন। নিজে খাবেন কী, ঋণ শোধ করবেন কী করে, বুঝে উঠতে পারছেন না।

হযরত শাহজালাল মার্কেট উন্নয়ন কমিটির যুগ্ম সম্পাদক ও জেনুইন বুক সেন্টারের কর্ণধার গিয়াস উদ্দীন সকাল থেকেই বইয়ের বাজারে। তাঁর নিজের দোকানও পুড়ে গেছে। তিনিও প্রথম আলোকে বলেন, নিজেরাই নিজেদের মতো করে সকালে বেশি ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য খাবারদাবারের ব্যবস্থা করেছেন। এখন পর্যন্ত তাঁদের হিসাবে হযরত শাহজালাল মার্কেটের ২৭টি, সিটি করপোরেশনের ৩টি, বাবুপুরা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমিতির ১০টি ও ইসলামিয়া মার্কেটের ১৫টি দোকান পুড়েছে। ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১০ কোটি টাকা।

আংশিক পুড়ে যাওয়া বই।
ছবি: প্রথম আলো

কেউ কেউ অভিযোগ করছেন, নীলক্ষেতের এই বাজার দখলে নিতে কারও প্ররোচনা থাকতে পারে। জবাবে গিয়াসউদ্দিন বলেন, চৌধুরী ফ্রেন্ডস বুক কর্নার থেকে আগুন লেগেছে অসতর্কতার কারণে। তা ছাড়া তাঁরা নিজেরাই এখানে বহুতল বাজার করতে চান। রাজউক গত বছর তাদের পরিকল্পনাও পাস করেছে। করোনার কারণে এগোনো যায়নি।

ক্ষতিগ্রস্ত অংশটুকু ঘিরে রেখে আজ বাজারের অন্যান্য অংশে বইয়ের দোকান, ফটোকপি বা তেহারির দোকানে কেনাবেচা চলছিল। হাজির ছিলেন বইয়ের বাজার পরিচালনাকারী ব্যক্তিরাও।

এদিকে নীলক্ষেতের বইয়ের বাজারের আগুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের বেদনাতুর করেছে। তাঁদের অনেকেই দুর্ঘটনাস্থলের ছবি শেয়ার করেছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্টও দিয়েছেন।

কিংকর্তব্যবিমূঢ় নামের একটি পেজ থেকে একজন লিখেছেন, ‘সারা দিনে সবচেয়ে কষ্টের ছবি এটি, এর থেকে কষ্ট আর কিছু নেই।’ একজন আগুন লাগা বইয়ের বাজারের ছবিতে লিখেছেন, ‘ঈশ্বর দয়া করুন, আমার তীর্থস্থানে বৃষ্টি আনুন।’