নারীবান্ধব নয় পদচারী-সেতু
ইফফাত নওরীন অফিস শেষে সন্ধ্যায় বনানী ১১ নম্বর পদচারী-সেতু দিয়ে রাস্তা পার হচ্ছিলেন। হঠাৎ টের পেলেন কেউ তাঁর ঘাড়ে ফুঁ দিচ্ছে। ঘুরে দাঁড়িয়ে পেছনের লোকটিকে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, কিছু করেননি। ইফফাত এখন কদাচিৎ পদচারী-সেতুতে ওঠেন।
রাজধানীতে দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশনের মোট ৯১টি পদচারী-সেতু আছে। পথচলতি নারীরা এগুলোতে নানা হয়রানির শিকার হন। বেশ কয়েকজন বলেছেন, খুব প্রয়োজন না হলে তাঁরা পদচারী-সেতুতে ওঠেন না। সন্ধ্যার পরে বেশি ভয় পান। রাতে তাঁরা রাস্তা দিয়ে পারাপার হন।
পদচারী-সেতুর জন্য পুলিশের বা করপোরেশনের আলাদা কোনো নিরাপত্তাব্যবস্থা নেই। অনেকগুলোতে বাতি নেই। হকার, ভিক্ষুক ও মাদকসেবীদের আড্ডাখানা। নারীদের উত্ত্যক্ত করা হয়। ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। গত ৪ অক্টোবর রাতে শাহবাগের একটি পদচারী-সেতুতে দুজন মাদকসেবী খুনও হয়েছেন।
গত আগস্টে স্কুলের সামনের পদচারী-সেতুতে উত্ত্যক্তকারীর ছুরিতে আহত হয়ে উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের ছাত্রী সুরাইয়া আক্তার রিসা মারা যায়। এরপর স্কুল কর্তৃপক্ষ নিজ উদ্যোগে ওই সেতুতে দুজন নিরাপত্তাকর্মী বসিয়েছে। অন্য সেতুগুলোর ক্ষেত্রে সড়কের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা টহল পুলিশই ভরসা।
ধানমন্ডি থানাধীন মিরপুর সড়কজুড়ে ১২ ঘণ্টার পালায় ১৫ জন টহল দেন। তাঁদের একজন খায়রুল বাশার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভিআইপি মুভমেন্ট হলে ওভারব্রিজে ওঠা হয়। এ ছাড়া তেমন উঠি না।’ তিনি বলেন, টহলের মধ্যে যতটুকু দেখা যায়, ততটুকুই যা দেখেন।
গত মাসের ২৪, ২৫ ও ২৬ তারিখে রাজধানীর নিউমার্কেট, সাইন্স ল্যাব, ধানমন্ডি ৮/এ (পুরোনো ১৫), শুক্রাবাদ, আসাদগেট, মিরপুর বাংলা কলেজ, মিরপুর ১০, বনানী ১১ নম্বর, ফার্মগেট, পরীবাগ ও শাহবাগের নতুন পদচারী-সেতু ঘুরে ১৫ জন নারীর সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা চলতি পথে কমবেশি পদচারী-সেতু ব্যবহার করেন।
ধানমন্ডি ৮/এ (পুরোনো ১৫) সড়কের পদচারী-সেতুটি নানান ব্যানারে আচ্ছন্ন। ওপরে কী হচ্ছে, তা নিচ থেকে বোঝার উপায় নেই। এই সেতুতে বাতি নেই। মলমূত্রে সয়লাব। নাকে কাপড় দিয়ে হাঁটতে হয়। রাতের বেলা কেউ ওপরে ওঠে না।
পাপিয়া জামান কাছের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর পর্বে পড়ছেন। ক্লাস শেষ হয় রাত নয়টায়। পাপিয়া বলেন, ‘বেশির ভাগ সময় রাস্তা দিয়েই পার হই। ওখানে (পদচারী-সেতু) সব সময়ই কিছু বাচ্চা থাকে। সিঁড়িতে বসে সিগারেট খায়। একবার উঠেছিলাম। বাচ্চাগুলো পেছন থেকে জাপটে ধরে টাকা চায়। না দিলে বিড়ম্বনা তৈরি করে।’
মিরপুর ১০ ও ফার্মগেট পদচারী-সেতু দুটি সদা ব্যস্ত। হকার ও ভিক্ষুকে সরগরম। কিছুদিন আগে সন্ধ্যায় ফার্মগেটের সেতুতে উঠলে লোকজন বলেন, এখনে বাতি জ্বলে না। এ দুই জায়গায় অন্তত পাঁচজন নারী বলেন, দিন কিংবা রাত, ভিড় একটু বেশি হলে মানুষ গায়ে হাত দেয়। রাতে তাঁরা কেউ একা সেতুতে ওঠেন না।
শুক্রাবাদ, আসাদগেট, শ্যামলী ও মিরপুর বাংলা কলেজের সামনের সেতুতেও বাতি নেই। আসাদগেট, শুক্রাবাদ আর মিরপুর বাংলা কলেজ-সংলগ্ন সেতু তিনটির ব্যবহার কম। সেতুগুলোর আশপাশ দিয়ে চলাচলকারী কয়েকজন নারী বলেন, রাতে মাদকসেবীদের চলাচল বেড়ে যায়।
শ্যামলীর পদচারী-সেতুতে ভিক্ষুক ও হকারের ভিড়। ভেতরের পরিবেশও নোংরা। এক বিকেলে আত্মীয়ের বাসা থেকে ফেরার সময় শ্যামলীর পদচারী-সেতুতে উঠেছিলেন রাইসা আহমেদ। তিনি বলেন, ‘কে যেন ব্যাগ ধরে টান দেয়। জোরে হাঁটা শুরু করি। এরপর কান ধরেছি ওভারব্রিজে আর উঠব না।’
পরীবাগ ও শাহবাগ নতুন পদচারী-সেতুতে রাত হলেই মাদকসেবীদের আনাগোনা বাড়তে দেখা যায়। এ পথের নিত্যযাত্রী একজন কর্মজীবী নারী বলেন, পরীবাগের সেতুতে তিনি দিনের বেলায়ও হয়রানির শিকার হয়েছেন। একটু ফাঁকা পেলেই সেতুর ওপর শুয়ে থাকা লোকজন ব্যাগ, কাপড় ধরে টান দেয়।
কয়েক দিন আগে শাহবাগের সেতুটিতে গিয়ে দেখা যায়, একজন মাদক সেবন করছেন। প্রায় ৩০ মিনিট দাঁড়িয়ে থেকে দেখা যায় ছয়জন সেতু ব্যবহার করেছেন। তাঁদের মধ্যে একজন হুমায়রা রহমান। হুমায়রা ডাক্তারি পড়ছেন। সেতুতে উঠেছেন একজন পুরুষ বন্ধুর সঙ্গে।
হুমায়রা বলেন, ‘একা উঠতে তো ভয় লাগে। ওরা হাত-পা ছড়ায়ে শুয়ে থাকে।’ হুমায়রার বন্ধু সায়েম খান বলেন, ছেলেরাও সাবধানে পার হয়। ছিনতাই হওয়ার ভয় থাকে।
নিউমার্কেটের দুটি সেতু পুরোপুরি হকারদের দখলে। সেতু দুটি দিয়ে বাজারের ক্রেতা-বিক্রেতাদের পাশাপাশি পোশাকশ্রমিকেরা নিয়মিত যাতায়াত করেন। নাসিমা বেগম এলিফ্যান্ট রোডের একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন। কাজ শেষে ফিরতে ফিরতে রাত হয়। তাঁরা দল বেঁধে যাওয়া-আসা করেন। নাসিমা বলেন, ‘হুদাই কিছু পোলাপান দাঁড়ায় থাকে। খারাপ খারাপ কথা কয়।’
রাজধানীর সেতুগুলোর এতিম দশা নিয়ে দুই সিটি করপোরেশনে যোগাযোগ করা হয়। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী মো. নুরুল্লাহ (বদলি হওয়া) বলেন, তাঁদের দরপত্র হয়ে গেছে। এক-দু মাসের মধ্যেই বাতি লাগানো, উচ্ছেদসহ অন্যান্য কাজ শুরু হবে। উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ আনোয়ারুল ইসলামও একই কথা বলেন। তিনি আরও বললেন, নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কাজটি সিটি করপোরেশনের নয়, এটা পুলিশের কাজ।
কিন্তু পুলিশের গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মাসুদুর রহমান বলেন, পদচারী-সেতুর পাহারা দিতে আলাদা করে পুলিশ মোতায়েন হয় না। তিনি বলেন, ‘এরিয়াভিত্তিক টহল পুলিশ থাকে। পুলিশের ডিমান্ড অনেক জায়গায় থাকে, কিন্তু সমন্বয় করে কাজ করতে হয়।’ তিনি আরও বলেন, পদচারী-সেতুর বিষয়ে অভিযোগ পান না। পেলে তাঁরা ব্যবস্থা নেবেন।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক সারওয়ার জাহান বলেন, রাজধানীতে পদচারী-সেতুর চেয়ে জেব্রা ক্রসিং বাড়ানো দরকার। পদচারী-সেতুর ব্যবহার কম, নিরাপত্তার ঝুঁকি থেকেই যায়। এসব ব্যাপারে দায়িত্বশীলদের অবশই নজর দেওয়া উচিত।
প্রথম আলো যেসব নারীর সঙ্গে কথা বলেছে, তাঁরা পুলিশের কাছে কখনো অভিযোগ করেননি। পুলিশের কাছে যাওয়াটা ঝামেলা বলে মনে করেছেন। তবে তাঁরা বলেছেন, পুলিশ পদচারী-সেতুতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করলে পথ চলতে সুবিধা হতো। শিক্ষার্থী ও কর্মজীবী পাপিয়া জামানের কথা, ‘নিরাপত্তা থাকলে রাতেও সেতুতে উঠতে ভয় লাগত না।’