ফ্ল্যাট দেখে খুশি, আপত্তি ভাড়ায়

মিরপুরের বাউনিয়া বাঁধ এলাকায় বস্তিবাসীর জন্য পাঁচটি বহুতল ভবন হচ্ছে। ইতিমধ্যে তিনটি ভবনে ভাড়ায় ৩০০টি ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

বস্তিবাসীদের জন্য নির্মাণ করা ভবন। ৩ আগস্ট রাজধানীর বাউনিয়া বাঁধ এলাকায়।
প্রথম আলো

বস্তির এক কক্ষের ঘর ছেড়ে নতুন বহুতল ভবনের ফ্ল্যাটে ওঠার বরাদ্দপত্র গত সপ্তাহেই হাতে পেয়েছেন মিরপুরের দোকান কর্মচারী কামাল হোসাইন। ফ্ল্যাট দেখে তিনি খুশি। তবে যে ভাড়া ঠিক করা হয়েছে, তা নিয়েই আপত্তি তাঁর।

বস্তিবাসীদের জন্য রাজধানীর মিরপুরের বাউনিয়া বাঁধের স্লুইসগেট গেট এলাকায় ১৪তলা মোট পাঁচটি ভবন নির্মাণ করছে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে তিনটি ভবনের নির্মাণকাজ ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। এই তিনটি ভবন ফ্ল্যাট রয়েছে ৩০০টি। এসব ফ্ল্যাট বিভিন্ন বস্তিতে

থাকা ৩০০ জনকে ভাড়ায় বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি ফ্ল্যাটের আয়তন ৫১০ বর্গফুট (কমন স্পেসসহ ৬৭৩ বর্গফুট)। প্রতি ফ্ল্যাটে শোবার ঘর দুটি। এ ছাড়া বসার ও খাবার ঘর, বারান্দা, শৌচাগার ও স্নানাগার রয়েছে।

প্রতিটি ফ্ল্যাটের জন্য সরকার ভাড়া নেবে মাসে সাড়ে চার হাজার টাকা। তবে এই ভাড়ার সঙ্গে যোগ হবে গ্যাস, বিদ্যুৎসহ অন্যান্য সেবার খরচও (ইউটিলিটি বিল)। তাতে আরও প্রায় তিন হাজার টাকা ব্যয় করতে হবে। সব মিলিয়ে বস্তির একজন বাসিন্দাকে ফ্ল্যাটে থাকার জন্য মাসে প্রায় সাড়ে সাত হাজার টাকা খরচ করতে হবে।

ভাড়ার সঙ্গে অন্যান্য খরচ যোগ করা নিয়েই মূল আপত্তি ফ্ল্যাট বরাদ্দ পাওয়া বস্তির মানুষদের। বরাদ্দ পাওয়া ১৪ জনের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁরা বলেছেন, সরকারি কর্মকর্তারা

প্রথমে বলেছিলেন তাঁদের পুনর্বাসন করা হবে। যে কারণে তাঁরা ভেবেছিলেন ফ্ল্যাট স্থায়ীভাবে বরাদ্দ পাবেন। পরে জেনেছেন, এসব ফ্ল্যাটে ভাড়ায় থাকতে হবে তাঁদের। আর এখন তাঁদের বলা হচ্ছে, ভাড়ার সঙ্গে বিভিন্ন সেবার খরচও বহন করতে

হবে। মাসে মাসে এত টাকা জোগাড় করা তাঁদের জন্য কঠিন।

বস্তিবাসীদের জন্য যে জায়গায় পাঁচটি ভবন হয়েছে, সেখানেও আগে বস্তি ছিল। ২০১৮ সালের জুন মাসে এসব ভবনের নির্মাণকাজ শুরু হয়। গত ডিসেম্বরে নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। করোনার কারণে প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় দুটিই বেড়েছে। প্রথমে ব্যয় ধরা হয় প্রায় ১০০ কোটি টাকা। পরে ব্যয় বেড়ে হয় ১৩১ কোটি টাকা। মেয়াদ বাড়ানো হয় এ বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত। পাচটি ভবনে মোট ফ্ল্যাট হবে ৫৩৩টি। এর মধ্যে ৬৫টি ফ্ল্যাট ৭২০ বর্গফুটের (কমন স্পেসসহ)।

প্রথম তিনটি ভবনের নির্মাণকাজ শেষের পর ফ্ল্যাটের বরাদ্দ দিয়েছে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ। ভবন নির্মাণের জন্য বস্তির যেসব বাসিন্দা উচ্ছেদ হয়েছেন, তাঁরা ফ্ল্যাট বরাদ্দের তালিকায় অগ্রাধিকার পেয়েছেন। এ ছাড়া মিরপুরের বিভিন্ন বস্তির বাসিন্দারাও এই তালিকায় রয়েছেন। তালিকা তৈরির কাজে গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ স্থানীয় জনপ্রতিনিধির সহায়তা নিয়েছে।

বস্তিবাসীর জন্য ভাড়াভিত্তিক ফ্ল্যাট প্রকল্পের উদ্বোধন ও হস্তান্তর করা হয় ৩ আগস্ট। ওই দিনই ৩০০ বস্তিবাসীর হাতে ফ্ল্যাটের সাময়িক ‘ভাড়াপত্র’ তুলে দেওয়া হয়। জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ সূত্র বলছে, বস্তিবাসীর জন্য পাঁচটি ভবন নির্মাণে প্রায় ১৩১ কোটি টাকা খরচ হচ্ছে।

জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান দেলওয়ার হায়দার প্রথম আলোকে বলেন, বস্তি এলাকায় বেশির ভাগ ব্যক্তিই ভাড়া নিয়ে থাকেন। ওই ভাড়ার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই নতুন ভবনের ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে। সর্বোচ্চ মহলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভাড়াভিত্তিক ফ্ল্যাট বরাদ্দের জন্য এসব ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। স্থায়ী বরাদ্দ দেওয়া হলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অনেকেই ঢাকায় চলে আসবেন। তাই স্থায়ী বরাদ্দ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়নি।

দেলওয়ার হায়দার বলেন, যেহেতু ভাড়ায় বরাদ্দ দেওয়ার পরিকল্পনা থেকেই এসব ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে, তাই সাময়িক ভাড়াপত্র পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে কেউ যদি থাকতে না চান, তাহলে বস্তির অন্য বাসিন্দাদের কাছে এসব ফ্ল্যাট ভাড়া দেওয়া হবে।

বাউনিয়া বাঁধের স্লুইসগেট এলাকার যে অংশে বহুতল ভবনগুলো হচ্ছে, ঠিক তার উল্টো পাশেই কলাবাগান বস্তি। এই বস্তির এক কক্ষের ঘরে স্ত্রী–সন্তান নিয়ে থাকেন দোকান কর্মচারী কামাল। তাঁর জন্মও এই বস্তিতে। তিনি বলেন, দোকানে কাজ করে যে টাকা আয় হয়, তা দিয়ে কোনোমতে সংসার চলছে। ফ্ল্যাট ভাড়ার বরাদ্দ পেলেও এত টাকা দিয়ে সেখানে ওঠার সামর্থ্য নেই তাঁর। তিনি বলেন, কলাবাগান বস্তির অনেকে বরাদ্দ পেলেও এখন আর ফ্ল্যাটে উঠতে চাচ্ছেন না।

কলাবাগান বস্তিতে প্রায় সাড়ে তিন শ পরিবার থাকে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ সরকারি জমি নিজের দখলে নিয়ে টিনের ঘর বা একতলা ভবন তৈরি করে বহু বছর ধরে থাকছেন। আবার অনেকে এসব ঘর (একটি কক্ষ) দুই থেকে আড়াই হাজার টাকায় ভাড়া নিয়ে বসবাস করছেন।

জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ ঢাকা অঞ্চল-১–এর নির্বাহী প্রকৌশলী জোয়ারদার তাবেদুন নবী প্রথম আলোকে বলেন, ফ্ল্যাটের সাময়িক ভাড়াপত্র যাঁরা পেয়েছেন, এখন তাঁদের ৩০০ টাকার নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে চুক্তিপত্র করতে হবে। এরপরই তাঁদের কাছে ফ্ল্যাট হস্তান্তর করা হবে। এ ছাড়া ফ্ল্যাটে ওঠার আগে দুই মাসের আগাম ভাড়া দিতে হবে। ভবনের শৃঙ্খলা রক্ষায় ভাড়া বরাদ্দ পাওয়া ব্যক্তিদের অবশ্যই কিছু নিয়ম ও শর্ত মেনে সেখানে বসবাস করতে হবে। এসব শর্ত না মানলে তাঁদের বরাদ্দ বাতিল হবে। তিনি বলেন, যাঁরা ভাড়ায় ফ্ল্যাট বরাদ্দ পেয়েছেন, চুক্তিপত্র করা সাপেক্ষে অল্প সময়ের মধ্যে তাঁদের ওঠানো হবে।

গত শুক্রবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মিরপুরের বাউনিয়া বাঁধের স্লুইসগেট এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, পাশাপাশি পাঁচটি ১৪ তলা ভবন। এর মধ্যে তিনটি ভবনের কাজ প্রায় শেষ। এখন ভেতরে টাইলস বসানো ও দেয়ালে রং করার কাজ চলছে। এ ছাড়া লিফট বসানোর কাজও বাকি আছে। আর দুটি ভবনের মূল অবকাঠামো নির্মাণের কাজ পুরো শেষ হয়েছে। প্রকল্প এলাকায় কথা হয় পাশের কলাবাগান বস্তির বাসিন্দা মো. কাসেমের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কলাবাগান বস্তির জায়গাতেও এ রকম বহুতল ভবন তৈরি করা হবে বলে তাঁরা শুনেছেন।

প্রথম দফায় ফ্ল্যাট বরাদ্দ পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে কাসেমও রয়েছেন। তিনি বলেন, ভাড়ায় বস্তিবাসীদের ফ্ল্যাট না দিয়ে একটি মূল্য নির্ধারণ করে কিস্তিতে স্থায়ী বরাদ্দ দিলে অনেকেই আগ্রহী হবেন। তখন কষ্ট করে হলেও কিস্তির টাকা শোধ করা যাবে।

ফ্ল্যাট বরাদ্দ পাওয়া কলাবাগান বস্তির অন্তত ছয়জন বাসিন্দা বলেছেন, তাঁরা ভাড়া গুনবেন। এরপর তাঁদের সন্তানেরাও ভাড়া দেবেন। এভাবে তাঁরা থাকতে চান না। কিস্তির মাধ্যমে টাকা নিয়ে তাঁদের স্থায়ী বরাদ্দ দেওয়ার দাবি জানান তাঁরা।

বস্তিবাসীকে ভাড়ায় ফ্ল্যাট দেওয়ার উদ্যোগ ইতিবাচকভাবেই দেখছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মাসে অন্তত ২০ হাজার টাকা আয় না হলে ওই ভাড়ায় ফ্ল্যাটে থাকা সম্ভব হবে না। ভাড়ায় ফ্ল্যাট বরাদ্দের বিষয়টি হয়তো তাদের কাছে সঠিকভাবে উপস্থাপন করা হয়নি। বস্তিবাসী কেন ফ্ল্যাটে উঠতে চাচ্ছেন না তা নীতিনির্ধারকদের খুঁজে দেখা দরকার।