বাণিজ্যিক প্লটে নার্সারির ব্যবসা

বাণিজ্যিক প্লট দখল করে প্রায় ১৩০টি নার্সারি গড়ে উঠেছে। রাজনৈতিক নেতা ও রাজউকের কর্মীদের নামে চাঁদা তোলা হয়।

রাজউক উত্তরা তৃতীয় পর্বের শতাধিক বাণিজ্যিক প্লট দখল করে চলছে নার্সারির ব্যবসা
ছবি: খালেদ সরকার

রাজধানীর উত্তরায় রাজউকের (রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ) শতাধিক বাণিজ্যিক প্লট দখল করে চলছে নার্সারির ব্যবসা। অবৈধ ওই ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা-কর্মী।

অভিযোগ আছে, নার্সারিগুলো থেকে প্রতি মাসে প্রায় ছয় লাখ টাকা চাঁদা তুলে তা ভাগাভাগি করে নেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা। মাসে সোয়া এক লাখ টাকার বেশি ভাড়া তোলা হয় রাজউকের কর্মীদের নামে। বাস্তুহারা লীগের নেতা পরিচয়ে এক ব্যক্তি অবৈধভাবে বিদ্যুৎ–সংযোগ দিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছেন প্রায় ৬০ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে মাসে চাঁদা ওঠে পৌনে আট লাখ।

সরেজমিনে দেখা যায়, রাজউকের উত্তরা তৃতীয় পর্ব প্রকল্প এলাকায় বাণিজ্যিক প্লটে ছোট-বড় প্রায় ১৩০টি নার্সারি গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে অর্ধশতাধিক নার্সারিতে গভীর নলকূপ বা সাব-মার্সিবল পাম্প স্থাপন করা হয়েছে। গভীর নলকূপের জন্য ও রাতে বাতি জালাতে অবৈধ সংযোগ দিয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে। এ ছাড়া কিছু নার্সারিতে অস্থায়ী টিনের ঘর কিংবা চারার যত্নে নির্মাণ করা হয়েছে ছাউনি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ১৩ জন নার্সারি মালিকের সঙ্গে কথা হয় প্রতিবেদকের। মালিকেরা বলছেন, রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের ‘ম্যানেজ’ করার নামে আকারভেদে প্রতিটি নার্সারি থেকে দৈনিক ১০০ থেকে ২০০ টাকা নেওয়া হয়। গড়ে ১৫০ টাকা হিসেবে ১৩০টি নার্সারি থেকে দিনে সাড়ে ১৯ হাজার টাকা ও মাসে ৫ লাখ ৮৫ হাজার টাকা চাঁদা ওঠে।

আমি তো ছাইড়া গেছি। এহন তো বড় স্যারেরা যাঁরা, তাঁরাই ডিল করে এগুলা। ওখানে সবাই আছে।
ঠান্ডু মিয়া, রাজউকের উত্তরা অঞ্চলের রেখাকার

নিয়ন্ত্রণে আ.লীগ নেতারা

নার্সারি মালিকেরা বলছেন, পঞ্চবটি এলাকা থেকে ১০ নম্বর সেতু হয়ে ৪ নম্বর সেতু অংশে সড়কের দুই পাশে থাকা নার্সারিগুলো ঢাকা উত্তর সিটির ৫২ নম্বর ওয়ার্ডের ৬ নম্বর ইউনিট আওয়ামী লীগের সভাপতি শিবচরণ সরকার এবং ৫২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নেতা শান্তি সরকারের নিয়ন্ত্রণে। এখানে অর্ধশতাধিক নার্সারি আছে।

অবৈধভাবে নার্সারি ব্যবসা পরিচালনা, নিয়ন্ত্রণ ও চাঁদার ভাগ পাওয়ার বিষয়ে জানতে শিবচরণ সরকারের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়।

৪ নম্বর অ্যাভিনিউ সড়কের ৪ নম্বর সেতুর উত্তর পাশ থেকে ৯ নম্বর অ্যাভিনিউর সংযোগস্থলে গোলচত্বর পর্যন্ত সড়কের পূর্ব পাশ ও লেকের পাড়–ঘেঁষে আরও ৮০টি নার্সারি আছে। এর নিয়ন্ত্রণ করেন তুরাগ থানা আওয়ামী লীগের অর্থবিষয়ক সম্পাদক নূর হোসেন। তবে চাঁদা তোলেন তাঁর অনুসারী জলিল, নেকাব্বর, ফয়সাল ও হাসেম নামের স্থানীয় লোকজন।

অভিযোগ অস্বীকার করে নূর হোসেন বলেন, ‘আমার জীবনে এগুলো থেকে খাইনি, এগুলোতে যাইও না।’ অনুসারীদের নাম জানানো হলে তিনি বলেন, ওরা চাঁদা নিয়ে থাকতে পারে। কারণ, ওরা রাজউকের কাজ করে, ব্যবসা করে।

রাজউক কর্মীদের নামে চাঁদা

নার্সারির মালিকেরা জানান, রাজউকের কর্মকর্তাদের ‘ম্যানেজ’ বাবদ প্রতি নার্সারি থেকে মাসে এক হাজার করে টাকা নেওয়া হয়। অভিযোগ আছে, ওই টাকা আদায় করেন রাজউকের উত্তরা অঞ্চলের রেখাকার ঠান্ডু মিয়া। তিনি একসময় উত্তরা তৃতীয় পর্ব প্রকল্পের পরিদর্শকের দায়িত্বে ছিলেন। এ হিসাবে ১৩০টি নার্সারি থেকে মাসে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা ওঠে। এ বিষয়ে ঠান্ডু মিয়া বলেন, ‘আমি তো ছাইড়া গেছি। এহন তো বড় স্যারেরা যাঁরা, তাঁরাই ডিল করে এগুলা। ওখানে সবাই আছে।’

অবৈধ বিদ্যুৎ–সংযোগ

নার্সারিগুলোতে অবৈধ বৈদ্যুতিক–সংযোগ দিয়েছেন ঢাকা মহানগর উত্তর বাস্তুহারা লীগ নামের একটি সংগঠনের সভাপতি দাবি করা ফরিদ খান। প্রতিটি নার্সারিতে সাবমিটার বসানো হয়েছে। প্রতি ইউনিটের ২৫ টাকা করে বিল নেওয়া হয়। চাঁদা তোলেন সহকারী সুলতান নামের এক ব্যক্তি।

নার্সারি মালিকেরা জানান, প্রায় প্রতি মাসেই কমবেশি ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা বিল আসে। তাই গড়ে সাড়ে ৪০০ টাকা হিসাবে ১৩০টি নার্সারি থেকে বিদ্যুতের বিল বাবদ আদায় করা হয় সাড়ে ৫৮ হাজার টাকা।

ফরিদ খানের একটি মুঠোফোন নম্বর সুলতানকে ব্যবহারের জন্য দেওয়া হয়েছে। ওই নম্বরে ফোন করা হলে সুলতান নিজেকে ফরিদ খানের সহকারী বলে পরিচয় দেন। তবে সাংবাদিক পরিচয় জানার পর সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেন।

ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানির (ডেসকো) উত্তরা সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান মুঠোফোনে বলেন, ‘অবৈধভাবে সংযোগ দেওয়ার বিষয়টি জানা নেই। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হবে।’

রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের জন্য বরাদ্দ করা চাঁদার টাকা জমা হয় ঢাকা উত্তর নার্সারি মালিক সোসাইটির সভাপতি জসিম মোল্লার কাছে। এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে জসিম বলেন, ‘কোনো চাঁদা নেওয়া হয় না। মাঝেমধ্যে নিজেরাই বসে চা-নাশতার জন্য খরচ করি।’ বিদ্যুৎ–সংযোগের বিষয়ে তিনি বলেন ‘ওই টাকা ফরিদ খান নামের একজনকে দিতে হয়। মিটার অনুযায়ী বিল হয়।’