বিশ্বের সর্বোচ্চ জনঘনত্ব ঢাকার চার এলাকায়

■ ঢাকার লালবাগ, বংশাল, গেন্ডারিয়া ও সবুজবাগে প্রতি একরে ৭০০ থেকে ৮০০ মানুষ বাস করে, যা বিশ্বে সর্বোচ্চ।

■ রাজধানীর ৬৩% এলাকায় প্রতি একরে ৩০০ জনের বেশি মানুষ বাস করে।

■ ঢাকার বাইরে একরপ্রতি জনঘনত্ব বেশি দুবাইয়ের আয়াল নাসির এলাকায়।

প্রতীকী ছবি

রাজধানীর চারটি এলাকার জনঘনত্ব বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এই চার এলাকা হলো পুরান ঢাকার লালবাগ, বংশাল ও গেন্ডারিয়া এবং খিলগাঁওয়ের সবুজবাগ। এসব এলাকায় প্রতি একর আয়তনে ৭০০ থেকে ৮০০ মানুষ বাস করে।

নগর-পরিকল্পনাবিদদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেওয়া এক চিঠিতে জনঘনত্বের এই চিত্র তুলে ধরেছে। তারা বলছে, মহানগর বা মেগাসিটির ক্ষেত্রে জনঘনত্বের মানদণ্ড ধরা হয় একরপ্রতি সর্বোচ্চ ১২০ জন। অথচ ঢাকার ৬৩ শতাংশ এলাকায় প্রতি একরে ৩০০ জনের বেশি মানুষ বাস করে। একরপ্রতি জনঘনত্ব ৪০০ জনের বেশি ঢাকার ৪০ শতাংশ এলাকায়।

সবচেয়ে বেশি জনঘনত্বের চার এলাকার বিষয়ে বিআইপি বলছে, এসব এলাকা অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও নাগরিক সুবিধার সব মানদণ্ডে পিছিয়ে রয়েছে।

সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক আদিল মুহাম্মদ খান প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকাকে বসবাস-অযোগ্যতার হাত থেকে বাঁচাতে হলে জনসংখ্যা ও জনঘনত্ব নিয়ন্ত্রণের কোনো বিকল্প নেই। ঢাকামুখী মানুষের স্রোত বন্ধ করতে হবে। ঢাকার বাইরে কর্মসংস্থান ও অন্যান্য নাগরিক সুবিধা বাড়ানো জরুরি।

ঢাকার পরে যেগুলো

বিআইপি জানিয়েছে, কোন এলাকায় জনঘনত্ব বিশ্বের সর্বোচ্চ, সেই হিসাব করা হয়েছে জাতিসংঘের জনসংখ্যাবিষয়ক তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে। ঢাকায় আরও এলাকায় জনঘনত্ব সহনীয় মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি। তবে তাদের পর্যালোচনায় লালবাগ, বংশাল, গেন্ডারিয়া ও সবুজবাগে জনঘনত্ব ঢাকার মধ্যে সর্বোচ্চ।

সংগঠনটি প্রথম আলোকে জানায়, ঢাকার বাইরে জনঘনত্বের দিক দিয়ে বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে সংযুক্ত আরব-আমিরাতের শহর দুবাইয়ের আয়াল নাসির এলাকা। সেখানে একরপ্রতি বসবাস ৬০০ জনের। কেনিয়ার নাইরোবির মাথারে নর্থ এলাকা রয়েছে তৃতীয় অবস্থানে। সেখানে একরপ্রতি বসবাস করে ৪৮০ জন। একরপ্রতি ৪৬০ জন নিয়ে চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে ভারতের মুম্বাইয়ের জাভেরি বাজার এলাকা।

গা ঘেঁষে ভবন, সরু রাস্তা

ঢাকার যে চারটি এলাকার কথা বলা হয়েছে, সেখানে ঘরবাড়ি গড়ে উঠেছে অপরিকল্পিতভাবে। একটি ভবন তৈরি হয়েছে আরেকটি ভবন ঘেঁষে, কোনো ফাঁকা জায়গা রাখা হয়নি। রাস্তাঘাটও সরু। অনেক জায়গায় ফায়ার সার্ভিসের গাড়িও ঢুকতে পারে না। যেমন পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়া একসময় ‘গ্রান্ড এরিয়া’ নামে পরিচিত ছিল। ঢাকার অপেক্ষাকৃত সচ্ছল মানুষের বাস ছিল সেখানে। এর পাশ দিয়ে বয়ে গেছে বুড়িগঙ্গা নদী। সেই নদীর পানি এখন দূষিত। আর গ্রান্ড এরিয়া নামটি গেন্ডারিয়ায় রূপান্তরিত হয়েছে, এলাকাটি হয়ে গেছে অপরিকল্পিত ও ঘিঞ্জি।

চার দশক ধরে গেন্ডারিয়ায় বসবাস করা সাইদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, একসময় গেন্ডারিয়ায় খুব ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল। সন্তানকে সেখানে ভর্তি করাতে মানুষ গেন্ডারিয়ায় বসবাস শুরু করেন। এর পাশাপাশি আশির দশকের পর থেকে গেন্ডারিয়া এলাকায় জমির দাম বেড়ে যায়। বেশি দামে জমি কেনার কারণে কেউ জায়গা ছেড়ে ভবন নির্মাণ করেননি। অল্প জায়গায় ভবনসংখ্যা বেশি। তাই মানুষের বাসও বেশি।

বিআইপির চিঠি

বিআইপি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চিঠিটি দিয়েছে ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা বা ড্যাপ (২০১৬-৩৫) নিয়ে নিজেদের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরতে। সংগঠনটির সভাপতি আকতার মাহমুদ ও সাধারণ সম্পাদক আদিল মুহাম্মদ খানের সই করা চিঠিতে সাতটি পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা হয়।

এদিকে গত ৩০ ডিসেম্বর সংশোধিত ড্যাপের অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। এখন এর চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হবে বলে জানিয়েছেন ড্যাপের প্রকল্প পরিচালক ও রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) নগর-পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মন্ত্রিপরিষদ থেকে সংশোধিত ড্যাপে কিছু পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়েছে। সেই আলোকে তাঁরা কাজ করছেন।

এর আগে ঢাকাকে বসবাসের উপযোগী, দৃষ্টিনন্দন ও নাগরিক সুবিধার আধারে পরিণত করতে ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যান (১৯৯৫-২০১৫) বা ২০ বছর মেয়াদি বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছিল। কিন্তু নানা অসংগতি থাকায় ড্যাপ সংশোধনের সিদ্ধান্ত হয়। সেই কাজই এখন চলছে। ওদিকে পরিকল্পনা নিতে সময়ক্ষেপণের কারণে রাজধানীর সম্প্রসারিত এলাকাও অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠছে।

‘ঢাকার ধারণক্ষমতা অতিক্রান্ত হয়ে গেছে’

যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) ২০২১ সালের প্রতিবেদন অনুসারে, বাসযোগ্য শহরের দিক দিয়ে ১৪০টি শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান ১৩৭তম। তালিকায় ঢাকার চেয়েও খারাপ অবস্থানে রয়েছে পাপুয়া নিউগিনির পোর্ট মোরেসবি, নাইজেরিয়ার লেগোস ও সিরিয়ার দামেস্ক।

বিআইপি বলছে, বাসযোগ্যতার সূচকে ঢাকা শহরের তলানিতে অবস্থানের অন্যতম কারণ অতিরিক্ত জনসংখ্যা ও অধিক জনঘনত্ব। উন্নয়ন পরিকল্পনায় জনঘনত্ব এবং অবকাঠামো ও নাগরিক সুযোগ-সুবিধার আলোকে নগরের ভারবহনক্ষমতা বিবেচনা না করা হলে যেকোনো শহর তার বাসযোগ্যতা হারায়। ঢাকা এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ড্যাপের মধ্যে জনঘনত্ব পরিকল্পনার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা ইতিবাচক পদক্ষেপ।

উল্লেখ্য, ড্যাপের সংশোধিত প্রস্তাবে পরিকল্পিত এলাকার জন্য প্রতি একর আয়তনে ২৫০ এবং অন্য এলাকার জন্য প্রতি একরে ২০০ জন মানুষ বসবাস করবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

বিআইপি বলছে, একটি বড় শহরের জনঘনত্বের জন্য মানদণ্ড ধরা হয় প্রতি একরে ৭০ থেকে ৮০ জন, যা সর্বোচ্চ ১২০ জন পর্যন্ত হতে পারে। জাপানের টোকিও শহরের কেন্দ্রীয় এলাকার জনঘনত্ব একরপ্রতি ৯০ জনের কম। অস্ট্রেলিয়ায় সিডনি শহরের সর্বোচ্চ জনঘনত্ব প্রতি একরে ৫৮ জন। নিউইয়র্ক শহরের ম্যানহাটানের জনঘনত্ব ১১২ এবং অন্যান্য এলাকার ঘনত্ব প্রতি একরে ৬০-এর নিচে।

আকতার মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকার ধারণক্ষমতা অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। এখন নিয়ন্ত্রণ আরোপ না করা হলে ঢাকা আরও বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে। পাশাপাশি ঢাকার আশপাশে পরিকল্পিত উন্নয়নের সম্ভাবনার পথও বন্ধ হয়ে যাবে।