‘ভাইরাল হয়নি, তাই বিচার পাইনা’

আদনান তাসিন
ফাইল ছবি

আদনান তাসিন নেই ৬০১ দিন (০৪ অক্টোবর)। গুনে গুনে দিনের হিসাব রাখেন বাবা আহসান উল্লাহ। আক্ষেপ করে বললেন, ‘ভাইরাল না হওয়ায়, আন্দোলন না হওয়ায় আজও বিচার পেলাম না।’ তাঁর মতে, তাঁর ছেলের মৃত্যুর পর কোনো আন্দোলন না হওয়ায় এতদিনেও কেউ গ্রেপ্তার হয়নি।

তাসিন গত বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি কলেজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে বেলা দেড়টা-দুইটার দিকে উত্তরা পরিবহনের (ঢাকা মেট্রো ব ১১-৪৫৮৪) একটি বাসের চাপায় মারা যায়। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের সেন্ট জোসেফের ইংলিশ ভার্সনে একাদশ শ্রেণির (বিজ্ঞান শাখা) ছাত্র ছিল সে।

তাসিন নিহত হওয়ার দিন পুলিশ বাদী হয়ে খিলক্ষেত থানায় সড়ক পরিবহন আইনের ১০৫ ধারায় মামলা করে। শুরুতে খিলক্ষেত থানায় তাসিনের মামলাটির তদন্তের দায়িত্বে ছিলেন পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) মোফাখখারুল ইসলাম। এখন মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা হলেন খিলক্ষেত থানার উপপরিদর্শক (এসআই) রিপন কুমার। এ বছরের ১৫ জানুয়ারি তিনি আগের ধারা পাল্টে দণ্ডবিধি ২৭৯/ ৩০৪ খ ধারায় আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন। এতে চালক হিসেবে মো. জাকির (৪০) নামে এক ব্যক্তিকে একমাত্র আসামি করা হয়েছে। বাসের মালিক সাত্তার হাওলাদার এবং বাসটি লিজ নিয়ে পরিচালনাকারী এমরান শেখের অব্যাহতি চাওয়া হয়েছে। ১৭ সেপ্টেম্বর উচ্চ আদালত মামলার পরবর্তী শুনানি ১৮ অক্টোবর ধার্য করেছেন।

মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে এসআই রিপন কুমার বলেন, ‘মামলাটি ভুল ধারায় হয়েছিল। ওই সময় সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ গেজেট আকারে প্রকাশ হয়নি (২০১৯ সালের ১ নভেম্বর থেকে কার্যকর)। আর আদালতে বিচারাধীন বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাই না।’

ওই মামলায় কেউ গ্রেপ্তার আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি জবাব দেন, ‘না, কেউ গ্রেপ্তার নেই।’

তাসিনের বাবা আহসান উল্লাহ বলেন, ‘মামলাটির ব্যাপারে যতটা ফাঁকফোকর রাখা যায়, তা রেখে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়েছে। জব্দ করা বাসটি মালিককে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।’

পুলিশের অভিযোগপত্রে চালক হিসাবে জাকিরের ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছে, গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার বোয়ালী ইউনিয়নের গাবচালা গ্রাম। গত ২৪ সেপ্টেম্বর সেখানে যান প্রথম আলোর গাজীপুর প্রতিনিধি। জাকিরের বাবা বিল্লাল হোসেন ওরফে কানা বিল্লাল দাবি করেন, বাস দুর্ঘটনার পর থেকে তাঁর ছেলে আর বাড়িতে আসেননি। তাঁর ভাষ্য, ‘আমরা ধইরা নিছি ও মইরা গেছে। পরিচয় না পাইয়া হয়তো কেউ দাফন কইরা ফালাইছে।’

জাকিরদের বাড়ির আশপাশে একাধিক বাসিন্দা জানান, জাকিরকে হঠাৎ হঠাৎ এলাকায় দেখা যায়।

আহসান উল্লাহ জানান, ছেলের মৃত্যুর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশসহ (ডিএমপি) ১৬টি জায়গায় চিঠি পাঠিয়েছেন। ১০টি মানববন্ধন করেছেন। গত বছরের মার্চের একটি মানববন্ধনে ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ইলিয়াস কাঞ্চন অংশ নেন।

তাসিনের মামলার বিষয়ে ইলিয়াস কাঞ্চন প্রথম আলোকে বলেন, পরিবহন শ্রমিক নেতারা সরকারকে প্রভাবিত করে বলে সড়ক দুর্ঘটনা কমছে না। বিরোধী দলে যাঁরা থাকেন, তাঁরাও পরিবহন শ্রমিকদের বিরুদ্ধে কথা বলেন না। পরিকল্পনা নিয়ে না এগোলে সড়কে কখনো শৃঙ্খলা আসবে না।

রাজধানীর বারিধারাসংলগ্ন নদ্দার জোয়ার সাহারা বাজার এলাকায় অলিপাড়ায় স্ত্রী শাহিদা আক্তার ও বড় ছেলে রাজশাহী প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আদনান সামিনকে নিয়ে বসবাস করেন আহসান উল্লাহ। একটি পোশাক কারখানায় তিনি সোর্সিং ও মার্চেন্ডাইজিং ব্যবস্থাপক হিসেবে চাকরি করতেন। ২০১৭ সালে জিবিএস ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে তিনি পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েন। এখন কিছুটা চলাচল করতে পারলেও পুরোপুরি সুস্থ নন।

আক্ষেপের সুরে তাসিনের বাবা বলেন, ‘সন্তান হারানোর কষ্ট একই। আমার তাসিনের জন্য তো কেউ এসে দাঁড়াল না! কেউ বিক্ষোভ-প্রতিবাদ করল না!’