মুক্তিযুদ্ধের নান্দনিক উপস্থাপনা

এপিক–১৯৭১ প্রদর্শনী উদ্বোধনের পর শিল্পকর্ম দেখছেন অতিথি ও দর্শকেরা। গতকাল সন্ধ্যায় উত্তরার গ্যালারি কায়ায়
ছবি: প্রথম আলো

মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় বাঙালির চিরকালের গৌরবের অর্জন। এবার তার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্‌যাপিত হলো বহুমাত্রিক আয়োজনে। এরই ধারাবাহিকতায় শিল্পীদের রঙে, রেখায় এই অনন্য অর্জনকে নিয়ে বিশেষ প্রদর্শনীর আয়োজন করল গ্যালারি কায়া।

বাংলাদেশ ও ভারতের আট শিল্পীর শিল্পকর্ম নিয়ে ‘এপিক-১৯৭১’ নামের প্রদর্শনী শুরু হলো গতকাল শুক্রবার উত্তরার ৪ নম্বর সেক্টরের ১৬ নম্বর সড়কের ২০ নম্বর বাড়ির গ্যালারি কায়াতে। বাংলাদেশের চার শিল্পী হলেন শাহাবুদ্দিন আহমেদ, জামাল আহমেদ, রণজিৎ দাশ ও আলপ্তগীন তুষার। ভারতের শিল্পীরা হলেন সোমনাথ হোর, আদিত্য বসাক, চন্দ্র ভট্টাচার্য ও অতীন বসাক। তাঁদের বিভিন্ন মাধ্যমের মোট ৩১টি শিল্পকর্ম রয়েছে। এ ছাড়া ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে পটুয়া কামরুল হাসান, রশীদ চৌধুরী ও মোহাম্মদ কিবরিয়ার পাঁচটি কাজ রয়েছে এই প্রদর্শনীতে। প্রদর্শনী চলবে ২৯ জানুয়ারি পর্যন্ত। বেলা সাড়ে ১১টা থেকে রাত সাড়ে সাতটা পর্যন্ত প্রদর্শনী সবার জন্য খোলা থাকবে।

সন্ধ্যায় প্রধান অতিথি হিসেবে প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান। বিশেষ অতিথি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। শিল্পীদের মধ্যে বক্তব্য দেন জামাল আহমেদ।

স্বাগত বক্তব্যে গ্যালারি কায়ার পরিচালক শিল্পী গৌতম চক্রবর্তী বলেন, ‘গ্যালারি কায়া এবার ১৭ বছর অতিক্রম করল। বিগত দিনগুলোতে কায়া একক ও যৌথ মিলিয়ে ১২৫টি প্রদর্শনী, ২৫টি আর্ট ট্রিপ, ৬টি আর্ট ক্যাম্প ও ৫টি কর্মশালার আয়োজনের ভেতর দিয়ে সৃজনশীলতা বিকাশের ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে। অশ্রু, বেদনা ও বিজয় নিয়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের আবেগ অনুভব অনেক গভীর। মহাকাব্যিক এই অর্জনের সুবর্ণজয়ন্তীতে শিল্পীদের কাজের ভেতর দিয়ে তা তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।’

জামাল আহমেদ বলেন, এই প্রদর্শনী তরুণ শিল্পীদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করবে।

মফিদুল হক বলেন, এই প্রদর্শনীতে প্রবীণ সোমনাথ হোর থেকে নবীন প্রজন্মের শিল্পীদের কাজের মধ্যে একটি ধারাবাহিকতার পরম্পরা রয়েছে। স্বাধীনতার জন্য ১৯৭১ সালে বাঙালির জনযুদ্ধের যে মহাকাব্যিক বহুমাত্রিকতা রয়েছে, তা আমাদের নানা দৃষ্টিকোণ থেকে খুঁজে দেখতে হবে। তখন যে জাগরণের সৃষ্টি হয়েছিল, তাতে বহু মানুষের আত্মদান এবং বহু রকমের ভূমিকা রয়েছে। সৃজনশীল মাধ্যমে তা তুলে ধরার এই প্রয়াস প্রশংসনীয়।

প্রদর্শনীর উদ্বোধন করে মতিউর রহমান বলেন, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ কেবল রাজনৈতিক আন্দোলনের চূড়ান্ত প্রকাশ নয়, এর সঙ্গে সমান্তরাল ভূমিকা ছিল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের। গত শতকের ৫০ ও ৬০ দশকে দেশের বিভিন্ন মাধ্যমে শিল্পী–সাহিত্যিকেরা প্রগতিশীল আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত থেকেছেন। বিশেষ করে চারুশিল্পীরা সেই সময় প্রদর্শনী করে, পোস্টার ও ব্যানার এঁকে, এমনকি আন্দোলনে সরাসরি সক্রিয় থেকে বাঙালি সংস্কৃতির নবজাগরণের সৃষ্টি করেছিলেন। সেই সাংস্কৃতিক চেতনা রাজনৈতিক আন্দোলনকে বেগবান করেছে। তিনি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে গ্যালারি কায়ার ওই প্রদর্শনীর প্রশংসা করে বলেন, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, পটুয়া কামরুল হাসান, রশীদ চৌধুরী, মোহাম্মদ কিবরিয়া, আমিনুল ইসলাম, মুর্তজা বশীর, দেবদাশ চক্রবর্তী, প্রাণেশ মণ্ডল, নিতুন কুন্ডু, কাইয়ুম চৌধুরী, হাশেম খান, রফিকুন নবীসহ প্রবীণ নবীন শিল্পীদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক কাজ রয়েছে। এসব শিল্পকর্ম নিয়ে প্রদর্শনীর আয়োজন করলে নতুন প্রজন্মকে তা অনুপ্রাণিত করবে।

কায়ার এই প্রদর্শনীতে শাহবুদ্দিন আহমেদের শত্রু নিধনে ধাবমান মুক্তিযোদ্ধার একটি বিশাল তৈলচিত্রসহ শিল্পকর্ম রয়েছে পাঁচটি। জামাল আহমেদ এঁকেছেন অস্ত্র নিয়ে গেরিলা যোদ্ধার ছবি। রণজিৎ দাশ কোলাজের আঙ্গিকে তুলে ধরেছেন গণহত্যা, নারীদের ওপর নির্যাতন ও বঙ্গবন্ধুর ভাষণের দৃশ্য। আলপ্তগীন তুষার এঁকেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি।

ভারতের শিল্পীদের মধ্যে সোমনাথ হোরের রয়েছে কয়েকটি ছাপচিত্র ও ড্রয়িং। আদিত্য বসাক এঁকেছেন যোদ্ধা ও গণহত্যার ছবি। ‘যুদ্ধ শেষে’ নামের একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে স্তূপাকার মাথার খুলি। চন্দ্র ভট্টাচার্যের ‘তিরবিদ্ধ মানুষ’–এর ছবিতে শিল্পী প্রতীকী ব্যঞ্জনায় বেদনা ও বীভৎসতা তুলে এনেছেন। অতীন বসাক এঁকেছেন অস্থির স্তূপের ভেতর দিয়ে নতুন জীবনের বিকাশ। মুক্তিযুদ্ধের এই নান্দনিক উপস্থাপনা দর্শকদেরও গর্বিত করে তুলবে।