মুখোমুখি সংলাপরত আসবাবগুলো
কাঠের ইজিচেয়ারের মুখোমুখি ছয় বছরের ‘সিনিয়র’ একটি বেঞ্চ। স্থপতি কাজী খালিদ আশরাফের নকশায় ২০১৬ সালে চেয়ারটি বানিয়েছিলেন কারিগর মোহাম্মদ মানিক। আর ২০১০ সালে নিতি মাহবুবের ফরমায়েশে রুহুল আমিন বানিয়েছেন বেঞ্চটি। গাছ থেকে কেটে বের করা কাঠের আয়তাকার একটি টুকরার দুটি পায়া জুড়ে দেওয়া বেঞ্চটি অনেক স্মৃতির বাহক। হয়তো পরস্পরের স্মৃতিই ভাগাভাগি করছিল এরা। কাছেই কড়ই কাঠের এক জোড়া পাশটেবিল, যেন উল্টে রাখা দুটি পানপাত্র। বাংলাদেশের কারিগর দিয়ে বানিয়ে নিয়েছেন মার্কিন স্থপতি ডায়ান রিউ টেইলর। বিবর্তিত গাছেরা যখন মুখোমুখি, তখন কারিগর আর নকশাকারের দল অবতারণা করেছেন অন্য এক আলাপের।
হাজারীবাগে আজ শনিবার থেকে শুরু হয়েছে নকশা করা পুরোনো আসবাবের এক বিশেষ প্রদর্শনী ‘স্থিতি’। বৃহত্ত্ব আর্ট ফাউন্ডেশনের আয়োজনে এতে জড়ো করা হয়েছে ১৭ জন চারুশিল্পী, স্থপতি ও কারুশিল্পীর ৩৩টি আসবাব। এর প্রতিটির পেছনে যেমন রয়েছে গল্প, স্মৃতি ও আবেগ। তেমনি প্রদর্শনীর জন্য এগুলোকে জড়ো করার নেপথ্যে রয়েছে নতুন এক সংলাপ শুরুর সংকল্প।
আয়োজকেরা জানান, প্রদর্শনীর আগে কিউরেটরদের সঙ্গে সংলাপ হয় স্থপতিদের। সেখানে মেরিনা তাবাসসুম জানান, তাঁর নির্মাণবিষয়ক চেতনার কথা। তিনি বলেন, ‘অতি মাত্রায় ভোগের জন্য অধিক উপাদান ও অধিক উৎপাদন প্রয়োজন।
শিল্পায়নের বিরোধী না হলেও লোভ এবং সূচক বৃদ্ধির জন্য আমি অধিক উৎপাদনের পক্ষে নই। এটি বিপুল লাভের ধারণা তৈরি করে এবং অসমতা সৃষ্টি করে।’ ‘স্থিতি’ দর্শনে গেলে দেখা যাবে তাঁর দার্শনিকতা ও আদর্শের আলামত। বাতিল বাঁশ থেকে নিজের অফিসের জন্য তিনি বানিয়ে নিয়েছেন একটি বেঞ্চ। দেখলেই মনে প্রশ্ন তৈরি হবে, সুসজ্জিত করপোরেট দুনিয়া কি গ্রহণ করবে তিন শ টাকার বাঁশের বেঞ্চ? ১৯৭০ সালে বানানো মাজহারুল ইসলামের একটি ড্রাফটিং টেবিলের ওপর দেখা গেল ১৯৭১ সালের একটি চেয়ারের নকশা। তখনকার দিনের স্থপতিদের অভিজ্ঞতা ও অল্পে বাঁচার চেতনা জড়িয়ে আছে ওই চেয়ার ও ড্রাফটিং টেবিলটির সঙ্গে। এ প্রসঙ্গে মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘তখন সামান্য উপকরণ দিয়ে আমরা কাজ করতাম।
উদ্দেশ্য, স্বল্প ব্যয়ে জিনিস বানানো। দুই টাকায় যেটি সম্ভব, সেখানে কেন পাঁচ টাকা খরচ করব?’ ১৯৭০ সালের বাংলাদেশের সঙ্গে কি আজকের বাংলাদেশকে মেলানো যাবে? কিংবা তখনকার স্থপতিদের সঙ্গে এখনকার? মাজহারুল ইসলামের টেবিল থেকে মুখ তুলে ডানে শেষ প্রান্তে রাখা ছিল মেরিনা তাবাসসুমের বইয়ের তাক। পুরোটাই স্টিলের। মেরিনা চেয়েছিলেন, বই বাড়বে, একটি করে তাক বাড়ানো হবে। তাকটি তাঁর সঙ্গী হিসেবে থেকে যাবে কালের সাক্ষী হয়ে। এর কারিগর ইমাম উদ্দিন চলে গেছেন। তাঁর স্মৃতিও জড়িয়ে রয়েছে ২০০৬ সালে তৈরি এ তাকের সঙ্গে।
প্রদর্শনীতে রাখা বাড়ি বা অফিসের এসব আসবাবের মধ্যে রয়েছে কয়েক প্রজন্মের সম্মিলিত যাত্রার গল্প। নকশার সামগ্রিক সত্তা এবং সম্পর্কের অনুসন্ধান। জলবায়ুর সঙ্গে বস্তুগত, সহজীকরণের সঙ্গে সম্পদের, ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিকতার এবং সামগ্রিকতার সঙ্গে দার্শনিকতা ও আধ্যাত্মিকতার।
প্রদর্শনীর বাছাই–বিন্যাস করেছেন বাংলাদেশের শিল্পী বিশ্বজিৎ গোস্বামী, যুক্তরাষ্ট্রের স্থপতি ডায়ান রিউ টেইলর ও উলরাইক ফেলনার। সম্পর্কের অনুসন্ধানের কারণ প্রসঙ্গে বিশ্বজিৎ বলেন, ‘সম্পর্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চারপাশে একটি শক্তিশালী বলয় তৈরি করা জরুরি। যেন অন্য মানুষের সঙ্গে, জায়গা বা সমাজের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করা যায়। এই কার্যকলাপ যেন আমার শরীর ও আত্মার ভেতরে একটি প্রতিফলন তৈরি করতে পারে।’
বিস্ময়ের স্বর শোনা যায় ডায়ানের কণ্ঠেও। মাত্র ৩০০ টাকায় কেনা দুটি স্পিকার দিয়ে টেপারড কোয়ার্টার ওয়েভ টিউব বানিয়েছেন বিকেএস ইনান, যেটায় বাজছিল সমসাময়িক জাপানি সুর। বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী জিনিস দিয়ে এখানে দারুণ সব কাজ করা যায়, তা দেখে চমৎকৃত এই নকশাকার।
বৃহত্ত্ব আর্ট ফাউন্ডেশনের সহপ্রতিষ্ঠাতা নুসরাত মাহমুদ জানান, বাংলাদেশের নকশাকে মাধ্যম করে শিল্পী, স্থপতি, নকশাকার কারুশিল্পী ও গবেষকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এক নতুন সংলাপ রচনা করাই তাদের লক্ষ্য।
এই প্রদর্শনীতে রয়েছে স্থপতি মাজহারুল ইসলাম, বশিরুল হক, শামসুল ওয়ারেস, কাজী খালিদ আশরাফ, নাহাস আহমেদ খলিল, সাইফ উল হক, বি কে এস ইনান, সালাউদ্দিন আহমদ, মেরিনা তাবাসসুম, নিতি মাহবুব, যুবায়ের হাসান, ডায়ান রিউ টেইলর, ভাস্কর তেজস হালদার জশ, চিত্রকর ওয়াকিলুর রহমান, বিশ্বজিৎ গোস্বামী, রুফলাইনারস স্টুডিও অব আর্কিটেকচার, কারুশিল্পী আলমগীরের কাজ। প্রদর্শনী ঘুরে দেখা যাবে ২৬ জুন পর্যন্ত। বেলা ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত দেখে আসা যাবে এই প্রদর্শনী।