মেট্রোরেলের চলাচল দেখা যাবে আগস্টে

এক বছর পরীক্ষামূলক চলাচল। যাত্রী নিয়ে চলবে ২০২২ সালের পর। আরও তিন সেট আসছে সেপ্টেম্বরের মধ্যে।

  • মে পর্যন্ত পুরো প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি প্রায় ৬৫ শতাংশ।

  • উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত উড়ালপথসহ নির্মাণকাজের অগ্রগতি প্রায় ৮৬ শতাংশ।

  • আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি প্রায় ৬৩ শতাংশ।

মেট্রোরেলের দুই সেট ট্রেন এখন উত্তরার ডিপোতে। চলছে বিভিন্ন পর্যায়ের পরীক্ষা-নিরীক্ষা। আগামী আগস্টে উড়ালপথে এই ট্রেনের পরীক্ষামূলক চলাচল দেখতে পাবে ঢাকাবাসী।
ফাইল ছবি

ঢাকায় মেট্রোরেল চলাচলের উড়ালপথের চার ভাগের তিন ভাগ নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। জাপান থেকে দেশে এসেছে দুই সেট ট্রেন। সেপ্টেম্বরের মধ্যে আরও তিন সেট ট্রেন আসছে। বাকি ১৯ সেট ট্রেন পর্যায়ক্রমে আসবে।

মেট্রোরেল নির্মাণ ও পরিচালনার দায়িত্বে থাকা ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) বলছে, আগামী আগস্টে ঢাকাবাসী উড়ালপথে ট্রেনের চলাচল দেখতে পাবে। প্রথম দফায় ট্রেন চলবে উত্তরা থেকে পল্লবী পর্যন্ত, এরপর তা চলবে আগারগাঁও পর্যন্ত। তবে এই চলাচল হবে পরীক্ষামূলক, যাত্রী চড়বে না। এভাবে বছরখানেক পরীক্ষামূলক চলবে মেট্রোরেল। ২০২২ সালের ডিসেম্বরের পর উত্তরা-আগারগাঁও পর্যন্ত যাত্রী নিয়ে মেট্রোরেলের বাণিজ্যিক যাত্রা শুরু হতে পারে।

অবশ্য উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত পুরোটা একসঙ্গে মেট্রোরেল চালুরও পরিকল্পনা আছে বলে জানিয়েছে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। সেটা হলে মেট্রোরেল চালু হতে পারে ২০২৩ সালের জুনের পর। এই প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত।

মেট্রোরেলের উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত পথটি লাইন-৬ নামে পরিচিত। এই পথের দৈর্ঘ্য ২০ দশমিক ১০ কিলোমিটার। এর মধ্যে ১৬টি স্টেশন থাকছে। লাইন-৬-এর দুটি ভাগ: উত্তরা থেকে আগারগাঁও এবং আগারগাঁও থেকে মতিঝিল। এর মধ্যে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত চালুর অগ্রাধিকার ঠিক করেছিল সরকার। কয়েক দফা সময়সীমা পরিবর্তন করে সর্বশেষ আগামী বছরের জুনে এই অংশে ট্রেন চালুর পরিকল্পনা ছিল।

প্রকল্পসংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, হোলি আর্টিজান বেকারিতে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় মেট্রোরেলের কাজে গতি কমে যায়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গত বছর থেকে চলমান করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি। এসব কারণে বিদেশি বিশেষজ্ঞ ও কর্মীদের ঠিকমতো পাওয়া যায় না। বিদেশ থেকে প্রকল্পের মালামাল আনাতেও সমস্যা হচ্ছে। মে পর্যন্ত প্রকল্পের কাজে যুক্ত ৬৬৮ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন।

প্রায় ২২ হাজার কোটি ব্যয়ে সরকার মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এই প্রকল্পে অর্থায়ন করছে জাপানের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা জাইকা। মে পর্যন্ত পুরো প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি প্রায় ৬৫ শতাংশ।

ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও সাবেক জ্যেষ্ঠ সচিব এম এ এন সিদ্দিক প্রথম আলোকে বলেন, পরীক্ষামূলক চলাচলের মাঝপথেই যাত্রীসহ মেট্রোরেলের বাণিজ্যিক চলাচলের সময়সীমা জানিয়ে দেওয়া হবে। ইতিমধ্যে ভাড়া নির্ধারণে একটা কমিটি কাজ করছে। তিনি জানান, মেট্রোরেল এক বছর পরীক্ষামূলক চলাচলের আওতায় থাকবে। এরপর যাত্রী পরিবহন করা যাবে।

পরীক্ষামূলক চলাচল

মেট্রোরেলের একটি সেটে ছয়টি কোচ আছে। ২৪টি ট্রেনের মধ্যে প্রথম সেটটি ঢাকায় এসেছে গত ২৩ এপ্রিল। এরপর উত্তরায় ডিপোতে সেটির ১৯ ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পন্ন করা হয়। ১৪ মে ডিপোর ভেতর প্রায় ৫০০ মিটার তা চালিয়ে দেখা হয়। ইতিমধ্যে দ্বিতীয় সেট ট্রেনও ঢাকায় এসেছে ১ জুন। ১৬ জুন ডিপোর ভেতর ট্রায়াল ট্র্যাকে (পরীক্ষামূলক চলাচল) মেট্রোরেল চালানো হয়েছে।

আগস্টে ডিপোর বাইরে উত্তরা থেকে পল্লবী পর্যন্ত মেট্রোরেলের পরীক্ষামূলক চলাচল শুরু হবে। এটাকে ইন্টারফেস টেস্ট বলা হচ্ছে। এর মাধ্যমে ট্রেনের সঙ্গে রেললাইন, বিদ্যুৎ ও সংকেত ব্যবস্থাসহ সবকিছুর সমন্বয় পরীক্ষা করা হবে। এই পরীক্ষা শেষ হতে ছয় মাস লাগতে পারে।

এরপর শুরু হবে আরেক ধাপের পরীক্ষামূলক চলাচল (ট্রায়াল রান)। প্রথমে উত্তরা থেকে পল্লবী, পরে আগারগাঁও পর্যন্ত তা চলবে। যাত্রীসহ বাণিজ্যিকভাবে চলাচলের সময় যে গতিতে এবং যেসব নিয়ম মেনে চলাচল করার কথা, ঠিক সেভাবে ট্রায়াল রান হবে। পার্থক্য শুধু যাত্রী থাকবে না। এভাবে চলাচল করবে আরও ছয় মাস।

ট্রেন চালাতে যা দরকার

মেট্রোরেল চালাতে ১৭-১৮টি ব্যবস্থা সমন্বিতভাবে কাজ করবে। এর মধ্যে মোটা দাগে যেসব কাজ সম্পন্ন হওয়া দরকার সেগুলো হলো উত্তরা ডিপোর অবকাঠামো নির্মাণ, বৈদ‌্যু‌তিক ব্যবস্থা স্থাপন, যন্ত্রপাতি বসানো ও সৌন্দর্যবর্ধন। প্রকল্পের অগ্রগতি প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত মে পর্যন্ত এসব কাজের অগ্রগতি ৯০ শতাংশ।

এরপর দরকার উড়ালপথ (ভায়াডাক্ট) ও স্টেশন। সব মিলিয়ে ২০ দশমিক ১০ কিলোমিটার উড়ালপথের মধ্যে ১৫ কিলোমিটার নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্যে মে মাস পর্যন্ত উত্তরা থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার রেললাইন বসেছে।

পাঁচটি স্টেশনের ভৌতকাজও প্রায় শেষ। বাকি ১১টি স্টেশনের কাজ বিভিন্ন পর্যায়ে চলমান আছে। এর বাইরে প্রতিটি স্টেশনের সঙ্গে বিদ্যুৎ-ব্যবস্থা স্থাপন, লিফট ও চলন্ত সিঁড়ি বসানো, স্বয়ংক্রিয় ভাড়া আদায় ব্যবস্থাপনা, টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থার কাজও চলমান।

বিদ্যুচ্চালিত এই ট্রেনের জন্য লাইনের দুই পাশে খুঁটি বসানো ও ওপরে তার টানা হচ্ছে। সাড়ে ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত খুঁটি বসানো হয়েছে এবং তার টানানো হয়েছে ৮ কিলোমিটার।

যাত্রীরা যেভাবে ট্রেনে চড়বে

ট্রেনে ওঠার একমাত্র পথ স্টেশন ভবন। স্টেশনগুলো তিনতলা। সড়ক থেকে লিফট, এস্কেলেটর ও সিঁড়ি দিয়ে যাত্রীরা দ্বিতীয় তলার কনকোর্স হলে উঠবে। এই তলায় টিকিট কাটার ব্যবস্থা, অফিস ও নানা যন্ত্রপাতি থাকবে। তিনতলায় রেললাইন ও প্ল্যাটফর্ম। একমাত্র টিকিটধারীরাই ওই তলায় যেতে পারবে। দুর্ঘটনা এড়াতে ট্রেনের লাইনের পাশে বেড়া থাকবে। স্টেশনে ট্রেন থামার পর বেড়া এবং ট্রেনের দরজা একসঙ্গে খুলে যাবে। আবার নির্দিষ্ট সময় পর তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হবে।

মেট্রোরেলের ট্রেন প্রতিটি স্টেশন থেকে পাঁচ মিনিট পরপর ছাড়বে। এক ট্রেনের সঙ্গে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রাখার কাজটি কেন্দ্রীয়ভাবে কম্পিউটারের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হবে। নিরাপত্তা নিশ্চিত না হ‌লে বা লাইনে কোনো বাধা থাক‌লে ট্রেন স্বয়ংক্রিয়ভাবে থেমে যাবে।

ট্রেনে যা যা থাকছে

প্রকল্প সূত্র বলছে, একটি ট্রেনের দুই প্রান্তের দুটি কোচকে বলা হচ্ছে ট্রেইলর কার। এতে চালক থাকবেন। এসব কোচে ৪৮ জন করে যাত্রী বসতে পারবে। মাঝখানের চারটি কোচ হচ্ছে মোটরকার। এতে বসার ব্যবস্থা আছে ৫৪ জনের। সব মিলিয়ে একটি ট্রেনে বসে যেতে পারবে ৩০৬ জন। প্রতিটি কোচ সাড়ে ৯ ফুট চওড়া। মাঝখানের প্রশস্ত জায়গায় যাত্রীরা দাঁড়িয়ে ভ্রমণ করবে। দাঁড়ানো যাত্রীদের ধরার জন্য ওপরে হাতল এবং স্থানে স্থানে খুঁটি আছে। সব মিলিয়ে একটি ট্রেনে বসে এবং দাঁড়িয়ে মিলিয়ে সর্বোচ্চ ২ হাজার ৩০৮ জন যাত্রী চড়তে পারবে। সম্পূর্ণ শীতাতপনিয়ন্ত্রিত (এসি) এই ট্রেনের দুই পাশে সবুজ রঙের প্লাস্টিকের দুই সারি লম্বা আসন পাতা হয়েছে।

প্রতিটি কোচের দুই পাশে চারটি করে আটটি দরজা আছে। অর্থাৎ ট্রেন স্টেশনে থামলে চারটি দরজা একসঙ্গে খুলে যাবে। বাকি চারটি বন্ধ থাকবে। পরবর্তী গন্তব্য সম্পর্কে থাকবে অডিও-ভিজুয়াল ঘোষণা। দুই প্রান্তের দুটি কোচে দুটি করে চারটি হুইলচেয়ার বসানোর ব্যবস্থা আছে।

প্রতিটি ট্রেনের সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ১১০ কিলোমিটার। তবে ট্রেন কোন স্থানে কত গতিতে চলবে, সেটা ঠিক করবে কর্তৃপক্ষ।

ট্রেনের নকশা প্রণয়ন ও তৈরির কাজ করছে জাপানের কাওয়াসাকি-মিতসুবিশি কনসোর্টিয়াম। তারা ট্রেন তৈরির কাজ শুরু করেছে ২০১৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর।

গ্রিড বিপর্যয় হলেও ট্রেন বন্ধ হবে না

প্রকল্পের নথি অনুসারে, মেট্রোরেল চলাচলের জন্য নিজস্ব বিদ্যুৎ-ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এর জন্য উত্তরার ডিপোতে এবং মতিঝিলে দুটি সাবস্টেশন থাকছে। উত্তরার সাবস্টেশন চালু হয়েছে, মতিঝিলে কাজ চলমান আছে।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতিটি সাবস্টেশনে দুটি ট্রান্সফরমার থাকবে। একটি বিদ্যুৎ সরবরাহ করবে এবং অন্যটি জরুরি প্রয়োজনে চালু হবে। অর্থাৎ কোথাও বিদ্যুৎ বিভ্রাট হলেও ট্রেন চলাচল বন্ধ হবে না। জাতীয় গ্রিড বিপর্যয় হলেও ব্যাটারির মাধ্যমে চলমান ট্রেনগুলো নিকটবর্তী স্টেশনে পৌঁছাতে পারবে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সামছুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকার যানজট নিরসনে এখন মেট্রোরেল ছাড়া আর বিকল্প নেই। তাই যত দ্রুত চালু হবে, ততই মানুষ উপকৃত হবে। মানুষ মেট্রোরেলের জন্য অধীর অপেক্ষায় আছে।

সামছুল হক আরও বলেন, নির্মাণের মতো মেট্রোরেলের পরিচালনা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সরকার নিজে চালাবে নাকি বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় চলবে—এখনই তা ঠিক করতে হবে। তিনি মনে করেন, উত্তরা থেকে আগারগাঁও অংশ আগে চালু করা হলে ভালোই হবে। এতে অভিজ্ঞতা তৈরি হবে। বাকি অংশ চালাতে গিয়ে কোনো সমস্যা হবে না।