রঙিন ফুলের শহীদ মিনার, অপেক্ষা স্বীকৃতির
দূর থেকে দেখে মনে হবে সারি সারি রংবেরঙের ফুল সাজানো, যেন চারপাশ রঙিন করে ফুলের মেলা বসেছে। তবে কাছে গেলেই বোঝা যায়, রঙিন ফুলে বানানো হয়েছে শহীদ মিনারের প্রতিকৃতি। মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে কৃতজ্ঞচিত্তে ভাষাশহীদদের স্মরণ করতে বানানো হয়েছে ফুলের এই শহীদবেদি। এটি দেখতে প্রতিদিন ভিড় করছে অসংখ্য মানুষ।
ফুল দিয়ে বানানো শহীদ মিনারের এ প্রতিকৃতির দেখা মিলবে রাজধানীর গুলশানের বেরাইদে, ঠিকানা রিসোর্টে। জাপানি ফুল পিটুনিয়া দিয়ে বানানো শহীদ মিনারের প্রতিকৃতিটির দৈর্ঘ্য ২২০ ফুট ও প্রস্থ ৩৪ ফুট। কাঠ ও বাঁশের কাঠামোর ওপর শহীদ মিনারটি বানাতে ১২ হাজার টব ব্যবহার করা হয়েছে। একেকটি টবে সাদা-লাল-নীলসহ নানান রঙের পিটুনিয়া ফুল রয়েছে। একেকটি টবে রয়েছে প্রায় ২০টি করে ফুল।
শহীদ মিনার বানানোর মূল পরিকল্পনাকারী আফরিন তাইয়্যেবা আলিফ। বেসরকারি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এ শিক্ষার্থী পেশায় তরুণ উদ্যোক্তা। পছন্দ করেন প্রকৃতি নিয়ে কাজ করতে। আফরিন তাইয়্যেবা প্রথম আলোকে বলেন, ‘ফেব্রুয়ারি মাসে ইতিহাসের সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু একটা বানাতে চেয়েছিলাম। এ ভাবনা থেকেই ফুল দিয়ে শহীদ মিনারের প্রতিকৃতি বানানোর চিন্তা মাথায় আসে।’
পিটুনিয়া ফুলের বীজ আনা হয়েছিল জাপান থেকে। এরপর তা টবে লাগানো হয়। রঙিন পিটুনিয়া ফুটলে ১২ হাজার টব একের পর এক সাজিয়ে শহীদ মিনারের এ প্রতিকৃতি বানানো হয়। বীজ বপন, গাছ গজানো, ফুল ফোটা থেকে শুরু করে টব সাজিয়ে শহীদ মিনার বানানো—পুরো প্রক্রিয়া শেষ করতে ছয় মাস লেগেছে বলে জানান আফরিন তাইয়্যেবা। তিনি বলেন, ‘ফুলগুলো এপ্রিল মাস পর্যন্ত তাজা থাকবে।’
আফরিন তাইয়্যেবার এ উদ্যোগ এখন বিশ্ব রেকর্ডের আশা করছে। এ বিষয়ে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখি ফুল দিয়ে এমন শহীদ মিনারের প্রতিকৃতি এর আগে কোথাও বানানো হয়নি। তখনই বিশ্ব রেকর্ড গড়ার চিন্তা মাথায় আসে। এ জন্য ৮ ফেব্রুয়ারি গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের স্বীকৃতি পেতে আনুষ্ঠানিক আবেদন করা হয়েছে। আবেদনটি যাচাই–বাছাই করছে গিনেস কর্তৃপক্ষ। চূড়ান্ত ফলাফল জানতে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
ইতিমধ্যে মানুষের নজর কেড়েছে ফুলের এ শহীদ মিনার। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ ঠিকানায় ভিড় করছে এটি একনজর দেখার জন্য। ছবি তুলছে রঙিন এ শহীদ মিনারের সামনে দাঁড়িয়ে। ফুল দিয়ে বানানো এ শহীদ মিনার দেখতে গতকাল রোববার ঠিকানায় এসেছিলেন কাজী মহীউদ্দিন ও আনজুমান আরা বেগম। একসময় শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত ছিলেন এ দম্পতি। এখন অবসরজীবন কাটাচ্ছেন। ফুলের শহীদ মিনারটি পেছনে রেখে সেলফি তুলছিলেন। বলেন, ‘তরুণ প্রজন্মের এক নারী উদ্যোক্তার এ ভাবনা অভিভূত করেছে। এমন তরুণদের হাত ধরেই বাংলাদেশের গর্বের ইতিহাস বিশ্বের মানুষের কাছে পৌঁছে যাবে।’
আফরিন তাইয়্যেবা জানান, ঢাকায় নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি ঠিকানায় এসে ফুল দিয়ে বানানো শহীদ মিনারের প্রতিকৃতি দেখে গেছেন। তিনি এ কর্ম দেখে অভিভূত।
ফেব্রুয়ারি মাসে ইতিহাসের সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু একটা বানাতে চেয়েছিলাম। এ ভাবনা থেকেই ফুল দিয়ে শহীদ মিনারের প্রতিকৃতি বানানোর চিন্তা মাথায় আসে।
এখানকার ফুলের বাগান ভ্রমণপিপাসুদের মনোযোগ কাড়তে সক্ষম হয়েছে। আফরিন তাইয়্যেবা বলছিলেন, প্রথমে টিন ও কাঠ দিয়ে একটি বাড়ি তৈরি করা হয়েছিল। পরিবারের সদস্য ও বন্ধুবান্ধব নিয়ে অবসর সময় কাটাবেন—এমন ভাবনা থেকেই গড়ে ওঠে ঐতিহ্যবাহী নকশার এ বাড়ি (ঠিকানা)। বাড়িটি ঘিরে লাগানো হয় দেশি-বিদেশি ফুলের গাছ। গড়া হয় বাগান। রঙিন ফুলে বাগান ভরে উঠলে বন্ধু ও স্বজনের গণ্ডি পেরিয়ে সাধারণ মানুষও এখানে আসতে শুরু করে।
ফুল দেখতে আসার পাশাপাশি এখানে সময় কাটাতে আগ্রহ দেখাতে শুরু করে মানুষ। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাড়িটির পরিধি বাড়ানো হয়। বাড়িটির পাশে কাঠের পাটাতনের বিশাল জায়গা ফুল দিয়ে সাজানো হয়। এ অংশের নাম দেওয়া হয় ‘খোলা আকাশ’। এই খোলা আকাশের একটি অংশেই ফুলের শহীদ মিনারের প্রতিকৃতি বানানো হয়েছে। পুরো ঠিকানা ও খোলা আকাশ জায়গাটিকে প্রায় সাত লাখ ফুল দিয়ে সাজিয়েছেন আফরিন তাইয়্যেবা।
আফরিন তাইয়্যেবার মা আফরোজা বেগম নিজেও একজন উদ্যোক্তা। খানস কিচেন পরিচালনা করেন তিনি। তাঁর বাবা আলিফ খান খানস কিচেন ও ঠিকানা—দুটো উদ্যোগেরই সার্বিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব সামলান। মায়ের উৎসাহে উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখেন আফরিন তাইয়্যেবা। এ স্বপ্ন বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে ২০১৮ সালে তাঁর হাত ধরে যাত্রা শুরু করে ঠিকানা।
গত বছর পর্যন্ত ফুল দিয়ে সাজানো ঠিকানায় বিনা মূল্যে প্রবেশের সুযোগ ছিল। যে কেউ এখানে এসে ছবি তুলে সময় কাটাতে পারত। দর্শনার্থীর চাপ বেড়ে যাওয়ায় চলতি বছর ৩০০ টাকা প্রবেশমূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে এখান থেকে খাবার কিনে খেলে প্রবেশমূল্য দিতে হবে না। বাইরের খাবার সঙ্গে নিয়ে প্রবেশের সুযোগ নেই।