রাসায়নিকের গুদাম ১৯২৪টি, ৯৮ শতাংশই ঝুঁকিপূর্ণ

একদিকে মানুষ মরছে, অন্যদিকে ব্যবসা চলছে। ঝুঁকির কথা সবাই জানে। ব্যবস্থাই নেওয়া হয় না।

পুরান ঢাকায় রাসায়নিকের গুদাম
ফাইল ছবি

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এলাকায় জরিপ চালিয়ে রাসায়নিকের ১ হাজার ৯২৪টি পাইকারি ও খুচরা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পেয়েছে করপোরেশন কর্তৃপক্ষ। রাসায়নিক রাখা এসব স্থাপনা বা গুদামের সবই কমবেশি ঝুঁকিপূর্ণ বলে উঠে এসেছে জরিপে।

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশনায় গত ডিসেম্বরে দক্ষিণ সিটি, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর, বিস্ফোরক পরিদপ্তর এবং দুটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধিরা মিলে এই জরিপ করেন। দক্ষিণ সিটির কর্মকর্তারা জানান, তালিকা তৈরি শেষ করে মার্চের প্রথম সপ্তাহেই তা বিস্ফোরক পরিদপ্তরের কাছে দেওয়া হয়।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, রাসায়নিক গুদাম ও এর ঝুঁকির বিষয়টি সবারই জানা। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এর মধ্যে ২৩ এপ্রিল পুরান ঢাকার আরমানিটোলার হাজি মুসা ম্যানশন নামের একটি ভবনে রাসায়নিকের গুদামে আগুন লেগে মোট ছয়জনের মৃত্যু হয়। গত বুধবার রাতে মারা যান আশিকুজ্জামান নামের এক তরুণ। তাঁর স্ত্রী ইসরাত জাহানও হাসপাতালে সংকটাপন্ন অবস্থায় চিকিৎসাধীন।

বিস্ফোরক পরিদপ্তর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে। তারা কেন রাসায়নিকের ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনা সরাতে ব্যবস্থা নেয় না জানতে এ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ প্রথম আলোকে বলেন, অধিকাংশ রাসায়নিক ব্যবসায়ী বিস্ফোরক পরিদপ্তরের অনুমোদন নেয় না। মাঝেমধ্যে অভিযান চালিয়ে বন্ধ করা হয়, আবার চালু হয়। তিনি বলেন, আবাসিক এলাকায় কোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানই তো থাকার কথা নয়। এটি বন্ধে সরকারের শক্ত পদক্ষেপ দরকার।

দক্ষিণ সিটির জরিপে উঠে আসে, ১ হাজার ৯২৪টি গুদামের ৯৮ শতাংশে ঝুঁকির মাত্রা মধ্যম পর্যায়ের। দেড় শতাংশে ঝুঁকির মাত্রা কম। আর বাকি আধা শতাংশ অতি ঝুঁকিপূর্ণ। অ্যাসিড নিয়ন্ত্রণ আইন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ও বিস্ফোরক পরিদপ্তরের তালিকাভুক্ত ৩৬টি রাসায়নিক যেসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে মজুত ও বিক্রি করা হয়, সেসব গুদাম বা দোকানকে ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় রাখা হয়। আরমানিটোলার যে ভবনে আগুন লাগে, সেখানে রাসায়নিকের মজুত ছিল। সেগুলো পুড়ে বিষাক্ত ধোঁয়া তৈরি হয়। চিকিৎসকেরা বলছেন, মুসা ম্যানশনের ঘটনায় ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে মূলত ধোঁয়ার কারণে।

দক্ষিণ সিটির জরিপে উঠে আসা তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, পুরান ঢাকার ইসলামবাগ, আরমানিটোলা, মিটফোর্ড, চকবাজার, মৌলভীবাজার, বেগমবাজার, তাঁতীবাজার এলাকায় রাসায়নিকের গুদাম ও দোকান রয়েছে। জরিপকালে একেকটি গুদামে সর্বনিম্ন ২০০ কেজি থেকে সর্বোচ্চ ৮০ হাজার কেজি রাসায়নিক মজুত পাওয়া যায়।

‘আমাদের তো হাত বাঁধা’

অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি নিয়ে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চলছে কীভাবে এবং কেন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না, জানতে চাইলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সিটি করপোরেশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নিজেদের অসহায়ত্বের কথা বলছেন। দক্ষিণ সিটির ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শেখ মো. আলমগীর বলেন, ‘আমাদের তো হাত বাঁধা। ব্যবসায়ীদের কাছে লাইসেন্স আর ব্যবসার বৈধতা দেখতে চাইলেও বলবে, আমি চাঁদা না পেয়ে এগুলো করছি।’

হঠাৎ অভিযান চালিয়ে রাসায়নিকের ব্যবসা বন্ধ করে দিলে দেশের বিভিন্ন শিল্প খাতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে দাবি করেন ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, স্থানান্তরের আগপর্যন্ত ব্যবসায়ীরা কীভাবে পুরান ঢাকায় ঝুঁকি এড়িয়ে ব্যবসা করবেন, তার কৌশল নির্ধারণে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি কাজ করছে।

অবশ্য রাসায়নিক গুদাম সরিয়ে নেওয়ার এই আলোচনা আজকের নয়। দুই দশক ধরে বিষয়টি নিয়ে সরকারিভাবে কথাবার্তা হচ্ছে। ২০১০ সালে পুরান ঢাকার নিমতলীতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১২৪ জনের মৃত্যুর পর রাসায়নিকের ব্যবসা সরিয়ে নেওয়ার বিষয়টি ব্যাপক জোর পায়। শিল্প মন্ত্রণালয় রাসায়নিকের ব্যবসা পরিকল্পিত এলাকায় সরিয়ে নিতে রাসায়নিক পল্লি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়। এক দশক পেরিয়ে গেলেও রাসায়নিক পল্লির মাটি ভরাটের কাজ শুরু হয়নি।

নিমতলীর ঘটনার ৯ বছর পর ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চকবাজারের চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডে ৭১ জনের মৃত্যু হয়। তখন দ্রুত রাসায়নিক ব্যবসা সরিয়ে নিতে অস্থায়ী গুদাম তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়। শিল্প মন্ত্রণালয় এখনো সেই গুদাম তৈরির কাজ শেষ করতে পারেনি।

শুধু রাসায়নিক পল্লি নয়, নিমতলী ও চুড়িহাট্টার ঘটনায় কারও বিচার এখনো হয়নি। চুড়িহাট্টার আগুনের ঘটনায় দুটি মামলা হয়েছিল, তদন্ত দুই বছরেও শেষ হয়নি। নিমতলীর ঘটনায় শুধু সাধারণ ডায়েরি হয়েছিল, পুলিশ তদন্তও করেনি।

লাইসেন্স বন্ধ, ব্যবসা চলছে

দক্ষিণ সিটি করপোরেশন রাসায়নিক ব্যবসার জন্য নতুন ট্রেড লাইসেন্স দেওয়া ও লাইসেন্স নবায়ন বন্ধ রেখেছে। সংস্থাটি বলছে, ২০১৯ সালের পর আর কোনো লাইসেন্স দেওয়া হয়নি।

অবশ্য ব্যবসা ঠিকই চলছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বৈধ প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি অসংখ্য অবৈধ প্রতিষ্ঠানও পুরান ঢাকায় ব্যবসা করছে। তারা গোপনে বিপজ্জনক ও দাহ্য পদার্থ মজুত ও বিক্রি করে। এ বিষয়ে রাসায়নিক ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ কেমিক্যাল অ্যান্ড পারফিউমারি মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা এনায়েত হোসেন বলেন, বেশি মুনাফার আশায় অনেকেই বিপজ্জনক রাসায়নিক বিক্রি করে থাকেন। তাঁরা ব্যবসায়ী সংগঠনের তোয়াক্কা করেন না।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, পুরান ঢাকায় রাসায়নিকের বেশির ভাগ দোকান ও গুদাম আবাসিক ভবনে। রাসায়নিকের কোনটি বিপজ্জনক, কোনগুলো দাহ্য, তা ভবনের বাসিন্দাদের জানার উপায় নেই। আরমানিটোলা সমাজকল্যাণ সংসদের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের সব সংস্থার গাফিলতিতে পুরান ঢাকার এই পরিণতি।

আরমানিটোলায় আগের রূপ

আরমানিটোলায় ২৩ এপ্রিল ভোররাতে মুসা ম্যানশনে যখন আগুন লাগে, তখন স্থানীয় বাসিন্দারা সাহ্রির প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কিন্তু মানুষের আর্তচিৎকার শুনে অনেকেই উদ্ধার অভিযানে ঝাঁপিয়ে পড়েন। স্বজন হারানো পরিবারগুলো শোক কাটিয়ে উঠতে পারেনি। অগ্নিদগ্ধদের চিকিৎসার সবচেয়ে বড় হাসপাতাল শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে এখনো চিকিৎসাধীন ২০ জনের মতো।

অবশ্য আরমানিটোলার ব্যবসায়ীরা ঘটনার দুই দিন পর থেকে আগের মতোই দোকান খুলে ব্যবসা শুরু করেছেন। এই ঝুঁকির ব্যবসা পুরান ঢাকা থেকে কবে সরবে, কেউ জানে না। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) এক সংবাদ সম্মেলনে গতকাল বৃহস্পতিবার সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, নিমতলী, চুড়িহাট্টা ও আরমানিটোলার অগ্নিকাণ্ডগুলো দুর্ঘটনা নয়। ব্যবসায়ী ও বাড়ির মালিকদের অতি মুনাফার প্রবণতা এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার সম্মিলিত ফলাফল।