রাসায়নিক পল্লির মাটি ভরাটই শুরু হয়নি

২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নবাব কাটারার নিমতলীতে ভয়াবহ আগুনে ১২৪ জন মানুষ মারা যান।
প্রথম আলো ফাইল ছবি

২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নবাব কাটারার নিমতলীতে ভয়াবহ আগুনে ১২৪ জন মানুষ মারা যান। এরপর পেরিয়েছে ১০ বছরের বেশি সময়। কিন্তু রাসায়নিকের গুদাম সরিয়ে নিতে পল্লি প্রতিষ্ঠার প্রকল্পে মাটি ভরাটই শুরু হয়নি।

পল্লি প্রতিষ্ঠার আগে রাসায়নিকের ব্যবসা অস্থায়ী গুদামে সরিয়ে নেওয়ার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, তা-ও বাস্তবায়ন শেষ হয়নি। এরই মধ্যে গত শুক্রবার ভোররাতে পুরান ঢাকার আরমানিটোলায় আগুনে মারা গেলেন ৪ জন। হাসপাতালে ভর্তি আছেন ২০ জন, যাঁদের কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।

ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাসায়নিক পল্লি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল নিমতলীর আগুনের পরপরই। তবে ২০১৯ সাল পর্যন্ত শুধু প্রকল্প অনুমোদন পেয়েছিল, যার ব্যয় ধরা হয়েছিল ২০২ কোটি টাকা। জমির পরিমাণ ছিল ৫০ একর।

এর মধ্যে ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চকবাজারের চুড়িহাট্টার ওয়াহেদ ম্যানশন নামের একটি ভবনে আগুনে মারা যান ৭১ জন। এরপর আগের পরিকল্পনা বাতিল করে মুন্সিগঞ্জের ৩১০ একর জমিতে রাসায়নিক শিল্পপল্লি প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত হয়।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের মধ্যে এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হওয়ার কথা। ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা। বিসিক জানিয়েছে, প্রকল্পের জমিতে স্থান ভরাটের কাজ এখনো শুরু হয়নি। সেটি শেষ হলে অবকাঠামো ও কারখানা স্থাপনের কাজ শুরু হবে।

রাসায়নিক পল্লি প্রকল্প পরিচালক সাইফুল আলম আজ শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, মাটি ভরাটের জন্য ৪ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ ডকইয়ার্ড নামের একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। তাদের ১৩ এপ্রিল জায়গা বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে।

সাইফুল আলম বলেন, জমিতে বালু ফেলার জন্য পাইপ বসানোর কাজ চলছে। ছয় মাসের মধ্যে ভরাটকাজ শেষ করার লক্ষ্য রয়েছে। এরপর আরও ছয় মাস লাগবে রাস্তা, ড্রেন ও কালভার্ট তৈরিতে। রাসায়নিক গুদাম ও কারখানার মালিকদের আগামী বছরের জুনে প্রায় ২ হাজার ২০০ প্লট বুঝিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে।

অস্থায়ী গুদামও হয়নি

চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ডের পর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তখনকার মেয়র সাঈদ খোকন বলেছিলেন, গুদাম ও দোকান সরিয়ে ফেলা হবে মার্চে (২০১৯), মানে হলো এক মাসের মধ্যে। শিল্প মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেও রাসায়নিক ব্যবসা দ্রুত সরিয়ে নিতে পল্লি ও অস্থায়ী গুদাম নির্মাণের কথা বলা হয়েছিল।

এরপর কিছু গুদাম টঙ্গীর কাঁঠালদিয়া ও ঢাকার শ্যামপুরের বন্ধ হয়ে যাওয়া উজালা ম্যাচ ফ্যাক্টরির জমিতে অস্থায়ী ভিত্তিতে সরানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু এখনো কোনো রাসায়নিক প্রতিষ্ঠানের হাতে একটি গুদামও তুলে দেওয়া হয়নি। ব্যবসায়ীরা নিজেদের উদ্যোগে অল্প কিছু গুদাম বুড়িগঙ্গার ওপারে সরিয়ে নেন।

অস্থায়ী গুদাম প্রকল্প জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদন পায় ২০১৯ সালের জুনে। ব্যয় ধরা হয় ১৬৮ কোটি টাকা। উজালার জমিতে ৫৪টি ও টঙ্গীতে ৫৩টি গুদামের কাজ এখনো চলছে।

কাঁঠালদিয়ায় বিএসইসির জমিতে অবৈধ বস্তি ছিল বলে জানিয়েছেন রাসায়নিক গুদাম নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক জহিরুল হক। তিনি বলেন, জমি উদ্ধার করতেই বড় একটা সময় চলে যায়। মাঝে করোনা পরিস্থিতিতে কাজ ব্যাহত হয়।

জহিরুল হক আরও বলেন, ‘প্রথম ধাপে নির্মাণাধীন ৭টি গুদামের কাজ শেষ পর্যায়ে। ঈদুল ফিতরের পর উদ্বোধন হবে। দ্বিতীয় ধাপের বাকি ৪৬টির দরপত্র হয়ে গেছে। কাজ শুরু হবে জুন মাসে। ডিসেম্বরে শেষ হবে আশা করি।’

এদিকে বিসিআইসির হাতে থাকা উজালার জমিতে ৫৪টি গুদাম তৈরি কবে নাগাদ শেষ হবে, তা নির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না। এখানকার ‘অস্থায়ী ভিত্তিতে রাসায়নিক দ্রব্য সংরক্ষণের জন্য গুদাম নির্মাণ প্রকল্পের’ পরিচালক লিয়াকত আলী প্রথম আলোকে বলেন, এই মুহূর্তে ৩২টি গুদামের নির্মাণকাজ চলছে। এই ৩২টির মধ্যে ২৭টির ছাদ ঢালাই শেষ হয়েছে। বাকি আরও ২২টির বালু ভরাটের কাজ চলছে।

প্রকল্প পরিচালক বলেন, ৪ থেকে ৫ মাসের ভেতর কাজ শেষ করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে দ্রুত তাঁরা শেষ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

এদিকে পুরান ঢাকায় রাসায়নিক ব্যবসা চলছে; দোকান, গুদাম ও কারখানা রয়েছে। এমনকি অবস্থা মোটামুটি আগের মতোই। এর মধ্যেই ঝুঁকি নিয়ে বাস করছে মানুষ। সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোও রাসায়নিক সরানোর বিষয়টি নিয়ে আর উচ্চবাচ্য করছে না। চলে রুটিন কিছু অভিযান।

এখন প্রশ্ন উঠছে, আগামী বছরের জুনে যদি স্থায়ী রাসায়নিক পল্লির জমি বুঝিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে অস্থায়ী গুদামের জন্য ১৬৮ কোটি টাকা খরচের মানে কী? আর একটি রাসায়নিক পল্লি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়ার ১০ বছর পর মাটি ভরাটই শুরু না হওয়ার দায় কার?

বাংলাদেশ কেমিক্যাল অ্যান্ড পারফিউমারি অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা এনায়েত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা পুরান ঢাকা থেকে গুদাম সরিয়ে একটা ভালো ব্যবস্থায় যেতে চাই। কিন্তু সরকার তো জমি বুঝিয়ে দিতে পারেনি।’

তাহলে কি এভাবে ঝুঁকিপূর্ণভাবে ব্যবসা চলবে, আর দুর্ঘটনা ঘটতেই থাকবে, জানতে চাইলে এনায়েত হোসেন বলেন, সাভার-গাজীপুরসহ বিভিন্ন জায়গার বিপরীতে লাইসেন্স নিয়ে অনেকে পুরান ঢাকায় ব্যবসা করে। এটা বন্ধ করতে সরকারকেই তদারকি করতে হবে। আবাসিক ভবনে রাসায়নিক গুদাম ভাড়া দেওয়া বন্ধ করতে পারে সিটি করপোরেশন।