রাসায়নিক সরেনি, ঝুঁকিও কমেনি

অগ্নিকাণ্ডের পর রাসায়নিকের গুদাম সরাতে পুরান ঢাকায় অভিযান চালায় সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো
ফাইল ছবি

দুটি বড় অগ্নিকাণ্ড। তাতে ১৯৫ জনের মৃত্যু। প্রথমটির পর পেরিয়েছে ১০ বছরের বেশি, দ্বিতীয়টির পর কেটেছে দুই বছর। কিন্তু পুরান ঢাকার চিত্র খুব একটা বদলায়নি।

এখনো পুরান ঢাকায় রাসায়নিক ব্যবসা চলছে; দোকান, গুদাম ও কারখানা রয়েছে। এমনকি অবস্থা মোটামুটি আগের মতোই। এর মধ্যেই ঝুঁকি নিয়ে বাস করছে মানুষ। সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোও রাসায়নিক সরানোর বিষয়টি নিয়ে আর উচ্চবাচ্য করছে না। চলে রুটিন কিছু অভিযান।

পুরান ঢাকায় দুই বড় অগ্নিকাণ্ডের একটি নিমতলীর আগুন। ২০১০ সালের ৩ জুন রাতের সেই ঘটনায় ১২৪ জনের মৃত্যু হয়। ৯ বছর পর ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চকবাজারের চুড়িহাট্টার ওয়াহেদ ম্যানশন নামের একটি ভবনে আগুনে মারা যান ৭১ জন।

আজ শনিবার চুড়িহাট্টার আগুনের দুই বছর হলো। ওই ঘটনার পর সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর ব্যর্থতা সামনে আসে। দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা আবার প্রতিশ্রুতি দেন যে পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিক ব্যবসা রাসায়নিক পল্লিতে নিয়ে যাওয়া হবে। এর আগে দ্রুত রাসায়নিক সরিয়ে নিতে টঙ্গী ও শ্যামপুরে দুটি অস্থায়ী গুদাম করা হবে। দুই বছর পরের চিত্র এই যে রাসায়নিক পল্লির মাঠপর্যায়ের কাজ শুরু হয়নি। এমনকি অস্থায়ী গুদামের নির্মাণকাজও শেষ হয়নি।

মূল বিষয় গুদাম ও কারখানা সরানো। সেটি হয়নি। নিমতলীর পর রাসায়নিক সরিয়ে নিলে চুড়িহাট্টার আগুনে এত প্রাণহানি হতো না।
সুলতানা রাজিয়া, বুয়েটের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক

দুই বছরে পুরান ঢাকায় রাসায়নিকের ঝুঁকির ক্ষেত্রে কী উন্নতি হয়েছে, তা জানতে চাওয়া হয়েছিল ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার কাছে, যিনি চুড়িহাট্টা আগুন নেভানোর কাজে যুক্ত ছিলেন। দীর্ঘদিন ধরে পুরান ঢাকাকেন্দ্রিক দায়িত্ব পালনও করছেন। তিনি নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, আগে যেমন ছিল, এখনো তেমনই আছে। বড় আগুনের ঝুঁকিও কমেনি।

অন্যদিকে বিস্ফোরক পরিদপ্তরের প্রধান পরিদর্শক আবুল কালাম আজাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল পুরান ঢাকাকে কি নিরাপদ বলা যায়? জবাবে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘নিরাপদ বলার তো কোনো সুযোগ নেই। এখনো যে অবস্থা!’ তিনি বলেন, বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে প্রতিদিনই নজরদারি করা হচ্ছে। উন্নতি এটাই।

সরেজমিন
ওয়ারীর হাটখোলার নজরুল ইসলাম সড়কে রাসেল সেন্টারটি ১০ তলা আবাসিক ভবন। অবশ্য এর বেসমেন্ট থেকে চতুর্থ তলা পর্যন্ত রাসায়নিকের গুদাম ও দোকান রয়েছে। বাকি ছয়তলায় মানুষ বাস করে। ভ্রাম্যমাণ আদালত গত আগস্টে অভিযান চালিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিক পাওয়ায় ভবনটির কয়েকটি গুদাম সিলগালা করেন। চারটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিস্ফোরকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনসহ তিনটি আইনে আটটি মামলা করা হয়। এর মধ্যে ইয়াসিন সায়েন্টিফিক নামের একটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া বাকিরা গুদাম খুলে আবার ব্যবসা শুরু করেছে।

দুই বছরে পুরান ঢাকায় রাসায়নিকের ঝুঁকির ক্ষেত্রে কী উন্নতি হয়েছে, তা জানতে চাওয়া হয়েছিল ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার কাছে, যিনি চুড়িহাট্টা আগুন নেভানোর কাজে যুক্ত ছিলেন। দীর্ঘদিন ধরে পুরান ঢাকাকেন্দ্রিক দায়িত্ব পালনও করছেন। তিনি নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, আগে যেমন ছিল, এখনো তেমনই আছে। বড় আগুনের ঝুঁকিও কমেনি।

রাসেল সেন্টারে গত সোমবার গিয়ে পাওয়া যায় যমুনা সায়েন্টিফিক কোম্পানি নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক এইচ এম নূর মোহাম্মদকে। সম্প্রতি হাইকোর্টের অনুমোদন নিয়ে গুদাম খুলেছেন দাবি করে তিনি বলেন, জব্দ করা রাসায়নিক এখনো গুদামেই আছে।

রাসেল সেন্টারে অভিযানে ছিলেন বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের অতিরিক্ত প্রধান রসায়নবিদ মোহাম্মদ মহিউদ্দিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, রাসেল সেন্টারে পরিবারগুলো আসলে বিস্ফোরকের ওপর বসবাস করছিল। অভিযানে সেখানে অতিদাহ্য পদার্থ পাওয়া গিয়েছিল, যা আবাসিক এলাকায় রাখা নিষিদ্ধ। ভবনের নিচে রাখা আরও বিপজ্জনক।

ব্যবসায়ীদের দাবি, পুরান ঢাকায় এখন রাসায়নিক ব্যবসা করেন ১ হাজার ২০০ ব্যবসায়ী। রাসায়নিকের ধরন আছে প্রায় ৫ হাজার রকমের। এর মধ্যে কিছু রাসায়নিক অতিদাহ্য। এ ছাড়া ওই এলাকায় প্লাস্টিকের কারখানা ও গুদাম রয়েছে প্রায় ১ হাজার।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ডের পর ওয়াহেদ ম্যানশনের আশপাশের গুদামগুলো সরিয়ে ফেলা হয়েছে। কিন্তু মিটফোর্ড সড়ক, শরৎচন্দ্র চক্রবর্তী সড়ক, আরমানিয়ান স্ট্রিট, মাহুতটুলী সড়কে সরেজমিন ঘুরে সেখানে শিল্পকারখানায় ব্যবহৃত রাসায়নিকের দোকান ও গুদাম দেখা গেছে।

বাংলাদেশ কেমিক্যাল অ্যান্ড পারফিউমারি অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা এনায়েত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, অর্ধেকের বেশি গুদাম সরে গেছে। অনেকে হয়তো মনে করেন, রাসায়নিক সকালে নিয়ে এসে বিকেলে ক্রেতাকে সরবরাহ করবেন। সে জন্য তাঁরা গুদামে রাখেন।

রাসায়নিক পল্লির কাজই শুরু হয়নি
চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ডের পর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তখনকার মেয়র সাঈদ খোকন বলেছিলেন, গুদাম ও দোকান সরিয়ে ফেলা হবে মার্চে (২০১৯), মানে হলো এক মাসের মধ্যে। শিল্প মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেও রাসায়নিক ব্যবসা দ্রুত সরিয়ে নিতে পল্লি ও অস্থায়ী গুদাম নির্মাণের কথা বলা হয়েছিল।

এর আগে ২০০০ সালের দিকে পুরান ঢাকা থেকে সব রাসায়নিক গুদাম ও কারখানা সরিয়ে নেওয়ার বিষয়টি আলোচনায় আসে। তবে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। ২০১০ সালে নিমতলীতে ভয়াবহ আগুনের পর রাসায়নিক কারখানা ও গুদাম সরিয়ে নিতে রাসায়নিক পল্লি গড়ার সিদ্ধান্ত হয়। ২০১৯ সাল পর্যন্ত শুধু প্রকল্প অনুমোদন পেয়েছিল, যার ব্যয় ধরা হয়েছিল ২০২ কোটি টাকা। জমির পরিমাণ ছিল ৫০ একর।

অবশ্য ২০১৯ সালে মুন্সিগঞ্জের ৩১০ একর জমিতে রাসায়নিক শিল্পপল্লি প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত হয়। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের মধ্যে এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হওয়ার কথা। ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা।

বিসিক জানিয়েছে, প্রকল্পের জমিতে মাটি ভরাটের কাজ এখনো শুরু হয়নি। মাটি ভরাট শেষ হলে অবকাঠামো ও কারখানা স্থাপনের কাজ শুরু হবে। প্রকল্প পরিচালক সাইফুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে অধিগ্রহণ করা জমি বুঝে পেয়েছি। মাটি ভরাটের দরপত্র হয়েছে।’ তিনি দাবি করেন, ছয় মাসের মধ্যে মাটি ভরাট হয়ে যাবে। আগামী বছরের জুনে ব্যবসায়ীদের প্লট বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে বিসিক।

অস্থায়ী গুদাম হলো না দুই বছরেও
স্থায়ী রাসায়নিক পল্লি প্রতিষ্ঠার আগে পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিক সরিয়ে নিতে ২০১৯ সালে অস্থায়ীভাবে গুদাম তৈরির সিদ্ধান্ত নেয় শিল্প মন্ত্রণালয়। প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করে তা অনুমোদন পেতে লেগে যায় ওই বছরের জুন পর্যন্ত। ওই মাসে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অস্থায়ী গুদাম নির্মাণের প্রকল্প অনুমোদন দেয় সরকার। ব্যয় ধরা হয় ১৬৮ কোটি টাকা।
কথা ছিল, পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিকের কিছু গুদাম টঙ্গীর কাঁঠালদিয়ায় বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল করপোরেশনের (বিএসইসি) ছয় একর জমিতে যাবে। আর কিছু যাবে ঢাকার শ্যামপুরের বন্ধ হয়ে যাওয়া উজালা ম্যাচ ফ্যাক্টরির জমিতে, যেটির মালিক বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি)।

বিএসইসি ও বিসিআইসি জানিয়েছে, উজালার জমিতে গুদাম তৈরি শেষ হতে আগামী জুন পর্যন্ত সময় লাগবে। এতে যেতে পারবে ৫৪টি প্রতিষ্ঠানের গুদাম। টঙ্গীতে যেতে পারবে ৫৩টি গুদাম। এটিতে পুরো কাজ শেষ হতে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় লাগবে।

এখনো পুরান ঢাকায় রাসায়নিক ব্যবসা চলছে; দোকান, গুদাম ও কারখানা রয়েছে। এমনকি অবস্থা মোটামুটি আগের মতোই। এর মধ্যেই ঝুঁকি নিয়ে বাস করছে মানুষ। সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোও রাসায়নিক সরানোর বিষয়টি নিয়ে আর উচ্চবাচ্য করছে না। চলে রুটিন কিছু অভিযান।

কাঁঠালদিয়ায় বিএসইসির জমিতে মঙ্গলবার গিয়ে দেখা যায়, যে জায়গায় গুদাম নির্মাণের কথা, সেখানে আর আগের মতো বস্তিঘর বা দোকানপাট নেই। ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। তবে এক পাশে কিছু বস্তিঘর বা দোকানপাট রয়েছে। বিএসইসির গুদাম নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক মো. মনিরুজ্জামান খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘জমিতে অবৈধ বস্তি ছিল। তার ৮০ ভাগ উচ্ছেদ হয়েছে। প্রথমে সাতটি গোডাউনের কাজ শুরু করেছি, যা মার্চে শেষ হবে। বাকি কাজ এ বছরের ডিসেম্বরে শেষ হবে।’

এদিকে অস্থায়ী গুদাম নিয়ে ব্যবসায়ীদের আপত্তি রয়েছে। তাঁরা বলছেন, রাসায়নিক পল্লির জমি যদি আগামী বছরের জুনে পাওয়া যায়, তাহলে আর অস্থায়ীর দরকার কী? তা ছাড়া অস্থায়ী ব্যবস্থা সীমিত পর্যায়ের। তা দিয়ে পুরান ঢাকার রাসায়নিক ব্যবসার সামান্য অংশ সরানো যাবে।

বাংলাদেশ কেমিক্যাল অ্যান্ড পারফিউমারি অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা এনায়েত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, অস্থায়ী গুদাম বাস্তবসম্মত হবে না। যেহেতু ইতিমধ্যে চুড়িহাট্টা অগ্নিকাণ্ডের দুই বছর হয়ে গেছে, সেহেতু কোথাও অস্থায়ীভাবে না যাওয়াই ভালো।

‘মূল কাজটি হয়নি’
চুড়িহাট্টার ঘটনার পর দুই বছরে পুরান ঢাকায় ঝুঁকি দূর না হলেও রূপ বদলেছে ওয়াহেদ ম্যানশনের, যেটিতে আগুন লেগে ঝরে গিয়েছিল অনেকগুলো তাজা প্রাণ। গত বুধবার সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ওয়াহেদ ম্যানশনের ভেতর ও বাইরের দেয়াল সদ্য পলেস্তারা করা। নিচতলার দোকানগুলোর শাটারে নতুন রং। জানা গেল, আগুনের পর দোকানগুলো সংস্কার করা হয়েছে। এখন ভাড়া দেওয়ার অপেক্ষায়।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক সুলতানা রাজিয়া ২০১০ সালে নিমতলীর অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটিকে দেওয়া বিশেষজ্ঞ মতামতে দ্রুত অতিদাহ্য রাসায়নিকের গুদাম ও কারখানা সরানোর সুপারিশ করেছিলেন। সুপারিশ বাস্তবায়িত হলে বড় অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি কমে যাবে উল্লেখ করে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মূল বিষয় গুদাম ও কারখানা সরানো। সেটি হয়নি। নিমতলীর পর রাসায়নিক সরিয়ে নিলে চুড়িহাট্টার আগুনে এত প্রাণহানি হতো না।

[প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন প্রতিনিধি, টঙ্গী]