রায় শুনতে সিনহার মা কক্সবাজারে

মা নাসিমা আক্তারের সঙ্গে সিনহা
ছবি: সংগৃহীত

সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলার রায় আজ সোমবার। কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ ইসমাইলের এই রায় ঘোষণা করার কথা রয়েছে। ছেলের হত্যার রায় শুনতে সিনহার মা নাসিমা আক্তার গেছেন কক্সবাজার।

প্রথম আলোকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন মামলার বাদী ও সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস। তিনি দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ভাই সিনহা হত্যা মামলায় রায় শুনতে সকালে মাকে নিয়ে আমরা উত্তরার বাসা থেকে রওনা হই। এখন আমরা কক্সবাজারে।’

সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানের বাড়ি। উত্তরা, ঢাকা, ৩১ জানুয়ারি
ছবি: আসাদুজ্জামান

উত্তরার ১৪ নম্বর সেক্টরে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানের বাসা। বাসার প্রবেশপথে সিনহার ছবিযুক্ত একটি ব্যানার টাঙানো। তাতে লেখা আছে, ‘মেজর (অব.) সিনহা হত্যার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।’

বাসার গৃহকর্মী মোমেনা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ম্যাডাম, শারমিন আপারা, সবাই রায় শুনতে কক্সবাজার গেছেন।’

এদিকে কক্সবাজার জেলা দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি ফরিদুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, বেলা দুইটার দিকে মামলার রায় ঘোষণা হতে পারে।

২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাত সাড়ে নয়টায় কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের শামলাপুর তল্লাশিচৌকিতে পুলিশের বাহারছড়া তদন্তকেন্দ্রের তৎকালীন কর্মকর্তা পরিদর্শক লিয়াকত আলীর গুলিতে নিহত হন সিনহা মো. রাশেদ খান। তাঁর সঙ্গে থাকা সাহেদুল ইসলামকে (সিফাত) পুলিশ গ্রেপ্তার করে। এরপর সিনহা যেখানে ছিলেন, সেই নীলিমা রিসোর্টে ঢুকে তাঁর ভিডিও দলের দুই সদস্য শিপ্রা দেবনাথ ও তাহসিন রিফাত নুরকে আটক করে। পরে তাহসিনকে ছেড়ে দিলেও শিপ্রা ও সিফাতকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায় পুলিশ। এই দুজন পরে জামিনে মুক্তি পান।

সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান এখন শুধুই ছবিতে। উত্তরা, ঢাকা, ৩১ জানুয়ারি
ছবি: প্রথম আলো
আরও পড়ুন

সিনহা হত্যার ঘটনায় মোট চারটি মামলা হয়েছে। ঘটনার পরপরই পুলিশ বাদী হয়ে তিনটি মামলা করে। এর মধ্যে দুটি মামলা হয় টেকনাফ থানায়, একটি রামু থানায়। তিনটি মামলার দুটি মাদক রাখার অভিযোগে এবং একটি পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগে।

এ ঘটনায় হত্যা মামলাটি করেন সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস। ওই বছরের ৫ আগস্ট আদালতে করা ওই মামলায় তিনি টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, বাহারছড়া তদন্তকেন্দ্রের পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ পুলিশের নয় সদস্যকে আসামি করেন।

আরও পড়ুন

চারটি মামলারই তদন্তের দায়িত্ব পায় র‌্যাব। পরে র‌্যাব এ ঘটনায় প্রদীপ কুমার দাশ, লিয়াকত আলীসহ ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করে। তাঁদের ১১ জন পুলিশ সদস্য ও ৩ জন গ্রামবাসী। পুলিশের করা তিনটি মামলার তদন্তে উত্থাপিত অভিযোগের কোনো সত্যতা না পাওয়ায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে র‌্যাব। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মো. খাইরুল ইসলাম বলেন, ওসি প্রদীপ কুমার দাশের পূর্বপরিকল্পনায় আসামিরা মেজর (অব.) সিনহাকে গুলি করে হত্যা করেন।

গত বছরের ১৩ ডিসেম্বর ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ ১৫ জনকে আসামি করে কক্সবাজার আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় র‍্যাব। গ্রেপ্তার আসামিদের মধ্যে ১২ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন । তবে ওসি প্রদীপ ও কনস্টেবল রুবেল শর্মা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেননি। এর আগে আসামিদের তিন দফায় ১২ থেকে ১৫ দিন রিমান্ডে নেওয়া হয়েছিল।

গত বছরের ২৭ জুন প্রদীপসহ ১৫ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে এই মামলার বিচার শুরু হয়।

অভিযোগপত্রে থাকা ৮৩ সাক্ষীর মধ্যে ৬৫ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেন আদালত। গত ১২ জানুয়ারি যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে আদালত রায় ঘোষণার দিন ধার্য করেন।

তথ্যচিত্র বানাতে বাড়ি ছাড়েন সিনহা

তথ্যচিত্র বানানোর জন্য ঢাকার উত্তরার নিজ বাসা থেকে নিজের গাড়িতে করে ২০২০ সালের ৩ জুলাই কক্সবাজারের টেকনাফে যান মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান। প্রায় প্রতিদিনই তিনি মুঠোফোনে মা নাসিমা আক্তার ও বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌসের সঙ্গে কথা বলতেন। মা নাসিমা আক্তার রাতে কথা বলে ঘুমোতে যেতেন। সেদিনও (৩১ জুলাই) রাত ১১টার সময় নাসিমা আক্তার সিনহার মোবাইলে ফোন দেন। পাঁচ থেকে সাতবার ফোন দিয়েছিলেন । তখন ফোন বেজেই চলেছিল।

সিনহার মা নাসিমা আক্তার তখন প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘ঈদের আগের দিন রাত ১১টার দিকে আমার ছেলেকে আমি ফোনে পাচ্ছিলাম না। তবে রাত ১২টার আগে একটা নম্বর থেকে আমার কাছে ফোন আসে। আমাকে তিনি জিজ্ঞাসা করেন, সিনহা আপনার কী হয়? জবাবে আমি বলি, সিনহা আমার ছেলে। পরে আমার কাছে তিনি আরও জানতে চান, সিনহা কী করে? আমি তাঁকে বলি, সিনহা আগে সেনাবাহিনীতে চাকরি করত। এখন কিছুই করে না। টুকটাক কাজ করে। তখন লোকটি জানতে চান, সিনহার কয় ছেলেমেয়ে? তখন তাঁকে আমি বলি, সিনহাকে তো আমি ফোনে পাচ্ছি না। ও কোথায়? লোকটি তখন বললেন, সিনহা আছে। একটু দূরে আছে। আমি তাঁকে বললাম, সিনহার কাছে মোবাইল ফোনটা দেন। একপর্যায়ে লোকটি আমাকে বললেন, আপনি আমার সঙ্গে এভাবে কথা বলছেন কেন? তখন তিনি নিজের পরিচয় দেন এবং বলেন, আমি টেকনাফ থানার ওসি। ওসি প্রদীপ তখন জানতে চান, আমার ছেলে সিনহা কেন চাকরি কেন ছেড়ে দিয়েছে? আমি বলেছিলাম, ছেলে চাকরি ছেড়ে দিয়েছে, সেটা তার ইচ্ছা।’

টেকনাফ থানার ওসি যখন ফোন রেখে দিলেন, তখন ছেলে সিনহাকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েন নাসিমা আক্তার। তবে সিনহাকে যে হত্যা করে ফেলা হয়েছে, সেই বিষয়টি তাঁর কল্পনাতেও আসেনি। তবে নাসিমা আক্তার তখন ধরে নিয়েছেন, হয়তো কোনো কারণে তাঁর ছেলে আছে থানায়। তাঁর ছেলে সিনহার পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার জন্য টেকনাফ থানার ওসি তাঁকে ফোন দিয়েছেন।

তখন ফের নাসিমা আক্তার টেকনাফ থানার ওসির নম্বরে ফোন দেন। বহুবার কল দিলেও আর তিনি কল ধরেননি। তখন নিরুপায় হয়ে নাসিমা আক্তার সিনহার একজন বন্ধুকে ফোন দেন, যিনি সিনহার ব্যাচমেট ছিলেন। সেনাবাহিনীতে কর্মরত। সিনহার পরিচয় জানার জন্য টেকনাফ থানার ওসি যে তাঁকে ফোন দিয়েছিলেন, সেই বিষয়টি সেনাবাহিনীর ওই কর্মকর্তাকে জানান। সিনহার মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে, সেই তথ্য তাঁকে জানান।

আরও পড়ুন

রাত গেল, কিন্তু ছেলে সিনহার কোনো খবর তিনি জানতে পারলেন না। ঈদের দিন সকালেও ছেলের মোবাইল ফোনে বারবার কল দেন। কিন্তু ফোন বন্ধ পান। আবার ঈদের দিন বলে ছেলের বন্ধুকে ফোন দিতে কিছুটা ইতস্তত বোধ করেন। তবে সকাল ১০টার সময় সিনহার ব্যাচমেট সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা তাঁকে ফোন দেন। কিন্তু সিনহার মৃত্যুর তথ্য তাঁকে জানাননি। তবে তাঁর কাছ থেকে সিনহার বড় বোন শারমিন ও তাঁর স্বামী মো. শামসুজ্জামানের মোবাইল ফোন নম্বর নেন।

ঈদের দিন বেলা ১১টার সময় দেখেন, বাসার সামনে তিনজন পুলিশ সদস্য। তাঁদের মধ্যে একজন উপপরিদর্শক (এসআই), দুজন কনস্টেবল। তাঁদের বাসার ভেতরে নিয়ে আসেন। উত্তরা পশ্চিম থানার এসআই সুমন চন্দ্র দাস নাসিমা আক্তারের কাছে সিনহা সম্পর্কে নানা তথ্য জানতে চান। কিন্তু সিনহাকে যে পুলিশ গুলি করে মেরে ফেলেছে, সেই তথ্য জানাননি। বাসা থেকে সিনহার অনেকগুলো ছবি তুলে নিয়ে যান এসআই সুমন চন্দ্র দাস।

সিনহার মা নাসিমা আক্তার বলেন, ‘আমার ছেলেকে যে মেরে ফেলবে, সেটা আমার কল্পনার অতীত। যত দাগি আসামি হোক, একটা মানুষকে যে মেরে ফেলবে, এটা যেকোনো মানুষের কল্পনার অতীত। দাগি আসামি হলেও তো এভাবে চট করে কেউ কাউকে মেরে ফেলে না। আমি স্বপ্নও ভাবিনি আমার ছেলে মারা গেছে।