রূপলাল হাউস ‘গায়েব’

রাজউকেরই একজন পরিদর্শক ও একজন জরিপকারী তিন দফা ফরাশগঞ্জ এলাকা পরিদর্শন করে লিখেছেন, সেখানে ঐতিহ্যবাহী কোনো স্থাপনা নেই।

  • আইন অনুযায়ী, গেজেটভুক্ত ঐতিহ্যবাহী স্থাপনার সীমানার মধ্যে নতুন করে কোনো ভবন নির্মাণ অবৈধ।

  • রূপলাল হাউসের সীমানার মধ্যে ভবন নির্মাণ নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় অনুমোদন বাতিল করে রাজউক।

রূপলাল হাউসের ঠিক সামনে নির্মাণ করা হচ্ছিল নতুন ভবন
ছবি: প্রথম আলো

সরকারের গেজেটভুক্ত ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ৭৪টি স্থাপনার মধ্যে ফরাশগঞ্জের রূপলাল হাউস অন্যতম। ২০০৯ সালে এসব স্থাপনার তালিকা করেছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। আইন অনুযায়ী, গেজেটভুক্ত ঐতিহ্যবাহী স্থাপনার সীমানার মধ্যে নতুন করে কোনো ভবন নির্মাণ অবৈধ। কিন্তু রাজউকেরই একজন পরিদর্শক ও একজন জরিপকারী তিন দফা ফরাশগঞ্জ এলাকা পরিদর্শন করে লিখেছেন, সেখানে ঐতিহ্যবাহী কোনো স্থাপনা নেই। এরপর তাঁদের মতামতের ভিত্তিতেই রূপলাল হাউসের সীমানার ভেতরে ছয়তলা ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেয় রাজউক। ইতিমধ্যে দোতলা পর্যন্ত ভবন তৈরি হয়ে গেছে।

তিন বছর আগে প্রথমে রাজউকের জরিপকারী আশুতোষ চাকমা ও পরে ইমারত পরিদর্শক মো. সাদ্দাম হোসেন ফরাশগঞ্জের রূপলাল হাউস পরিদর্শন করেন। তাঁরা তিন দফা পরিদর্শন করে সেখানে রূপলাল হাউসের কোনো ‘অস্তিত্ব’ খুঁজে পাননি। এর মধ্যে সাদ্দাম হোসেন পরিদর্শন প্রতিবেদনে লেখেন, ‘আলোচ্য প্লট হতে ২৫০ মিটারের মধ্যে কোনো ঐতিহাসিক ও নান্দনিক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা নাই।’

রাজউক সূত্রে জানায়, রূপলাল হাউসের জমি যে দাগে অবস্থিত একই দাগের প্রায় ৭ শতাংশ জমিতে ভবন নির্মাণের জন্য রাজউকে আবেদন করা হয়। আবেদনকারী ছিলেন তসলিমা ইসলাম। তাঁর পক্ষে নির্মাণাধীন ভবনটির ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা আশরাফুজ্জামানের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁর দাবি, যে জমিতে ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে সেটি রূপলাল হাউসের অংশ না, ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি। তসলিমা ইসলামের নামে জমিটি কেনা হয়েছে।

দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে রাজউক প্রমাণ করতে পারত তারা এখন দুর্নীতি-অনিয়মের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ (শূন্যসহিষ্ণুতা) নীতি নিয়েছে।
মোহাম্মদ ফজলে রেজা, সভাপতি, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স

তবে সরকারি গেজেট অনুযায়ী, রূপলাল হাউসের জমি কেনাবেচার আইনগত কোনো সুযোগ নেই। ঢাকা মহানগর ইমারত (নির্মাণ, উন্নয়ন, সংরক্ষণ ও অপসারণ) বিধিমালা-২০০৮ এবং ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড ২০২০ অনুযায়ী, ঐতিহ্যবাহী ভবন ও এর আওতাভুক্ত এলাকার সীমানা থেকে বাইরের ২৫০ মিটার পর্যন্ত অংশ সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে থাকবে। ঐতিহ্যবাহী কোনো ভবনের সীমানার ভেতরে সরকারনির্ধারিত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ছাড়া কোনো স্থাপনা নির্মাণ, উন্নয়ন, সংরক্ষণ বা অপসারণ করার সুযোগ নেই। এমন প্রেক্ষাপটে রূপলাল হাউসের সীমানায় ভবন নির্মাণের অনুমোদন কীভাবে দেওয়া হলো, তা নিয়ে রাজউকেই প্রশ্ন ওঠে। পরে গত জানুয়ারি মাসে রাজউক ভবন নির্মাণের জন্য দেওয়া অনুমোদন বাতিল করে। কিন্তু পরিদর্শনের নামে যাঁরা সত্য গায়েব করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

রূপলাল হাউসের তথ্য কেন পরিদর্শন প্রতিবেদনে উল্লেখ করেননি—জানতে চাইলে রাজউকের জরিপকারী আশুতোষ চাকমা প্রথম আলোকে বলেন, তিনি সঠিক তথ্যই উল্লেখ করেছিলেন, কিন্তু পরে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ভুল করেছে।

রাজধানীতে কেউ ভবন নির্মাণ করতে চাইলে আগে ভূমি ব্যবহারের ছাড়পত্র নিতে রাজউকে আবেদন করতে হয়। এর পর রাজউকের একজন জরিপকারী সরেজমিনে সংশ্লিষ্ট ভূমি বা প্লট পরিদর্শন করেন। জরিপকারীর পরিদর্শন প্রতিবেদন জমা হয় রাজউকের নগর–পরিকল্পনা শাখায়। সংশ্লিষ্ট ভূমিতে ভবন নির্মাণ করা যাবে কি না, তা ড্যাপের (বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা) সঙ্গে মিলিয়ে দেখে নগর–পরিকল্পনা শাখা। এরপর ভূমি ব্যবহারের ছাড়পত্র দেওয়া হয়। এই ছাড়পত্র পেলে ভবন নির্মাণের অনুমোদনের জন্য রাজউকেরই আরেকটি শাখায় (আঞ্চলিক কার্যালয়ে) আবেদন করতে হয়। তখন ইমারত পরিদর্শক আবার সরেজমিনে সংশ্লিষ্ট ভূমি বা প্লট পরিদর্শন করে প্রতিবেদন দেন। এই প্রতিবেদন সন্তোষজনক হলেই ভবন নির্মাণে চূড়ান্ত অনুমোদন পাওয়া যায়।

তবে এতগুলো ধাপ অতিক্রম করার সময় কীভাবে রূপলাল হাউসের বিষয়টি গোপন রাখা সম্ভব হলো, তা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন নগর–পরিকল্পনাবিদেরা। তাঁরা বলছেন, রাজউকের কিছু কর্মকর্তা–কর্মচারীর দুর্নীতির কারণেই এমনটি ঘটেছে। জেনেশুনে তথ্য গোপন করা হয়েছে।

২০১৮ সালে রূপলাল হাউসের সীমানার মধ্যে প্রথমের আটতলা ভবনের অনুমোদন দেওয়া হয়। পরে ২০২০ সালে সেটি সংশোধন করে ছয়তলা ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেওয়া হয়। ওই সময় ফরাশগঞ্জ এলাকায় রাজউকের ইমারত পরিদর্শক ছিলেন মো. সাদ্দাম হোসেন। তাঁর সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। সাদ্দামের দাবি, রূপলাল হাউস যে ঐতিহাসিক ভবন, তা তাঁর জানা ছিল না। এ ছাড়া সেখানে নতুন ভবনের নির্মাণের অনুমোদন দেওয়ার জন্য ‘প্রেশারে’ ছিলেন তিনি।

রূপলাল হাউসের তথ্য গোপন করে পরিদর্শন প্রতিবেদন দেওয়ার ঘটনায় জড়িতদের বিষয়ে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা জানতে চাইলে গতকাল শনিবার বিকেলে মুঠোফোনে রাজউকের পরিচালক (প্রশাসন) মুহম্মদ কামরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, কাগজপত্র না দেখে এ বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে কিছু বলতে পারবেন না তিনি।

তবে রাজউকের একটি সূত্র জানায়, জরিপকারী ও পরিদর্শককে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। তারা নোটিশের জবাব দেওয়ার পর বিষয়টি সেখানেই থেমে যায়।

বাংলাদেশের জাতীয় জ্ঞানকোষ বাংলাপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, রূপলাল হাউস উনিশ শতকের প্রথম দিকে নির্মিত ঢাকার একটি মনোরম ও সুবৃহৎ অট্টালিকা। রূপলাল দাস এবং রঘুনাথ দাস নামের বিত্তবান ব্যবসায়ী দুই ভাই অট্টালিকাটি নির্মাণ করেন। ১৮৪০ সালে তাঁরা আরাতুন নামের এক আর্মেনীয় ব্যবসায়ীর কাছ থেকে একটি পুরোনো ভবন কেনেন। এরপর কলকাতায় মার্টিন কোম্পানির একজন স্থপতিকে নিযুক্ত করে রূপলাল হাউসের নির্মাণকাজ শেষ করা হয়। এটি ভিন্ন স্থাপত্যরীতির দুটি অসমান ব্লকে বিভক্ত দ্বিতল প্রাসাদ। এর ভূমি নকশা ইংরেজি বর্ণ ‘ই’ আকৃতির। দোতলায় দুটি ব্লকে বিভিন্ন আয়তনের ৫০টির বেশি কক্ষ রয়েছে। ১৮৮৮ সালে ভারতের ভাইসরয় লর্ড ডাফরিনের ঢাকা সফরকালে তাঁর সম্মানে রূপলাল হাউসের নাচঘরে রূপলাল বল নাচের আয়োজন করা হয়েছিল।

গত শুক্রবার ঘুরে দেখা গেছে, রূপলাল হাউসের মূল ভবনটির অবস্থা জরাজীর্ণ। বিভিন্ন স্থানের দেয়াল ভেঙে পড়েছে। ভেতরের কয়েকটি কক্ষে পেঁয়াজ-রসুনসহ মসলার আড়ত। ভবনের তিনটি অংশের মধ্যে একটি অংশের সামনে রূপলাল হাউস লেখা একটি সাইনবোর্ড আছে। অন্য দুটি অংশের একটিতে লেখা ‘জামাল হাউস’, অন্যটিতে লেখা ‘নূরজাহান হাউস’। আর নির্মাণাধীন ভবনটি রূপলাল হাউসের ঠিক সামনে। নিচতলার কাজ শেষ, এখন দ্বিতীয় তলায় স্টিলের কাঠামো বসানো হয়েছে।

রূপলাল হাউসের সীমানায় ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি মোহাম্মদ ফজলে রেজা প্রথম আলোকে বলেন, এ ঘটনায় যাঁরা যাঁরা জড়িত তাঁদের সবাইকে খুঁজে বের করা দরকার ছিল। দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে রাজউক প্রমাণ করতে পারত তারা এখন দুর্নীতি-অনিয়মের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ (শূন্যসহিষ্ণুতা) নীতি নিয়েছে। যতক্ষণ পর্যন্ত এটি করা না হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত মানুষ ভাববে রাজউকের ছোট–বড় সব জায়গাতে দুর্নীতিই শেষ কথা।