শিশুটি মা-বাবার অপেক্ষায়, যা কোনো দিন ফুরাবে না

সড়ক দুর্ঘটনায় মা-বাবা ও নানার মৃত্যুর কথা জানে না শিশু সাকিরা আক্তার। দীর্ঘদিন মা-বাবা ছাড়া সাকিরার সময় কাটছে মামাদের সঙ্গে। গতকাল দুপুরে মাতুয়াইল এলাকায় মামার বাসায়
ছবি: দীপু মালাকার

মাথায় ছোট ছোট চুল উঠেছে। দুর্ঘটনার ধকল কাটিয়ে ওঠে মুখটা আরও আদুরে হয়েছে। এখন হেসে-খেলে সময় কাটে তার। শুধু মাঝেমধ্যে মা-বাবা কবে আসবে, তা জানতে চায়।

বলছি ছয় বছরের শিশু সাকিরা আক্তারের কথা, যে গত ২১ জানুয়ারি ঢাকার মাতুয়াইলে এক সড়ক দুর্ঘটনায় মা, বাবা ও নানাকে হারিয়েছে। দুর্ঘটনায় সে নিজেও মাথা ও কপালে আঘাত পেয়েছিল। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঁচ দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর সে সুস্থ হয়।

সাকিরা এখন মাতুয়াইলে তার ছোট মামা তানভীর আহমেদের বাসায় থাকে। তার ভাই শাহরিয়ার খান ওরফে ফাহিম (১২) থাকে বরিশালে নানার বাড়িতে।

সাকিরার দুই মামা ও চাচা জানান, তার মা-বাবার মৃত্যুর কথা তাকে জানানো হয়নি। বলা হয়েছে, বাবা বদলি হয়ে গেছে। আর মা তার নানিকে নিয়ে চিকিৎসার জন্য বিদেশে গেছেন। এদিকে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন থাকা তার নানিও গত ২৬ জানুয়ারি মারা গেছেন।

সাকিরা কেমন আছে তা জানতে গতকাল শনিবার এই প্রতিবেদক গিয়েছিলেন তার মামার বাসায়, মাতুয়াইলে। বেলা ১১টায় মাতুয়াইলের ভুট্টো চত্বরের মাজার রোডে ছোট মামার টিয়া রঙের তিনতলা বাড়িতে পৌঁছানোর পর জানা গেল, সাকিরা তার বড় মামা নজরুল ইসলামের বাসায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে।

সাকিরার ছোট মামার ফ্ল্যাটটির আয়তন ৬০০ বর্গফুটের মতো হবে। দুটি শোবার কক্ষ। আর খাবার কক্ষের জন্য কিছুটা জায়গা। বাড়ির কাছাকাছি মামাদের যৌথ প্যাকেজিংয়ের ব্যবসা।

সাকিরা আসার আগে তার তিন মামা জানালেন সেদিনের দুর্ঘটনার কথা। মেজ মামা রফিকুল ইসলাম বলেন, তাঁর মা শাহেদা বেগম জরায়ুমুখের ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মহাখালীতে জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। তাঁকে দেখতেই গ্রামের বাড়ি থেকে এসেছিলেন সাকিরার বাবা মো. রিয়াজুল ইসলাম খান (৪০), মা শারমিন আক্তার (৩২) ও নানা আবদুর রহমান ব্যাপারী (৬০)। মাতুয়াইলে সেন্ট মার্টিন পরিবহনের একটি বাসের ধাক্কায় তাঁদের বহনকারী অটোরিকশাটি উল্টে যায়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর তিনজনের মৃত্যু হয়।

নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ঢুকেই প্রথমে বাবার লাশ, পরে বোন ও ভগ্নিপতির লাশ দেখতে পাই। আমার মাথার মধ্যে কাজ করছিল, মিষ্টি ছিল সিএনজিতে (অটোরিকশা)। সে কোথায়? এরপর চোখে পড়ে, জরুরি বিভাগে ওর চিকিৎসা চলছে।’

এর মধ্যে বড় মামার বাসা থেকে চাচা হাবিব খানের কোলে চড়ে ছোট মামার বাসায় আসে সাকিরা। ঢুকতেই অপরিচিত মানুষ দেখে (এই প্রতিবেদক) মুখ লুকায় সে। মাথার চুল এখনো ছোট, দুই হাতে তা আড়ালের চেষ্টা করে। দেখা গেল, চুলের ফাঁকে তার মাথায় দুর্ঘটনার ক্ষত স্পষ্ট।

ছোট মামা সাকিরার মাথায় একটি উলের লাল রঙের টুপি পরিয়ে দেওয়ার পর সংকোচ কাটে তার।

‘ভাইয়া, তুমি কেমন আছ’

সাকিরা ছোট মামার বাসায় ঢোকার পরই তার ভাই শাহরিয়ার মামার মুঠোফোনে ভিডিও কল দেয়। ভাইয়ের গলা শুনেই খুনসুটিতে মেতে ওঠে সাকিরা। ভাইকে একসঙ্গে কয়েকটি প্রশ্ন তার, ‘ভাইয়া, তুমি কেমন আছ? তুমি কী করো? তুমি কি খাইছ?’ জবাবে ভাইয়ের উত্তর, সে খেয়েছে। আর সকালে সাইকেল চালিয়েছে। শুনে সাকিরা বলে ওঠে, ‘মুই সাইকেলে উঠছি।’

ছোট মামা তানভীর বললেন, সাকিরার জন্মের পর তার বাবা মেয়েকে ‘মিষ্টি’, ‘মিষ্টি’ বলে ডাকতেন। সেই থেকেই তার ডাকনাম হয়ে গেছে মিষ্টি। মামার কথার পিঠে সাকিরা বলে ওঠে, তার যে কত নাম! এত নাম তার মনে থাকে না। একটা নাম সে বানান করতে পারে ইংরেজিতে, ‘আর ইউ পি এস এ—রূপসা’।

সাকিরা আরও বলে, বাবা তাকে তার ভাইয়ের চেয়ে বেশি আদর করে। সে যা চায়, বাবা তাকে তাই কিনে দেয়। বাবা বদলি হয়ে গেছে, এ কারণে তার ভাইও চলে গেছে নানা বাড়ি। সেখানে স্কুলে ভর্তি হয়েছে। সে-ও নানাবাড়িতে গিয়ে স্কুলে ভর্তি হবে। মা বলেছে, নার্সারিতে (শ্রেণিতে) ভর্তি করে দেবে।

শিশু সাকিরার দাদাবাড়ি বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার ১ নম্বর বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীরনগর ইউনিয়নের চর হোগল পাতিয়া গ্রামে। সেখানেই এখন অন্তিম শয়ানে সাকিরার মা-বাবা। নানার বাড়ি একই জেলার উজিরপুর উপজেলার ওটরা ইউনিয়নের মশান গ্রামে। সেখানে নানাকে দাফন করা হয়েছে। নানার বাড়ির কাছাকাছি ভবানীপুরে কার্শা ফাউন্ডেশন নামে একটি বেসরকারি সংস্থার ইউনিট ব্যবস্থাপক ছিলেন বাবা রিয়াজুল।

ছবি-ভিডিওতে মা-বাবা

৭ নভেম্বর সাকিরা ও ১৫ নভেম্বর ভাই শাহরিয়ারের জন্মদিন। ছোট মামা তানভীর বললেন, প্রতিবছর দুজনের জন্মদিন উপলক্ষে একটি অনুষ্ঠান করতেন সাকিরার মা-বাবা। গত ১২ ডিসেম্বর হয়েছিল সেই অনুষ্ঠান। বড় মামা নজরুল তাঁর মুঠোফোনে জন্মদিনের ভিডিও দেখান। দেখা যায়, জরির কাজ করা লাল ঘাগড়া পরে আরও দুজনের সঙ্গে গানের তালে নাচছে সাকিরা। আরও ভিডিও এবং ছবিতে সাকিরাকে দেখা গেছে বাবা-মা-নানা-নানির সঙ্গে। ওই চারজনই এখন শুধু ছবি।

নিজের ভিডিও এবং ছবি দেখে সাকিরা বলছিল, ‘আব্বু-আম্মু খালি আমার গেদু কালের ছবি পছন্দ করে।’ অবশ্য তার পছন্দ একটু বড় হওয়ার পরের ছবিগুলো।

বড় মামা নজরুল বলেন, তিনি তাঁর ভাড়া বাসা আগামী মাসে ছেড়ে দেবেন। ১ মার্চ তাঁর স্ত্রী, সন্তান এবং সাকিরাকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি চলে যাবেন। সাকিরাকেও স্কুলে ভর্তি করাবেন। তাঁদের যৌথ পরিবার। সবাই মিলেই সাকিরা ও শাহরিয়ারকে দেখবেন।

চাচা হাবিব খান বললেন, তাঁদেরও দায়িত্ব নিতে কোনো সমস্যা নেই। সাকিরার বাবার কর্মস্থল থেকে চাকরির পাওনা বাবদ ১৩ লাখ টাকা পাওয়া যাবে। সেই টাকা সাকিরা ও শাহরিয়ারের নামে ব্যাংকে গচ্ছিত রাখা হবে।

ক্ষতিপূরণ মামলার প্রস্তুতি

সাকিরার বাবা, মা ও নানার দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পর যাত্রাবাড়ী থানায় সড়ক পরিবহন আইনে একটি মামলা হয়। মামলায় সেন্ট মার্টিন পরিবহনের চালক ও চালকের সহকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সাকিরার স্বজনেরা জানান, তাঁরা এখন পরিবহনটির বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণ মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। পরিবহন কর্তৃপক্ষ তিন লাখ টাকা দিয়ে সমঝোতার প্রস্তাব দিয়েছিল। তবে তাঁরা রাজি হননি।

বড় মামার সঙ্গে ১ মার্চ সাকিরা বরিশালে গেলে তার ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হবে। সাকিরা কোনো একদিন জানবে তার মা-বাবা আর ফিরবে না। তার অপেক্ষাও ফুরাবে না।