‘সব ছাই হইয়া গেছে, ফিরা কিছু পাই নাই’

আগুনে পুড়ে সব শেষ। শূন্য ভিটায় বসে আছেন সুমি বেগম। আজ রাজধানীর মানিকনগরের কুমিল্লা পট্টি বস্তিতে
ছবি: আশরাফুল আলম

পুড়ে কালো হয়ে যাওয়া মাটির ওপর থেকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে দেখছেন আকলিমা আক্তার। সব ছাই হয়ে গেছে। তবু যদি কিছু পাওয়া যায়। মানিকনগরের কুমিল্লা পট্টি বস্তির আগুনে আকলিমার সংসার এখন কয়লা হয়ে গেছে। কিছু রক্ষা পেয়েছে কি না, জিজ্ঞেস করতেই আকলিমা বলেন, ‘আমার কষ্টের সংসারের আর কিছুই নাই।’

রোববার বেলা তিনটার পর রাজধানীর মানিকনগরের কুমিল্লা পট্টি বস্তিতে আগুন লাগে। বস্তির টিনশেড ঘরগুলোর প্রায় সবই ভস্মীভূত। বস্তিতে যাওয়ার রাস্তা থেকেই বাতাসে পোড়া গন্ধ নাকে এসে ধাক্কা দেয়।

গৃহকর্মীর কাজ করে সংসার চালান আকলিমা আক্তার। ছেলের শরীরটা ভালো না থাকায় রোববার কাজে যাননি। দুপুরে খেয়ে ছেলেকে নিয়ে শুয়ে ছিলেন। তিনটার কিছু পর হইচই শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে যান। সঙ্গে কিছুই নিয়ে বের হতে পারেননি তিনি।

আকলিমা বলেন, ‘বহুত কষ্টে দুই মাসের ঘর ভাড়া সাত হাজার টাকা জমাইছিলাম। আমার সব ছাই হইয়া গেছে। পোলাডার হাত ধইরা বাইর হইছি। ফিরা আর কিছু পাই নাই।’

১১ বছর ধরে কুমিল্লা পট্টির বস্তিতে থাকেন আবদুস সোবহান। পেশায় রাজমিস্ত্রী এই ব্যক্তি ১১ বছরে কখনো আগুন লাগতে দেখেননি এই বস্তিতে। আগুন যখন লাগে, তখন তিনি ও তাঁর স্ত্রী কেউ ঘরে ছিলেন না। আগুন নেভার পর ফিরে এসে পোড়া টিন ছাড়া কিছুই পাননি।

সোমবার পুড়ে যাওয়া ওই বস্তিতে গিয়ে দেখা যায়, বাসিন্দাদের প্রায় সবাই নিম্নবিত্ত, দিন আনে দিন খায়। আগুন যখন লাগে, তখন বাসিন্দাদের বেশির ভাগ নিজেদের কাজে বাইরে ছিলেন।

আগুনে পোড়া বস্তিতে খাবারের অপেক্ষায় বসে আছেন কয়েকজন
ছবি: প্রথম আলো

ফায়ার সার্ভিসের সাতটি ইউনিট দেড় ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। সেদিন রাত থেকেই বাসিন্দারা পোড়া জায়গা থেকে নিজেদের মালামাল খুঁজতে থাকেন। গতকালও দেখা যায়, অনেকে জিনিসপত্র খুঁজে বেড়াচ্ছেন।

বিউটি বেগম কাজে ছিলেন। বড় ছেলেও দুপুরে খেয়ে বাইরে বের হয়ে যায়। এর এক ফাঁকে ছোট ছেলেও বাইরে খেলতে যায়। বিউটি যখন জানতে পারেন, আগুন লেগেছে, দৌড়ে ছুটে আসেন। ছোট ছেলের খোঁজ করতে থাকেন। তিনি বলেন, ‘পোলা ছোট, ওরে আমি এক বছর ধইরা তালা দিয়া কামে যাই। বড় পোলার লগে ওই দিন ওয় বাইর হইয়া যায়। নাইলে আমি পোলারে পাইতাম না।’

দুই ছেলে নিয়েই বিউটির সংসার। কিছুদিন আগে মা-ছেলে মিলে একটি রেফ্রিজারেটর কিনেছেন, সে কথা বলতে বলতেই কেঁদে ফেলেন। তিনি বলেন, ‘মায়ে-পুতে কত কষ্ট কইরা সংসার করি, সব শ্যাষ হইয়া গেল।’

বস্তিতে দেখা যায়, কারও কারও হাতে খিচুড়ির প্যাকেট। কারও কারও স্বজন খাবার নিয়ে এসেছেন। রিনা খাতুন নামের এক বাসিন্দা জানান, বস্তির পাশেই বালুর মাঠ নামের একটি জায়গা আছে। গত রাতে সেখানে সবাই রাত কাটিয়েছেন। স্থানীয় বাসিন্দা ও রাজনৈতিক নেতাদের পক্ষ থেকে খাবার ও থাকার জন্য কোনোরকম ব্যবস্থা করা হয়েছে।

কুমিল্লা পট্টি পড়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৭ নম্বর ওয়ার্ডে। এখানকার কাউন্সিলর মো. সামছুল হুদা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের হিসাবে ৩০০টির বেশি ঘর পুড়েছে। পরিবার আছে প্রায় ১৯০টি। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পুনর্বাসনের জন্য একটি তালিকা সিটি করপোরেশনকে দেওয়া হবে বলে জানান তিনি।

আগুন লাগার কারণ হিসেবে সামছুল হুদা বলেন, এখনো সঠিক কারণ জানা যায়নি।

আপাতত বস্তিবাসীদের থাকার ব্যবস্থা মানিকনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে করার চেষ্টা করছেন। তিনিসহ স্থানীয় সাংসদ সাবের হোসেন চৌধুরী এবং স্থানীয় বাসিন্দারা ও বিভিন্ন সংস্থা ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় এগিয়ে এসেছে।